বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
কবি উইলিয়াম ব্লেক এর জন্ম লন্ডনে। ১৭৫৭ সালে। ১৭৫৭ সাল! কী রকম গা ছমছম করা সাল।
কলঙ্কিত একটা সাল ...যে কারণে তার মনে পড়ে- The battle of Palashi was fought between Nawab sirajuddaula and the east india company on 23 June 1757. It lasted for about eight hours and the nawab was defeated by the company because of the treachery of his leading general mir jafar. উইলিয়াম ব্লেক অবশ্য অন্যান্য ব্রিটিশ কবিদের চেয়ে বাংলায় অনেক বেশি শ্রদ্ধেয় । ব্লেক-এর আধ্যাত্বিকতাই কি এর কারন? আর বাংলা যেহেতু রাবীন্দ্রিক। অথচ ব্লেক-এর জন্মসাল ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ। সালটা বাঙালিহৃদয়ে আজও কাঁটার মতন বিঁধে। কারণ, Palashi's political consequences were far-reaching and devastating and hence, though a mere skirmish, it has been magnified into a battle. It laid the foundation of the British rule in Bengal. For the English East India Company, Bengal was the springboard from which the British expanded their territorial domain and subsequently built up the empire which gradually engulfed most parts of India and ultimately many parts of Asia as well ...কাজেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
ব্লেক-এর জন্মের বছর ১৭৫৬ কিংবা ১৭৫৮ হলে এমন কী হত?। জগতে সে রকম হয় না। ব্লেক-এর বাবার নাম ছিল জেমস। কাপড় ব্যবসা করতেন, অর্থনৈতিক অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না । যা হোক।
ছেলের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন । বালক বয়েসে ড্রইং স্কুলে ভরতি হয়েছিল ব্লেক ...
এর আগেও বহুবার গলিটা চোখে পড়েছে তার।
সেগুনবাগিচার রাস্তায় আসতে যেতে রিকশায় বসেই উঁকি দিয়েছে। আজ গলিটার কাছে আসতেই হল। শান্তিনগর থেকে কাকরাইল মোড়টা পেরিয়ে পায়ে হেঁটেই এসেছে।
কেননা, কাল রাতে স্বপ্নে বাবাকে দেখেছে সে ... অনেক রাত অবধি উইলিয়াম ব্লেক-এর কবিতা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিল; ... তারপর ...
কাল রাতের বাবার স্বপ্নটা আজ অনেক অনেক বছর পর তাকে ছেলেবেলার স্কুলের গলিটার মুখে এনে দাঁড়া করিয়ে দিল। কত বছর পর? সে হিসেব কষা তো কখনোই হয়ে ওঠেনি। তবে ছেলেবেলায় এই গলির মুখটা নির্জন হয়েই থাকত। এখন গলির মুখে রিকশার জটলা, আশেপাশের অফিসের পিয়নদের জটলা; একটা কনফেশনারি। ফুটপাতের ওপরে বালির স্তুপ, ইটের পাঁজা।
স্কুলের গলিটা নেহাত ছোট নয়; বড়। কিন্তু, সরু। কোনওমতে একটি প্রাইভেট কার যেতে পারে। এই মুহূর্তে গলিটা ফাঁকা। বেলা ১২ টার মতো বাজে এখন ।
চারপাশটায় রোদ ঝলমল করছিল। চারপাশটায় এখন রোদ ঝলমল করছিল বলেই সে বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় আসেনি; কেননা, তখনকার দিনে বেলা ১টায় স্কুল ছুটি হয়ে যেত। তখনও রোদ ঝলমল করত। যদি সেই গন্ধ আর অনুভূতি কিছু পাওয়া যায় আজও। এ কারণেই সে বিকেলে কিংবা সন্ধ্যায় আসেনি।
গলিটায় সে ঢুকবে কি না ভাবল। একটা স্বপ্নের কারণে স্মৃতির ইশকুলের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া ... তা ছাড়া প্রায় চৌত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে। তার বয়সও এখন প্রায় চল্লিশ। তাকে এখন বুড়িয়ে যাওয়া প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের মতো দেখায়; রোগা, লম্বা, চশমা-পরা, কাচাপাকা চুল। অথচ, সে পাঁচ-ছয় বছরের তাকে খুঁজবে বলেই এখানে এসেছে।
তা ছাড়া, কাল রাতে বাবার স্বপ্নটাও তাকে এখানে টেনে এনেছে। স্বপ্নে বাবা কী যেন বললেন। সেটা বুঝতে না-পারার এক ধরনের থিকথিকে অস্বস্তি তাকে ঘিরে রেখেছিল আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই।
বাবা স্বপ্নে কী বলতে চাইলেন?
