আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

২১ আগস্ট --- যা ভুলতে পারিনা।।

কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।

আমি একজন সাধারন মানুষ। সব সাধারন মানুষের মতই আমার মনে থাকার কথা না কবে কোথায় কোন রাজনৈতিক দলের সমাবেশ বা মহাসমাবেশ। সেদিন আমারা সব বান্ধবীরা মিলে একত্রিত হয়েছিলাম পুরান ঢাকার আমার এক বান্ধবীর শ্বশুর বাড়িতে। পুরান ঢাকায় যাওয়া হয়নি আমাদের, তাই সবাই মিলে ঠিক করেছিলাম আমরা পুরান ঢাকায় একত্রিত হব।

সকাল বেলায় জানু বলল-- আজ কিন্তু গাড়ি পাবে না। মনে মনে বললাম গাড়ির ফুটানিতো শুরু হল মাত্র দুই দিন। মুখে বললাম -- অসুবিধা হবে না আমি একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাব। জানু আফিসে চলে যাবার পর দেড় বছরের শুভার্থীকে কোলে নিয়ে বাসা থেকে বের হলাম। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা পুরান ঢাকা বান্ধবীর বাসায়।

তার বাসাটা সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের পিছনে। যাই হোক সারা দিন আড্ডা দেবার পর বিকাল চারটায় বাসা থেকে বের হলাম। আমার কাজ থাকার কারনে আমি আগেই বের হলাম। কোন ট্যাক্সি না পেয়ে একটা রিকশা নিয়ে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত আসলাম। সেখানও কোন ট্রান্সপোর্ট পেলাম না তখন একটি রিকশা রাজি হল গুলিস্থান পর্যন্ত আসতে।

আমি রিকশা করে গুলিস্থানে এলাম। এসে মনে হোল, এ কোথায় এলাম, এতো দেখি খালি মানুষ আর মানুষ। কোন ট্যাক্সি- রিকশা কিচ্ছু নেই। এক জায়গায় দেখলাম একদল পুলিশ। তাদের বললাম--ভাই ট্যাক্সি কোথায় পাব? তারা আমাকে সামনের দিকে যেতে বলল।

যত সামনে যাচ্ছি ততমানুষ বাড়ছে। কোথায় রাস্তা। তবুও মেয়েকে কোলে নিয়ে সামনের দিকে হাটছি। আমি আসলে কোন দিকে হাটছি কোথায় যাচ্ছি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ফুটপাথ ধরে হাটছি।

এমন সময় প্রচন্ড শব্দ। সেই শব্দের সাথে সাথে মানুষের চিৎকার আর সেই সাথে মানুষের ছুটোছুটি। আমি আর হাটতে পারছি না । মানুষের ধাক্কায় ফুটপাথের দেয়াল ঘেঁসে দাড়িয়েও থাকতে পারছি না। আমার কোল থেকে বাচ্চাটা কখন পড়ে যায় সেই আতংকে অস্থীর আমি জোর করে সামনের দিকে যাবার চেষ্টা করছি।

এমন সময় আমি যে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা সরে গেল ও আমি ভিতরের দিকে পরে যাচ্ছিলাম তখন এক বলিষ্ঠ হাত আমাকে শক্ত করে ধরে ভিতরে টান দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। আমি চোখ মেলে দেখলাম আমি একটা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। ঘরের মধ্যে পাঁচজন লোক আর আমি কোলে শুভার্থীকে নিয়ে। বাইরে মানুষের আর্তচীৎকার আর বোমার প্রচন্ড শব্দ। খোদাকে ডাকা ছাড়া আমার আর কিছুই করার নেই।

আমি মহা আতংকে ঘরের চারদিকে চোখ বুলালাম। একটি লম্বা টেবিল দুইটি চেয়ার। ওপাশে একটি দরজা। আমার পিছনে একটি দরজা। টেবিলের উপর দুইটি রেজিস্ট্রার খাতা।

সারা ঘরে এরশাদ মামুর ছবি আর লাঙ্গলের ছবি। একজন লোক দরজার ছিদ্র দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন আর একজন জানালার ছিদ্র দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। হঠাৎ একজন লোক বলল-- এই এক বুইড়া আর একটা মহিলা-- সাথে সাথে দরজা একটু ফাঁক করে মহিলা কে ও বুড়া লোকটিকে ভিতরে টেনে নিল। শুধু থেমে থেমে বোমার শব্দ আর মানুষের চিৎকার। একসময় শুনি পুলিশের গাড়ির শব্দ আবার মানুষের চিৎকার।

