আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বলপয়েন্ট-১৩

http://www.facebook.com/Kobitar.Khata

বলপয়েন্ট-১৩ হুমায়ূন আহমেদ বলপয়েন্টে কোনও ধারাবাহিকতা নেই। এই ঘটনার পর এই ঘটনা ঘটল লিখে লেখক জীবনের ইতিহাস লেখায় আমি যাচ্ছি না। যখন যা মনে আসছে তাই লিখছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা ডায়েরি লেখার অভ্যাস আমার নেই। চিঠিপত্র বা ফটোগ্রাফ জমানোর মধ্যেও নেই।

আমার সমস্ত সঞ্চয়ই স্মৃতিতে। আমার মৃত্যুর পর পত্রিকাওয়ালারা একটা সমস্যায় পড়বেন। হুমায়ূন আহমেদের ডায়েরি বা অপ্রকাশিত জার্নাল নামে কিছু ছাপাতে পারবেন না। সাহিত্যের লাইনের গ্রান্ডমাস্টারদের কেউ কেউ আমাকে চিঠি লিখেছেন। সেইসব চিঠিও জমা করে রাখিনি।

আমার মানসিকতায় নিঃসঙ্গতা ব্যাধি আছে। নিঃসঙ্গতা ব্যাধিগ্রস্তরা তাদের পাশে কিছুই জমা করতে ভালবাসে না। প্রাণপণ চেষ্টা করে সবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে। উদাহরণ দেই। ঔপন্যাসিক বিমল মিত্র এসেছেন বাংলাদেশে।

উঠেছেন সোনারগাঁও হোটেলে। কৈশোরে বিমল মিত্রের বিশাল বই ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ খাটের তলায় বসে পড়ে শেষ করেছি। ক্ষণে ক্ষণে অশ্রুবর্ষণ করেছি। সবার সামনে এই বই পড়ার উপায় ছিল না, কারণ out book হিসাবে একজন কিশোরের কাছে সেই বই নিষিদ্ধ। কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম-এর বিমল মিত্র ঢাকায়- শুনেই ভালো লাগল।

এক সন্ধ্যায় বিমল মিত্রের কাছ থেকে টেলিফোন, হুমায়ূন, আস আমার সঙ্গে দেখা করে যাও। আমার আনন্দিত হয়ে ছুটে যাওয়া দরকার ছিল। তা না করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি কারোর সঙ্গে দেখা করি না। আমি আসছি না। আপনি কিছু মনে করবেন না।

যত বিনয়ের সঙ্গেই কথাগুলো বলা হোক, বিমল মিত্রের কাছে তা সুখকর নিশ্চয়ই ছিল না। আমার কর্মকান্ডের ব্যাখ্যা- লেখককে চিনব তাঁর লেখা দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে তাকে চেনার কিছু নেই। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব লেখকের প্রতি আমার একধরনের বিরাগও ছিল। তারা পিঠ চাপড়ানো কথা বলতে ভালবাসেন।

নিজেদের ব্রাহ্মণ ভাবেন। বাংলাদেশের লেখকদের জল-চল জাতের ওপরে কিছু ভাবেন না। এখনও যে সেই অবস্থায় ইতরবিশেষ হয়েছে তা-না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম ঢাকায় আসার ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। চারদিকে ফিসফাস ভাব।

সুনীল এসেছেন। পাঠকদের হাত থেকে তাঁকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। খবর পেলেই পাঠকরা প্রিয় লেখকের ওপর হামলে পড়বেন। তিনি কোথায় আছেন তা সম্পূর্ণ গোপন। যাদের সঙ্গে আছেন তাঁরা মহাভাগ্যবান হিসাবে চিহ্নিত।

তাঁরা কিছু Exclusive পার্টির ব্যবস্থা করছেন। অতি ভাগ্যবানরা সেই পার্টিতে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। আমি তেমন এক পার্টিতে যাওয়ার সুযোগ পেলাম। জনৈক প্রকাশকের বাড়িতে পার্টি। আমাকে কয়েকবার টেলিফোনে জানানো হলো যেন একা যাই।

কাউকে সঙ্গে না নিয়ে যাই। এবং ঘটনাটা প্রচার না করি। প্রচার হয়ে গেল জনতা সামলানো কঠিন হবে। ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রথম দেখলাম।

হাতে সিগারেট এবং হুইস্কির গ্লাস। আশেপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছেন বলে মনে হলো না। তাঁর স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় সুনীলের পাশে বসেননি। তাঁর হাতে কোনও গ্লাস নেই। তাঁকে খানিকটা বিব্রত মনে হচ্ছে।

ঘরে আলো কম। অন্য ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো হচ্ছে। কঠিন পরিবেশ যাকে বলে। পার্টিতে নিমন্ত্রণপ্রাপ্তরা বেশির ভাগই লেখক। তাঁরা তাদের সব বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন।

বই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তিনি পাতা উল্টে পাশে রেখে দিচ্ছেন। সাহিত্য এবং কাব্য আলোচনা চলছে। এমন কৃত্রিম কথাবার্তা এবং আচরণ আমি আমার জীবনে কম দেখেছি। শুরু হলো ফটোসেশন।

