আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইউ-টিউব: এক

যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে

উর্ধ্বমূখী বাড়ীগুলোর উপরের দিকের ফ্লাটে যাদের বসবাস তাদের বিশুদ্ধ-হাওয়ার একটা বিলাস আছে। সাতসকালে বেলকুনিতে দুই-হাত ছড়িয়ে বাতাস গিলে খাওয়ার তেমন বন্দোবস্ত করছে জামিল। নিচের রাস্তাটা সুনশান। মেইন রাস্তার মুখটা দেখা যায়। শাড়ি পরিহিতা একটা মেয়ে হেঁটে আসছে।

অদূরে পার্কের বৃক্ষরাজির উপর থেকে বিশাল আকাশ জামিলের হাতের মুঠোতে এঁটে যায়। বারান্দার গ্রিলে হাতের উপর ভর দিয়ে জামিল চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। স্বচ্ছ বাতাসের ভেতরে একধরণের সিম্ফনী, তন্ময়তায় বুদ জামিলের কানে ভেসে আসে বড় সড়কে স্যাত করে পেড়িয়ে যাওয়া ট্রাকের টায়ারে পিচের ক্রন্দন। নিচেও মনে হলো জোরালো একটা শব্দ হলো। ধাক্কা লেগে উল্টে যাবার মত।

চোখ মেলে জামিল হতভম্ব হয়ে যায়। শব্দের উৎস এপার্টমেন্ট হাউজটার সামনেই। যে মেয়েটিকে আসতে দেখেছিল তাকে ধাক্কা মেরে একটা গাড়ী পাশ কেটে ছুটে যাচ্ছে। পিচের উপরে মেয়েটি লুটিয়ে পড়লো, গড়িয়ে গেলে কয়েক ফিট, চারপাশে চিক চিক করে ছড়িয়ে পড়ছে ছোপ ছোপ রক্ত। পালানো গাড়ীর সজোরে এক্সেলেটর চাপার আওয়াজ, হর্নে বিদীর্ণ হয়ে গেল প্রভাতী প্রার্থনা।

জামিল মেয়েটির একটা আর্তস্বর শুনতে পেল। এরপরে আবার নীরবতা, কাকপক্ষির দেখা নেই। কয়েকটা পাহাড়াদার কুকুর বড় রাস্তায় ভ্রমণে বেড়িয়েছে। ফুটপথে জংলার ধারে ঘুম ভেঙে গেল ক্লান্ত কয়েকটা ব্যাঙের। লাফিয়ে উঠলো মেয়েটির পতন দেখে।

ব্যঙের সর্দি লেগেছে, খুক খুক কাশি। জামিল অবশ্য এসব দেখতে পেল না, শুনতে পাওয়া তো দূরের কথা। ছুটে যাওয়া গাড়ীর ড্রাইভার কেবল বিড়বিড় করলো খানিক, ইস! সারছে – ক্রসের ভংগীতে বুকে হাত ছুঁইয়ে স্টিয়ারিং জাপটে ধরে বড় রাস্তায় সেঁধিয়ে যায়। পেছনে কেবল হলুদ শাড়ীতে রৌপ্যময় সকালে সড়কে পড়ে থাকা অদ্ভুত পোট্রেট জামিলের চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। সে নিচে নামতে চায়।

প্রয়োজনে সাততলার উপর থেকে লাফিয়ে নামবে। ট্রাউজারের ঝুলটা পায়ের গোড়ালিতে গোত্তা খায়। দৌড়ে নামতে গিয়ে ঝামেলা হচ্ছে দেখে কাচিয়ে তোলে গোড়ালীর উপরে। তারপর দরজা খোলে সশব্দে। লিফটের কোন সাড়া নেই।

সিড়ির দিকে ছোটে। সাততলা আর ছ’তলার মাঝের উইন্ডো দিয়ে সড়ক দেখা যায়। ইউ-টার্ন ঘুরতে গিয়ে সেখান থেকে মেয়েটির নিথর শরীর দেখতে পায়। এখনও নেই কেউ চারপাশে। দৌড়ে চলে আসে এর নিচের তালার সিড়ি-জানালায়।

মেয়েটি পড়ে আছে। দূর থেকে একজন ভদ্রলোককে দৌড়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। সে মনে হলো চিৎকার করছে। জামিল পাঁচতলায় নেমে আসে। দেখে আরো দু’জন জুটেছে।

হাত নেড়ে সবাই উত্তেজিত আলাপরত। একজন ভদ্রলোক মেয়েটির মাথায় হাত দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে ক্ষতের পরিমান। জামিল বুঝতে পারে আরেকজন জিজ্ঞেস করলো, মরে গেছে? হাত দিয়ে পরখ করছেন যিনি তিনি অনিশ্চিতির মাথা ঝোলায়। জামিল চারতলায় নেমে যায় উল্কার বেগে। একটা গাড়ি আসতে দেখে বড় রাস্তা ধরে।