একসময় সব থেমে এল। তবুও দফায় দফায় চিৎকার ভেসে আসছে। মোটা মুটি শান্ত হবার পর আমাদের ঐ অফিসের লোকজন বলল-- আপনারা এবার চলে যান। বের হলাম রাস্তায়। এবার যেদিক থেকে এসেছি সেই দিকে চলেছি।

আমার পাশ দিয়ে যে যাচ্ছে তার গায়েই রক্ত। কারও হাত, পা‌ মাথা থেকে রক্ত পড়ছে আর কারও বা কাপড়ে রক্ত। বেশিরভাগ মানুষ খালি পা। আমি এখন কোথায় যাব? কি ভাবে যাব? ভাবলাম যে বাসা থেকে এসেছি সেখানেই ফিরে যাই। কোন গাড়ি রিকশা কিচ্ছু নাই।

হাটতে হাটতে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত এলাম। দেখি একটা দোতলা বি আর টি সি বাস সেখানে কিছু লোক বসে আছে। বাসটি মিরপুর যাবে। আমি বাসে উঠে বসলাম। কিছুক্ষন পর সব হৈ হৈ করে চিৎকার করতে করতে নেমে গেল বাসে নাকি আগুন দিয়েছে।

বাচ্চাটা কোলে নিয়ে আমি সবার শেষে বাস থেকে নামলাম। আর কিছুক্ষন থাকতে হলে আমার মেয়েটা ধোঁয়ায় অজ্ঞান হয়ে যেত। বাস থেকে নামার সাথে সাথে শুভার্থী বমি করা শুরু করল। দুই তিনবার বমি করে মেয়েটা একেবারে এলিয়ে পড়লো কোলে। আমার ব্যাগে ওর টাম্বলারে যে পানি আছে তাও আমার মনে নেই।

আমি ওড়না দিয়ে ওর মুখ মুছে দিলাম। এবার মনে মনে শক্ত হলাম। এভাবে ছুটো ছুটি করে কিছু হবে না। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হবে। প্রয়োজন হলে হেঁটেই যাব।

তার আগে আমি কোথায় তা দেখে নেই। তখন মনে পড়লো মোবাইলের কথা । মোবাইল বের করে দেখি নেটওয়ার্ক নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মাথা সোজা করে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি নগর ভবনের ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে।

একটু পিছিয়ে এলাম। দেখি বেশ কিছু রিকশা। জিজ্ঞাস করলাম শান্তিনগর যাবে কি না? বলল-- ও দিকে যাবার রাস্তা নেই। আজিমপুর ছোট বোনের বাসা--- না ওদিকেও যাওয়া যাবে না। পুরান ঢাকা যেখান থেকে এসেছি সেখানে? --না কেউ যাবে না।

রাস্তা জ্যাম। তখন এক মাঝ বয়সি রিকশাওয়ালা বলল-- সে শান্তিনগর যাবে ঘুরা পথে। তাকে ৫০টাকা দিতে হবে। আমি তাকে বললাম--আমাকে আপনি বাসায় পৌঁছায় দিবেন-- আপনি যত টাকা চাবেন আমি ততই দেব, আমি শুধু এখান থেকে বের হতে চাই। আমি রিকশায় চড়লাম।

যাত্রাবাড়ী, জয়কালী মন্দীর আমি জীবনে প্রথম দেখলাম। রাত দশটায় বাড়ি ফিরলাম। রিকশাওয়ালাকে বললাম--কত দেব। উনি বললেন মা ৫০টাকাই দেন। আর এক গ্লাস পানি দেন।

আমি তাকে বললাম--- আমি আপনার কাছে ঋনী রইলাম। সে হাসল -- কি যে বলেন মা আমিও তো মানুষ। আমি আসতাম না আপনার বাচ্চাটার জন্য আসছি। সামান্য রিকশাওয়ালা সেও জানে সে মানুষ। মানুষ মানুষের উপকার করে মানুষকে ভালোবাসে।

শুধু ঐ দুইপেয়ে মানুষ নামের জানোয়ারগুলো কি নারকীয় উল্লাসে মানুষ মারার উৎসবে মেতেছে। আমার সেই দেড় বছরের শুভার্থী এখনও সেই স্মৃতি ভুলেনি। পল্টনের ঐ রাস্তা দিয়ে এখনও যত বার যায় ততবার তার বাবাকে বলে-- বাবা এখানে মানুষের গায়ে খালি রক্ত আর রক্ত। রাস্তায় মানুষের ভীড় দেখলেই বলে-- বাবা এখনই বোমা ফুটবে, কান বন্ধ কর। কে বলে ছোট বেলার স্মৃতি বাচ্চারা ভুলে যায়।

আমার শুভার্থীতো ভুলে নাই। টিভিতে এখনও মিছিল দেখলে ও খুব মন দিয়ে দেখে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।