এখন একটা স্বপ্নের টানে অনেক বছর পর এখানে এসে দাঁড়িয়ে ভীষনই অস্থির লাগছে তার। কয়েক বছর হল সিগারেট ছেড়েছে-নইলে একটা সিগারেট ধরাত।
আর রোদের ভিতরে শান্তিনগর থেকে হেঁটে এসে বলে ঘেমেও গেছে। সেই সঙ্গে পানির পিপাসাও পেয়েছে বড়। সে এদিক ওদিক তাকায়। গলির মুখে সেই কনফেকশনারিটা। ওখানে ঢুকে ঠান্ডা কিছু খেয়ে নেব? ঠান্ডা এক বোতল সেভেন আপ? বুকটা ভীষন ধক ধক করছে।
কেন? কি বলতে চাইছিলেন বাবা কাল রাতের স্বপ্নে? আমি এখানে এলাম কেন? মনে হল স্বপ্নের ভিতরে আবছা ছেলেবেলার স্কুলটাও দেখলাম ...আর বাবা বসে ছিলেন সেই সিঁড়িতে।
সে একবার শ্বাস টানল। তারপর গলির ভিতরে যেতে থাকে। যেতে যেতে তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। এবং আগেই একবার বলা হয়েছে যে- স্কুলের গলিটা সংকীর্ণ ।
একটি প্রাইভেট কার কোনও মতে যেতে পারে। দু’ধারে ধুসর রঙের ময়লা দেওয়াল। দেওয়ালের রংটাই যা ময়লা-
এ ছাড়া গলিটা তেমন অপরিস্কারও নয়; নালা কি নর্দমা নেই ...থাকতে পারে, ঢাকা হয়তো, দেখা যাচ্ছে না। সব তো দেখা যায় না। এই কথায় তার কী কারণে মনে পড়ে গেল: The man who never in his mind and thoughts travel'd to heaven is no artist. এই কথাটাই ব্লেক একবার বলেছিলেন:এই কথাটা কি সত্যি? যদি সত্যি হয় তো? আমি আমার গত রাত্রির স্বপ্নটাকে খতিয়ে দেখব বলেই এখানে এসেছি? আমি কি শিল্পপ্রবণ? কল্পনাপ্রবণ? ব্লেক এর মতন? দুপাশের দেওয়ালে রোদ।
ওপাশে উঁচু অফিসভবন। ওখানে অনেক বন্দি লোকজন। তারা কেউই ব্লেকের কথা নেবে না; বরং ব্লেকের কথাটা প্রাণপন ভুলে যেতে চাইবে ।
আমি স্বাধীন! সে মনে মনে গর্জে ওঠে আর ম্লান হাসে। ব্লেক কি আমার মতোই স্বাধীন ছিলেন লন্ডন শহরে? মনে হয় তো।
নইলে তিনি কেন লিখবেন-
I love to rise in a summer morn,
When the birds sing on every tree;
The distant huntsman winds his horn,
And the sky-lark sings with me.
O! what sweet company.
