আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইসলামী ব্যাংক : তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে অসঙ্গতি ও কিছু কাজের কথা - ১

“বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। বরং বিক্ষত হও প্রশ্নের পাথরে। বরং বুদ্ধির নখে শান দাও, প্রতিবাদ করো। অন্তত আর যাই করো, সমস্ত কথায় অনায়াসে সম্মতি দিও না। কেননা, সমস্ত কথা যারা অনায়াসে মেনে নেয়, তারা আর কিছুই করে না, তারা আত্মবিনাশের পথ পরিস্কার

ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার তাত্ত্বিকরা কিছুদিন আগে পর্যন্তও মনে করতেন , পুরোপুরি ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া অব্দি সুদবিহীন ব্যাংক ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব নয় ।

মওদুদী প্রভৃতিরা মনে করতেন, “ যারা মনে করেন প্রথমে একটি সুদবিহীন অর্থ ব্যবস্থা তৈরী হয়ে যাবে, তারপর সুদ আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে, তারা আসলে ঘোড়ার আগে গাড়ী জুড়ে দিতে চান । ...... সুদ রহিত হওয়ার ব্যাপারটি যদি প্রথমে একটি অর্থব্যবস্থা তৈরী হয়ে যথেষ্ট উন্নত ও সংগঠিত হওয়া এবং বর্তমান সুদী অর্থব্যবস্থার স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবার শর্তসাপেক্ষ হয়, তাহলে নিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে, কিয়ামত পর্যন্ত সুদ রহিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই দেখা দেবে না । " [ইসলামী অর্ঠনীতি-মওদুদী ১৯৯৪, পৃ-২১১-১২] । এককালে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের উপাধাক্ষ্য এবং বর্তমানে সৌদি আরবের জেদ্দাতে আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী অর্থনীতির অধ্যাপক ড. এম. এ. মান্নান খুব জোর দিয়েই বলেছেন -" ইসলামী অর্থনীতি তথা সুদমুক্ত অর্থনীতি বাস্তবায়ন করতে হলেও... সামাজিক কাঠামো ও পরিবেশকে ইসলামী ভাবধারায় ঢেলে সাজাতে হবে । ইসলামী সামাজিক কাঠামো ছাড়া ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় ।

" [ইসলামী অর্থনীতি:তত্ত্ব ও প্রয়োগ, পৃ-১০৩] এই কথাগুলো যদি সততা ও আন্তরিকতার সথে বলা হয়ে থাকে, তাহলে এর দুটি তাৎপর্য কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই । এক : একটি দেশ শুধু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিশিষ্ট হলেই সেখানে ইসলামী অর্থনীতি তথা সুদমুক্ত ব্যাংক প্রথা চালু করা সম্ভব নয় । এর জন্য প্রয়োজন সমগ্র রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা এবং সামাজিক জীবন কাঠামোয় কঠোর শরীয়তি অনুশাসন চালু করা । এটা না করতে পারলে কতো দিন পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকিং চালু করা যাবে না, মওদুদী সাহেব তার একটি সময়সীমাও(কেয়ামত তক) বেঁধে দিয়েছেন । দুই : এদের মতে একই সাথে সুদী ব্যাংক ব্যবস্থা ও ইসলামী ব্যাংক একসঙ্গে পাশাপাশি অবস্থান করা কিংবা পারস্পরিক লেনদেনে লিপ্ত হওয়া একেবারাই সম্ভব নয় ।

এটা ছিল তত্ত্ব । প্রয়োগে কী দেখলাম ? লুক্সেমবার্গ, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ইত্যাদি যেসব দেশ মুসলিম অধ্যুষিত তো নয়ই,এমনকি সুদূর ভবিষ্যতেও সেখানে ইসলামী শাসন চালি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি না, তাতেও সত্তর আশির দশকে দু'একটি করে ইসলামী ব্যাংক ও অনুরূপ অর্থপ্রতিষ্ঠান চালু হয়ে গেল । কেয়ামত পর্যন্ত তো কেউ আর অপেক্ষা করলো না । এখন জামাতিরা কি তাদের এই বক্তব্য সংশোধন করলো ? মওদুদী সাহেব ততদিনে প্রয়াত হয়েছেন । মান্নান সাহেব তো জীবিতই আছেন ।