একেকজন লেখক যাচ্ছেন, নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলে ফিরছেন। মন ভরছে না। তিনি আবারও যাচ্ছেন। গ্রহের চারপাশে ঘূর্ণায়মান উপগ্রহদের ভেদ করে আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছতে পারলাম না। তাঁকে দেওয়ার জন্যে আমি আমার একটা উপন্যাস নিয়ে গিয়েছিলাম।

সেটা তাঁকে দেওয়া হলো না। গোপনে ফেরত নিয়ে চলে এলাম। আসরে ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের ব্যবহার একটু অদ্ভুত মনে হলো। সে দেখি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সমানে তুমি তুমি করে সম্বোধন করছে। সমরেশ মজুমদার একবার এলেন।

মিলন তাকেও দেখি তুমি করে বলছে। একদিন মিলনকে বললাম, এরা বয়সে তোমার চেয়ে অনেক বড়। তুমি অবলীলায় তাঁদের তুমি বলছ কীভাবে? মিলনের উত্তর শুনে আনন্দ পেলাম। সে বলল, হুমায়ূন ভাই, এঁরা বাংলাদেশে এসে সবাইকে তুমি তুমি করেন। কাজেই আমিও করি।

সম্বোধন সমান সমান। আমার সমস্যা হচ্ছে আমি কাউকেই তুমি করে বলতে পারি না। তুমি তুমি বলার বন্ধু আমার নেই। সবার সঙ্গেই ফর্মাল সম্পর্ক। একদিন শাওন বলল, তোমার যে কোনও বন্ধু নেই এটা কি তুমি জান? তোমার পরিচিতজন আছে, বন্ধু নেই।

তুমি অতি নিঃসঙ্গ মানুষদের একজন। আমি চিন্তা করে দেখলাম ঘটনা তো সেরকমই। বন্ধু নেই একজন মানুষ বাঁচে কীভাবে? আমি তো ভালো আছি এবং সুখেই আছি। কিছুক্ষণ চিন্তা করেই রহস্যের সমাধান বের করলাম (আমি আবার মিসির আলি তো)। আমার মাথায় সব সময় গল্প কিংবা উপন্যাস থাকে।

গল্প উপন্যাস যখন যেটা লিখছি তার চরিত্রই বন্ধু হিসাবে থাকে। বাইরের বন্ধুর প্রয়োজন সে কারণেই হয় না। ইমদাদুল হক মিলনের কাছে ফিরে যাই। তার সঙ্গে প্রথম দেখা বইমেলায়। আমেরিকা থেকে ফেরার পর প্রথম বইমেলায় গিয়েছি।

একটা স্টলের সামনে ভিড়। লেখকের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়া হচ্ছে। লেখক দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তাঁর পরনে জিন্সের প্যান্ট। মাথা সম্ভবত কামানো।

লেখকের চেহারা মোটেই লেখকসুলভ নয়। দেখাচ্ছে পাড়ার মাস্তানদের মতো। আমি এই লেখকের লেখার সঙ্গে পরিচিত নই। নামের সঙ্গেও না। আমি তাঁর একটা বই কিনলাম (ও রাধা ও কৃষ্ণ) এবং লাইনে দাঁড়ালাম অটোগ্রাফের জন্য।

আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে একবারই কারও কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছি। মিলন খুব সম্ভব নিজেকে প্রেমের উপন্যাসের লেখক হিসাবে পরিচিত করতে চেয়েছিল। কম বয়সের জনপ্রিয়তার এই একটা সমস্যা। লেখক পাঠকদের চাহিদার কাছে নতজানু হন। মিলনের লেখার ক্ষমতার বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী হওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে, তারপরেও তার ক্ষমতার ভুল ব্যবহার দেখে অনেকবার ব্যথিত হয়েছি। ওয়ার্ড কমিশনাররা ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দেন। আমি ওয়ার্ড কমিশনারের মতো মিলনকে একটা সার্টিফিকেট দিচ্ছি- যার জন্যে প্রযোজ্য লেখক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। সে অতি ভদ্র, অতি বিনয়ী। ঘরোয়া আড্ডায় কখনও তাকে উত্তেজিত হতে দেখিনি।

বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা তার ব্যাপক। বাংলা ভাষায় এমন কোনও বই লেখা হয়নি যা সে পড়েনি। তার চরিত্রে জল-স্বভাব প্রবল। যে কোনও পাত্রেই তাকে রাখা যায়। রাষ্ট্রবিরোধী কোনও কর্মকান্ডে সে জড়িত না।

আমি তার সর্বাঙ্গীণ উন্নতি কামনা করি। সার্টিফিকেট প্রসঙ্গ যখন এসেছে তখন আমি নিজে একটা সার্টিফিকেট যে পেয়েছিলাম সেই গল্পটা বলি। একদিন এক যুবক ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে বলল, তার হাতের লেখা অবিকল রবীন্দ্রনাথের মতো। সে কিছু নমুনাও নিয়ে এসেছে।

আমি বললাম, দেশ পত্রিকার সাগরময় ঘোষ তোমাকে পেলে লুফে নিতেন। একের পর এক রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠি প্রকাশ করতেন। আমি তাকে দিয়ে নিজের জন্যে রবীন্দ্রনাথের একটা সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিলাম। সেখানে লেখা- শ্রীমান হুমায়ূন আহমেদ তোমার কিছু রচনা পাঠ করিয়া বিমলানন্দ পাইয়াছি। তোমার কিছু শব্দের বানান বিষয়ে আমার কথা আছে।

সাক্ষাতে বলিব। ইতি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।