গলিটা যেখানে শেষ হয়েছে- পুরোটাই সিমেন্ট বাঁধানো অনেকটা খোলা জায়গা । বাঁ পাশে একটি সাত তলা দালান। সে সময়টায়-মানে সেই ’৭২-৭৩ সালের দিকে সাত তলা দালান ঢাকা শহরে তেমন ছিলই না। টিফিন টাইমে সে আর তার সেই সময়কার স্কুলের ক’জন সহপাঠী দালানে ঢুকে সিঁড়ি দিয়ে উঠত। দালানটি অফিসভবন ছিল না-ছিল আবাসিক।
মনে, আছে ওদের হুটোপুটিতে বিরক্ত হত না কেউই। দালানটির বাসিন্দারা সব সম্ভবত ছিল অভিজাত। অভিজাতদের গম্ভীর হতেই হয়। এদেরই কারও সাদা রঙের বড় একটি গাড়ি ছিল। পরে সে জেনেছিল ওই সাদা গাড়িটি আমেরিকান জাগুয়ার- ষাট সালের মডেল ।
ঢাকায় সে সময় জাগুয়ার গাড়ি! এরা অভিজাত না হয়েই যায় না।
স্কুলবাড়িটা সাত তলা দালানটি ডান দিকে। ছাইরঙের তিন তলা বাড়ি। স্কুলটি যাদের ছিল-তারাও মনে হয় স্কুলবাড়িতেই থাকতেন। তখনকার দিনে স্কুল প্রতিষ্ঠা মানে এখনকার মতন ব্যবসা ছিল না; বরং ছিল মহৎ উদ্যেগ।
আর সে সময় ঢাকায় ক’টাই-বা কিন্ডারগার্ডেন স্কুল ছিল? এরা কিন্ডারগার্ডেন এর বাংলা করেছিল: “শিশুবাগ। ” বাগ শব্দটি কিন্তও বাংলা নয়- উর্দু কি ফারসি। বাগ মানে, ‘উদ্যান’। যেমন, গুলবাগ, চামেলি বাগ, শাহবাগ। দু-তিনশ বছর আগে এসব জায়গায় নবাবদের বাগান ছিল? তেমনি, শিশুবাগ মানে- ‘শিশুদের বাগান।
’ এক তলায় ছোট একটি বাগান ছিল; সে বাগানে ছোট একটি সিমেন্ট বাঁধানো পানির ট্যাঙ্কি ছিল । কত রকম যে রঙবেরঙের ছোট ছোট মাছ ছিল রোদ ঝলমলে পানিতে। হ্যাঁ, সে সব দিনে রোদ ছিল খুব। আর সে পানির কিনারায়
ঝুঁকে থাকত । বাগানের কোথাও অন্য জলাধারে পদ্মপাতাও ছিল কি? সম্ভবত।
নাকি এও কল্পনা?
ওপরে ওঠার সিঁড়িটা বাঁ দিকে। প্রিন্সিপালের রুমটা ছিল দোতলায়। বেশ বড় রুম। টেবিলের ওপর কাচ। দেওয়ালে টিয়া রং।
সত্তর ও আশির দশকে টিয়া রংটা বেশ পপুলার ছিল ঢাকায়। প্রিন্সিপালের মুখটি মনে নেই- অথচ প্রিন্সিপালের স্ত্রীর মুখটি পরিস্কার মনে আছে। বেঁটে মতন, মোটাসোটা চশমা-পরা ফরসা মহিলা। নাম সম্ভবত ‘মনোয়ারা’ । স্কুলটি ছিল তাঁর নামেই ।
স্কুলে সে কি কি শিখেছিল মনে নেই। টিচারদের কথাও তেমন মনে নেই। অবশ্য নীলা নামে একটি মেয়ের কথা মনে আছে। মেয়েটি খুব কাঁদত। কেন কাঁদত কে জানে।
ভয় পেত মনে হয়। কেন ভয় পেত? আশ্চর্য! নীলা দেখতে ছিল ফরসা। নীলা একবার বেঞ্চির ওপর গাল পেতে কেঁদেছিল। ওর ফরসা গালে বেঞ্চির কালো রং লেগে গিয়েছিল ... আশ্চর্য! ৩৫ বছর আগেকার ঝলমলে রোদ আর নীলার কথা মনে আছে। অথচ, একজন টিচারের কথাও মনে নেই।
আর মনে আছে স্কুলের তিন তালার ছাদটির কথা। সেই ছাদের পশ্চিমে দাঁড়ালে রমনার গাছগুলির ফাঁকে ঢাকার একটি বিখ্যাত হোটেলের কিছু অংশ চোখে পড়ত। খুবই সুন্দর দৃশ্য। স্কুলের পিছনেই ছিল বস্তি। সেই ১৯৭৩/৭৪ সালের কথা ... কত বছর আগের কথা ... অথচ আজও সেই মহিলার ফর্সা ধবল বাহুটি মনে আছে।
লোকেরা মহিলাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাচ্ছিল।
সেই প্রথম সে ‘আত্মহত্যা’ শব্দটি শোনে।
আমার কি ভালো লাগত স্কুল? সে নিজেকে শুধায়। তার মনে পড়ে ‘দ্য স্কুল বয়’ নামে ব্লেক- এর একটি কবিতা আছে। গতরাত্রে মুখস্ত করেছে, ভালো লেগেছিল বলে।
সে মনে মনে কবিতাটি পাঠ করে -
But to go to school in a summer morn,
O! it drives all joy away;
Under a cruel eye outworn.
