সত্যের পথে সবসময়
নটির মসজিদ। গোমতী নদীর তীরে অবস্থিত। প্রায় দু’শ বছর আগের নির্মিতব্য এই মসজিদটি। যেখানে কোন দিন আজান হয়নি। কোন মুসল্লী নামাজ পড়েনি।
ধর্মীয় দৃষ্টি ভঙ্গিতে এটা মসজিদ হলেও এখানে কোন দিন আজান হয়নি। উচ্চারিত হয়নি আজান। কারণ এই মসজিদটি একজন নারীর উপার্জিত অর্থে তৈরি হয়েছিল। সেই নারী ছিলেন পেশাগতভাবে ত্রিপুরা মহারাজার দরবারের বাঈজি বা নর্তকী। কুমিল্লা শহরতলী চান্দপুর গোমতী ব্রীজ পার হয়ে নদীর উত্তর তীর ঘেঁষে মাঝিগাছা নন্দীর বাজার সড়কের মুখপথে মঠ আকৃতির জীর্ণ-শীর্ণ এই মুসজিদটি।
এই মসজিদটি নিয়ে এখানকার মানুষের রয়েছে নানা কল্পকাহিনী। চান্দপুর-মাছিগাছা এলাকার লোকজন এটিকে নটির মসজিদ বলে থাকে। ইতিহাসের পালা বদলের পটভূমিতে মসজিদটি নিয়ে নানান কাহিনী শোনা গেলেও ত্রিপুরা মহারাজার আমলের উত্তরসূরীদের অনেকেই তাদের বাপ-দাদার কাছ থেকে এই মসজিদের কাহিনী শুনেছেন। তবে কাহিনী বিন্যাসে অমিল থাকলেও মসজিদটি যে একজন বাঈজির আর্থিক অনুদানে নির্মিত হয়েছিল এব্যাপারে কোন দ্বিমত নেই।
জানা যায়, গোমতী উত্তর পাড়ের মাঝিগাছা গ্রামে নুরজাহান ও তার ছোট দু বোন মোগরজান ও ফুলজানরা বসবাস করতেন।
তাদের বাবা-মার পরিচয় জানা যায়নি। খুব সম্ভব ১৭৭০ সালে দুর্ভিরে সময় কিশোরী নুরজাহানকে সাপে কামড়ালে তাকে ভেলায় করে গোমতী নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। ত্রিপুরার মহারাজার দরবারে নিয়ে চিকিতসায় সুস্থ করে তুলে। ধীরে ধীরে মেনেকা তাকে নাচ-গান শিখিয়ে মহারাজার দরবারে সেরা বাঈজিতে পরিণত করে। প্রায় ৩৫ বছর রাজা মহারাজাদের দরবারে নর্তকী হিসেবে থাকার পর মধ্য বয়সেই নর্তকী নুজাহান রাজদরবার ছেড়ে নিজ গ্রাম মাঝিগাছায় আসেন।
এ সময় ত্রিপুরার মহারাজা বাঈজি নুরজাহানকে মাঝিগাছায় কয়েক একর জমি ও প্রচুর অর্থ, স্বর্ণালংকার দান করেন। নুরজাহান নিজেকে এক জমিদারের বিধবা স্ত্রী পরিচয়ে মাঝিগাছায় বসবাস শুরু করে। তখন প্রায়ই নুরজাহান তার ছোট দু বোনকে খুঁজতে বেরুতো। গ্রামের মানুষদের নানা রকম সাহায্য সহযোগিতা করতেন। এক সময় বাঈজি নুরজাহান তার অতীত কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এক হুজুরের শরণাপন্ন হলে হুজুর নুরজাহানকে নিজ খরচে এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করতে বলেন।
হুজুরের পরামর্শ মতে বাঈজি নুরজাহান এলাকায় মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু করেন। স্থানীয় গণ্যমান্য লোকজন এ কাজে এগিয়ে আসেন। নুরজাহানের পুরো আর্থিক যোগানে মসজিদ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। নুরজাহান যে হুজুরের পরামর্শে মসজিদ নির্মাণ করেছেন সেই হুজুরকে গ্রামবাসীদের সঙ্গে বসে মসজিদে নামাজ পড়ার দিন তারিখ ধার্য করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। একদিন হুজুর গ্রামবাসীদের সঙ্গে এক সভায় এসে অতি উতসাহী হয়ে নুরজাহানের জীবন কাহিনী বলে দিলে নুরজাহানের বাঈজি পরিচয় প্রকাশ পেয়ে যায় এবং তা পুরো গ্রামে জানাজানি হয়।
ঐ দিনই সভায় সিদ্ধান্ত হয় নর্তকী নুরজাহানের অর্থে নির্মিত মসজিদে কেউ নামাজ পড়বে না। এটি নটির মসজিদ। এই মসজিদে নামাজ পড়া জায়েজ না। সেই সিদ্ধান্তের পর থেকেই ঐ মসজিদে কোনদিন আজান হয়নি। কেউ নামাজ পড়েনি।
এ ঘটনার পর বাঈজি নুরজাহান আক্ষেভে দুঃখে নিজ গৃহে একাকীত্ব জীবন কাটিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। অনেকের মতে, গ্রামের মানুষের ওই আচরণে আঘাত পেয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অন্যত্র চলে গেছে। আবার কারো মতে, গ্রামের মানুষের অপবাদ সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে এবং তার নির্মিত মসজিদের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে। সম্ভবত সেই থেকেই মসজিদের পশ্চিম দিকের কিছু অংশ বর্তমানেও কবরস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার উত্তর পূর্বে চান্দপুর এলাকা অতিক্রম করে যেতে হয় নটির মসজিদে।
গোমতী নদীর উত্তর পাড়ে বাঈজি বা নটির মসজিদটি দু’শ বছর ধরে কালের নীরব সাী হয়ে আছে। বাঈজি নুরজাহানের রেখে যাওয়া মসজিদ ও আশপাশের বেশ পরিমান জায়গা এখন ওয়াকফ সম্পত্তি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে উদাসীনতার কারণে দিনে দিনে বেদখল হয়ে যাচ্ছে ওয়াকফ সম্পত্তি। বর্তমানে মসজিদ সংলগ্ন একটি স’মিল কারখানা গড়ে ওঠায় এর আশেপাশে আরো কয়েকটি দোকান কোটা নির্মাণ হওয়ায় মসজিদটি সহজে পথচারী বা দর্শনার্থীদের চোখে পড়ে না। দু’শ বছরের এই কালজয়ী নিদর্শন নটির মসজিদটি।
এর ঐতিহ্য রা ও সংরণে সকলের এগিয়ে আসা উচিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।