এমনকি ১৯৮৩ সালে তাঁর মূল ইংরেজি বইটির অনুবাদ প্রকাশনার সময় বইটির অন্যত্র কিছু সংযোজন ও সম্পাদনা করেছেন জানালেও উদ্ধৃত অংশের কোনো পরিবর্তন তিনি করলেন না । অথচ ঠিক তার তিন মাস আগেই ঢাকা শহরের বুকে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড স্থাপন করা হয়ে গেছে । সামরিক শাসক স্বৈরাচারী এরশাদের উদ্যোগে বাংলাদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষনার তখনও পাঁচ বছর বাকি । বইয়ে একরকম লেখা আর বাস্তবে আর এক রকম করা এই অসঙ্গতিকে ধারন করে বাংলাদেশে তথাকথিত ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু হলো । ইসলামী শাসন চালু হওয়ার আগেই যখন ইসলামী ব্যাংক চালু হয়ে গেল তখন স্বভাবতই নানা মহলে প্রশ্ন উঠলো : অন্যান্য প্রচলিত ব্যাংকের সাথে এর কোনো সম্পর্ক থাকবে কিনা বা দু'ধরনের ব্যাংক পাশাপাশি চলতে পারে কিনা ।

তখন মওদুদী-মান্নানদের বক্তব্য কোনো রকম খন্ডন না করোই এবং পুরোপুরি উপেক্ষা করে আল_নাজ্জাররা বললেন - " জোর দিয়েই বলা যায় যে, অন্যান্য সুদ নির্ভর ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকের যোগাযোগ বা লেনদেন রয়েছে ও থাকবে । তাদের মধ্যে সহাবস্থান খুবই সম্ভব । " এি জোর তিনি কীভাবে পেলেন সেটাই বুজতে পারলাম না । সম্ভবত নাজ্জার সাহেব দের 'ঈমানী' জোর । যাই হোক, ব্যাপারটা তাহলে এখন কী দাঁড়ালো ? সুদী ব্যাংকের সাথে লেনদেন মানেই তো সুদী কারবারের সাথে লেনদেন ।

টাগলে কি এটা নায্য বোচারে শরীয়ত বিরোধী হয়ে পড়লো না ? নবী করিম তো বলেছেন -শুধু সুদ প্রদান ও গ্রহন নয়, সুদের হিসাব লিখাও পাপ । যদি কোনো ব্যক্তি সুদী ব্যাংকে জমালো অর্থ তুলে এনে ইসলামী ব্যাংকে জমা করে, সেই অর্থের ভেতরে ঐ ব্যক্তির প্রথম আমানত এবং অর্থ তোলার সময় পর্যন্ত প্রাপ্ত সুদ যুক্ত হয়ে থাকবে । তখন তো ইসলামী ব্যাংক ঐ সুদযুক্ত অর্থেরই হিসাব রাখছে । ইসলাম মতে এটা কি গুনাহ হলো না? এমনিভাবে সুদী ব্যাংকের সাথে ইসলামী ব্যাংকগুলোর সমস্ত লেনদেন ও অর্থ সঞ্চালন প্রক্রিয়ায় সুদের ছায়া পড়বে । জামাতি ও মৌলবাদীরা এখনও মুখে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কোরানের শাসন চালু করার প্রচারনা চালায় ।

তার মানে, বাংলাদেশে সমাজ ও রাজনীতির ইসলামীকরন এখনও কিছই হয় নি । এদেশের বুকে প্রতিদিন যে লক্ষ কোটি টাকার আবর্তন ঘটছে, তা কোনো না কোনো সময় সুদী ব্যাংকের ভিতর দিয়ে ঢুকছে ও সুদী হারাম স্পর্শ মিয়ে বেরিয়ে আসছে । আবার বাংলাদেশে যে বিদেশী ঋণ ও সাহায্য আসছে, তাতেও বহির্দুনিয়ার সুদের গন্ধ-স্পর্শ ব্যাপক ভাবে লেগে আছে । ইসলামী ব্যাংকিং এর প্রবক্তারা কীভাবে তার মধ্যে হালাল টাকার গন্ধ পেলেন ? আগের পর্ব - ইসলামী ব্যাংকের আয় : কতোটা সুদবিহীন ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.