The little ones spend the day,
In sighing and dismay.
সে একতালা সিঁড়ির দিকে তাকাল। ওদিকে তাকাতেই তার শরীরে কী রকম শিরশিরে এক অনুভূতি হল। কাল রাতের স্বপ্নে সে বাবাকে এখানেই বসে থাকতে দেখেছে। বাবা? ... স্কুলের কাছেই একটি অফিসে চাকরি করতেন বাবা । সেই ১৯৭২-৭৩ সালের কথা।
স্কুল ছুটি হলে তিনিই এসে নিয়ে যেতেন। একতলার সিঁড়ির ওপর বসে সে অপেক্ষা করত। । সবাই চলে যেত যার যার বাড়ি; আর সে বসে থাকত। একা।
এবং এভাবে শূন্যতার বীজ একটি শিশুহৃদয়ে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। একবার। তার মনে আছে- তখন সে ক্লাস ওয়ানে পড়ে; রেজাল্ট দিয়েছে। তো, সেদিন স্কুল ছুটির পর একতলায় এই সিঁড়ির ওপর বসে রয়েছে। সবাই চলে গেছে।
সে একা বসে আছে। একা। এবং এভাবে শূন্যতার বীজ তার শিশুহৃদয়ে ঢুকে যাচ্ছিল। সে অস্থির। বাবা কখন আসবে।
কেননা, সে ফাস্ট হয়েছে। অঙ্কে ১০০ তে ১০০। বাবাকে বলবে ফাস্ট হওয়ার কথা।
দূর থেকে বাবা কে আসতে দেখতেই তার ছোট্ট বুকের মাঠে আনন্দের সোনালি একটা বল গড়িয়ে গেল। সে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগটা তুলে দৌড় দিল।
বাবার কাছে গিয়ে বলল, আজ রেজাল্ট দিয়েছে।
বাবা থমকে যায়। হাত বাড়িয়ে বললেন, কই দেখি? রিপোর্ট কার্ড?
ব্যাগে। বলে সে ঝুঁকে ব্যাগ খুলে রিপোর্ট কার্ড বার করতে যাবে-বাবা বললেন, আচ্ছা, থাক। বাড়ি গিয়ে দেখব।
ঠিক আছে।
তারপর ওরা গলিটা পেরিয়ে রাস্তায় উঠে আসে। সে মিন মিন করে বলে, আজ কিন্তু রিকশা নিবা। আজ আমি হাঁটতে পারব না।
বাবা চুপ করে থাকেন।
সে বাবার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য দ্রুত পা ফেলতে থাকে। দিনটা ছিল ঝকঝকে রোদের। সে দিনটায় কারোই মৃত্যুর কথা মনে হয়নি। বিচ্ছিন্নতার কথা মনে হয়নি। বরং বাবাই তাকে প্রথম পাহাড় দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন।
রাঙামাটি। উহ্, সে কী উত্তেজনা! বারবার মনে হচ্ছে সবুজ রঙের বাসটা ডান পাশে খাদে পড়ে যাবে ...