তিনজন ভদ্রলোক সামনে গিয়ে হাত নাড়ছে গাড়ির উদ্দেশ্যে। স্লো হতে থাকে। তিনতালায় এসে জামিল দেখতে পায় চালক গাড়ী থেকে নেমে দূর্ঘটনাকবলিতার সামনে – তিন ভদ্রলোক মেয়েটিকে ধরাধরি করে ওঠাচ্ছে। চালক গাড়ির পেছনের ডোরটা খুলে ধরে। এক বারে দুইটা স্টেয়ার লাফিয়ে লাফিয়ে দোতালায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে গাড়ি ছুটতে থাকে।

দু’জন ভদ্রলোক মেয়েটিকে নিয়ে গাড়িতে। বড় রাস্তার মোড়েই একটা প্রাইভেট হসপিটাল। কেবল একজন মাঝবয়সী সাহায্যকারী দাড়িয়ে আছে। এপার্টমেন্ট হাউজের নিচের গাড়ী বারান্দা পেড়িয়ে জামিল দৌড়ে যখন রাস্তায় পৌঁছে, গাড়ী তখন বড় রাস্তায় বাঁক ঘুরছে। মাঝবয়সী ভদ্রলোক উল্টো দিকে ক্লান্ত পদক্ষেপে হেঁটে যাচ্ছে।

জামিল ভো দৌড়ে মেয়েটি যেখানে পড়ে ছিল সেখানে এসে দাড়ায়। ছোপ ছোপ লাল রক্ত। ভাঙা কাচের টুকরো। ঘাতক গাড়ীর রিয়ারভিউ ভাঙা। হাপাতে হাপাতে দেখতে থাকে।

টায়ারের চিহ্ন গাঢ় হয়ে ফুটে আছে সড়কের কয়েক জায়গায়। লাল রক্তের উপরে মিশ্রিত একটা কালো আস্তর দেখা যাচ্ছে। মাছিদের আনাগোনা। জামিলের পেট গুলাতে থাকে। প্রত্যাশায় একটা শান্তিময় প্রভাতের গুঞ্জনী ছিল, রুটিন ভেঙে অনেকদিন পরে সূর্যফেরী দেখা – অকষাৎ দুমড়ে মুচড়ে গেল।

কপালে শিরশিরে টান - টলতে টলতে ফুটপথে বসে পড়ে। পায়ের নিচে সবুজ ঘাস। ভোরের শিশির স্যান্ডেলে মাখামাখি। পা ছড়িয়ে পেছনে দুইদিকে হাত ভর দিয়ে নীল আকাশ দেখে। একটা বড় রেইনট্রি গাছের অর্ধেকটা রাস্তা আগলে আছে।

পাতাদের ছিদ্র দিয়ে আকাশের নীল – কালো সড়কের ছোপ ছোপ রক্তের মত মনে হয়। শক্ত মত কিছু পায়ে টের পায়। একটা মোবাইল। নোকিয়ার এন সিরিজ। ঔৎসুক্যে তুলে নেয় জামিল – রক্তের ছিটেফোটা লেগে আছে তখনও।

মেয়েটিরই হবে। হাতে নিতেই স্ক্রিন সেভার মুছে যায়। সজাগ হয়ে ওঠে কথ্যযন্ত্র। জামিল বাটনগুলো চাপতে থাকে। ইউজারের নাম অতন্দ্রিলা।

ডায়াল নম্বরে চেপে শেষ কলটি বের করে। সুহাদ। ষোলো মিনিট আগে করা। জামিল নম্বরটা চেপে দেয়। একটা চেহারা ভেসে ওঠে।

হাসি হাসি মুখের এক সৌম্যকান্ত যুবক। কিন্তু ঐপাশে কোন আওয়াজ নেই। রিডায়াল করে। এবার যান্ত্রিক রমনীর সংযোগ প্রদানের অপরাগতাময় দুঃখপ্রকাশ। কি হলো, জামিল বিচলিত হতে থাকে।

বিড়বিড় করে বলে কিছুক্ষন আগে কথা বলেছিলো অথচ এখন বন্ধ! আশ্চর্য্য! কপালে ভাজ পড়ে। ফাইল ফোল্ডার খুঁজে একটা ভিডিও বের করে। নড়েচড়ে বসে। ভিডিওটা ওপেন হতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। তাদের এই সড়কের ছবি।

কেউ ছবি তুলতে তুলতে হাঁটছে। সম্ভবত মেয়েটাই। সড়ক থেকে ফ্রেম গিয়ে থামছে বাড়িগুলোতে। দূরে তাদের এপার্টমেন্ট হাউজটাও দেখা যাচ্ছে। ক্রমশ নিকটবর্তী হচ্ছে এপার্টমেন্ট।