হাঁটতে হাঁটতে তারা প্রায় কাকরাইল মোড়ের কাছে পৌঁছে যায় । সে আবার বলে, আব্বা রিকশা নাও।
বাবা এবারও চুপ করে থাকেন। সে ভাবল: আব্বার কাছে কি পয়সা নাই? এই ভেবে সে ফিক করে হেসেছিল কি? সেই পয়ত্রিশ বছর আগে ...
হাঁটতে হাঁটতে ওরা কাকরাইল মোড় পেরিয়ে এখন যেটা কর্নফুলি গার্ডেন সিটি -তারই কাছাকাছি চলে আসে।
হঠাৎই তার খেয়ালি বাবা কী মনে করে জিজ্ঞেস করলেন, ইংরেজিতে কত পাইছ?
১০০।
বাংলায়?
১০০।
অঙ্কে?
অঙ্কেও ১০০।
বাবা এবার দাঁড়িয়ে পড়েন। বললেন, দেখি, রিপোর্ট কার্ড দেখি।
সে চটজলদি ব্যাগ খুলে রিপোর্ট কার্ড করল। বাবা রিপোর্ট কার্ডটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলেন। সেই সময় তাঁকে ভীষন গম্ভীর দেখাচ্ছিল। ছেলের হাত ধরে রাস্তা পার হলেন। রাস্তার ওপারের তখনকার দিনের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান।
সেই মিষ্টির দোকানে ঢুকে বাবা দু সের মিষ্টি কিনলেন। সে বিস্মিত হয়ে যায়। আব্বার কাছে তাহলে টাকা ছিল! তাহলে আব্বা রিকশা নিলেন না কেন?
আরেকবার। ১৯৭৭/৭৮ সাল হবে। বাবার সঙ্গে ও রাঙামাটি শহরে গেছে।
শহরটি সমতলের অনেক ওপরে বলে নিচে একটি নদী দেখা যায়। সেই দিনটাও রোদ ঝলমল করছিল। ওদের পাশে একজন লোক দাঁড়িয়ে। লোকটির পরনে সাদা শার্ট, মাঝবয়েসি লোক। তিনি বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছেলে?
হ্যাঁ।
আমার ছেলেও আপনার ছেলের বয়েসি।
ও।
তারপর লোকটা বলল, আপনার ছেলে কি ছবি আঁকতে পারে?
এই কথার উত্তর না দিয়ে বাবা চুপ করে থাকেন। কেননা, সে সেরকম ছবি আঁকতে পারত না। তা ছাড়া সে ছিল বড় দূরন্ত ...সারাদিনই খেলে বেড়াত।
লেখাপড়ায় মন বসত না, ভারি চঞ্চল ...এই কারণেই বাবা চুপ করে থাকেন।
আমার ছেলে ছবি আঁকতে পারে। সেই লোকটি বলল।
এই কথায় বাবার মুখটা কী রকম গম্ভীর হয়ে উঠল। সে বোঝে যে বাবার ইচ্ছে ছেলে আঁকুক ...তবে বাবা তো আর বলতে পারে না-আমার ছেলে বড় হয়ে শিল্পী হবে।
যে আঁকে সে তো ছেলেবেলাতেই আঁকে। এসব ভাবতেই খুব কাছ থেকে উইলিয়াম ব্লেক ফিসফিস করে বলেন:Better murder an infant in its cradle than nurse an unacted desire...কাজেই সে এও ভাবল- সেই ছেলেটি এখন কোথায়? যার বাবা বহুকাল আগে বলেছিল: ‘ আমার ছেলে ছবি আঁকতে পারে। ’ তার আরও মনে পড়ে- বালক বয়েসে ড্রইং স্কুলে ভরতি হয়েছিল ব্লেক ...সে কেঁপে ওঠে। আশেপাশে তাকায়। সিঁড়িটা ফাঁকা।
কাল রাতের স্বপ্নে বাবা ওখানেই বসেছিলেন। কি যেন বলছিলেন বাবা ...হঠাৎই তার মনে হয় -আমি এখানে কেন? বাবাকে স্বপ্ন দেখা-কী এমন! বাবা আমাকে নিয়েও তো স্বপ্ন দেখতেন; সেই ছোট বেলায়। যখন ভবিষ্যতের ভালোমন্দ কিছুই জানা যেত না। বাবা ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন। বিশেষ করে ওর ছেলেবেলায়।
মানে শিশুকালে-যখন সে এই স্কুলে পড়ত। আশ্চর্য! সেসব মেঘলা দিনের কথা মনে পড়ে না। কেবলি অথৈ রোদ এর কথাই মনে আছে। কেন? মেঘলা দিনের কথা মনে নেই কেন? এসব কারণ বিজ্ঞান আবিস্কার করতে চায়। অথচ ব্লেক বলেছেন, Art is the tree of life. Science is the tree of death. কী এর মানে? শিল্প জীবনবৃক্ষ হলে ...বিজ্ঞান কেন মৃত্যুবৃক্ষ? বিজ্ঞান মৃত্যুবৃক্ষ বলেই কি জীবন অর্থহীন।
...জীবন অর্থহীন; এবং জীবন মহৎ নয়। জীবন অর্থহীন ও অ-মহৎ বলেই এর কোনও প্রয়োজন নেই-এর কোনও রুপই বাঞ্ছনীয় নয়; এমন কী পাখির রুপেও নয়, পাখিদেরও শিকারীরর গুলির সম্মূখীন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জীবন হল বিষাদের দীর্ঘ অধ্যায় সম্বলিত একটি দুবোর্ধ্য গ্রন্থ-অপূর্ন সাধের সমষ্টি। দীর্ঘকালীন হাহাকার ও অতৃপ্তি। ...এবং ঈশ্বর একটি শব্দমাত্র।
বড় অদরকারি একটি শব্দ। ঈশ্বর হল বিষাদের দীর্ঘ অধ্যায় সম্বলিত একটি দুবোর্ধ্য গ্রন্থটি পাঠ করবার অধিকতরো দুবোর্ধ্য পাদটীকা ...এবং এভাবে জীবন অর্থহীন হলে স্বপ্নও অর্থহীন ...কাজেই এখন সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং ফিরে যেতে থাকে। সেই গলিপথে দ্রুত হাঁটতে থাকে। ভীষনই ঘেমে গেছে। তা ছাড়া দারুন পিপাসা পেয়েছে।
সে সিগারেট খায় না-নৈলে ধরাত। তার বুকটা তখন থেকেই ধকধক করছিল। কেননা, তার কেবলি মনে হচ্ছিল- আজ সমস্তটাই উঠে আসতে পারে। আজ পয়ত্রিশ বছর পর শব্দগন্ধআলোসহ সবই উঠে আসতে পারে। অথবা, সেও হয়ে উঠতে পারে সেই শিশু।
আর, মৃত বাবা ও স্কুলের প্রিন্সিপাল, প্রিন্সিপাল-এর স্ত্রী ও নীলার মুখোমুখি পড়ে যেতেও পারে ...। এসব ভেবে সে আরও ঘেমে যেতে থাকে। তার পিপাসার বোধটি আরও গাঢ় হয়ে উঠতে থাকে। সিগারেটে একটা গভীর টান দেওয়ার জন্য তার বুকটা খলবল খলবল করতে থাকে। তার বুকটা তখন থেকেই ধকধক করছিল ... স্বপ্নে বাবা কী যেন বললেন ... আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর থেকেই সেটা বুঝতে না-পারার থিকথিকে অস্বস্তি তাকে ঘিরে রেখেছিল ।
স্বপ্নে বাবা কী বলতে চাইলেন? একবার মনে হল: বাবা এখনও স্কুলের সিঁড়ির কাছে বসে আছে। সে শিউরে ওঠে। সে দ্রুত হাঁটতে থাকে। সময় অতিক্রম করে সে দ্রুত গলিটা পেরিয়ে রাস্তায় উঠে আসতে থাকে ...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।