জামিল সাততলায় তার বারান্দাও দেখতে পেল। মনযোগ দিয়ে দেখলো সেখানে সে নেই। মনে হচ্ছে ভিডিওটা সদ্য তোলা – বড় সড়ক থেকে ঢোকামাত্রই সে মেয়েটিকে দেখেছিল কিনা তার স্পষ্ট মনে আছে, অথচ ভিডিওটিতে তার কোন হদিস নেই। এরপরে ক্রাস...ফ্রেম ঘুরে গেল, পিচ, গাড়ী, বৃক্ষ আর আকাশের ছবি দিকবিদিক ভেসে উঠলো। একটা ফ্রেমে আটকে গেল তার চোখ – মেয়েটি আছড়ে পড়ছে রাস্তায়, পরক্ষণেই ভেসে উঠলো সুহাদের মুখ, ক্লিন শেভড, পাঞ্জাবীর হাতাও মনে হয় পরিষ্কার বোঝা গেল।

ক্লিপটি শেষ হয়ে যায়। জামিল বারবার ক্লিপটি দেখতে থাকে। ছবির ফোল্ডার খুঁজে বের করে সুহাদের ছবি। মাথার ভেতরে ঝড় বইতে থাকে। পরিচিত মুখ।

হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে। হ্যা, এই মুখ তার অনেক দেখা। কিন্তু তা কি করে হয়। সুহাদের চোখ দেখে ভুল হবার জো নেই। দাড়িগুল্ফের মাঝে এই চোখই ছেলেটার।

সারল্য উপচানো একটা মুখায়ব তাদের এপার্টমেন্টে দেখেছে। গ্যারেজে মাঝেমাঝে একটা গাড়িতে বিষন্ন এই চোখ দুটি তার মনোযোগ কাড়তো। কিন্তু অযত্নে গজানো দাড়ি কেটে এতো রীতিমত পলিশড! জামিল বুঝতে পারে না। জামিল উত্তেজনায় দাড়িয়ে যায়। শেষ ডায়ালকৃত ফোনের আগেরটা চাপে।

বন্ধ। রিসিভ কলগুলো খুঁজে দেখে। শেষ রিসিভ কলও সুহাদের। বিশ মিনিট আগের। তারমানে সুহাদ আগে ফোন করেছিল।

হাঁটতে থাকে রিসেপশনের দিকে। মান্নান মিয়া ভিজিটরস বুকে আঁকাবুকি করছে। জামিল হন্তদন্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে, মান্নান মিয়া, দেখো তো এই ছেলেটিকে চেনো কিনা? সুহাদের ছবিটা বের করে মোবাইল মান্নানের হাতে দেয়। মান্নান ছবিটা দেখে আঁতকে ওঠে। ভাইজান, এই ছবি তো সুহাদ ভাইয়ের! ৩বির।

শেভ করলো কবে? কোথায় পেলেন? ছ’মাস জয়েন করেছে মান্নান। বলে এই ছ’মাসে তারে তো শেভ করতে দেখি নাই! জামিল মান্নানকে কিছু বলে না। ৩বি। সিড়ি ভেঙে উঠতে থাকে। ফ্লাটের সামনে কোন নামফলক নেই।

কেবল একটা ড্রাগনের ছবি। কলিং বেল চেপে দাড়িয়ে থাকে। এত বড় একটা ঘটনা – সুহাদ কিভাবে এলো, এলেই বা গেল কোথায়, কি হচ্ছে – জামিলের বিমূঢ় অবস্থা। দরজা খুলে যায়। একজন প্রায় মধ্যবয়স্ক রমনী দরজার পাল্লা ধরে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকায়! খালা – সুহাদদের বাসা এটা তো? ত্রস্ততায় জামিলের গলা আটকে যায়।

হ্যা বাবা, তুমি তো এই বিল্ডিং এ থাকো, তাই না? জ্বি খালা, একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে। মোবাইলটা ধরিয়ে দেয় খালার হাতে। বলে, দেখেন তো এই ছবিটা সুহাদের কিনা? সুহাদের মা মোবাইলে ছবিটা দেখে অস্ফুট আর্তনাদ করে ওঠে। জামিলের হাত টেনে ঘরে ঢোকায়। দরজাটা বন্ধ করে ড্রইং রুমের মাঝখানে নিয়ে ব্রাঘ্য কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, কিভাবে পেলে সুহাদের ছবি? জামিল তখন ক্লিপটাও চালু করে দিচ্ছিল সুহাদের মায়ের হাতে রাখা মোবাইলে।

তালগোল লেগে যায়। ঘামতে থাকে, গলার স্বরে কাঁপে। বলে, খালা, একটা মেয়ে এক্সিডেন্ট করেছে আমাদের বিল্ডিং এর সামনে.... কিন্তু শেষ করতে পারে না...সুহাদের মা থামিয়ে দেয়..হাত ধরে বসিয়ে দেয় সোফায়। তারপরে বলে, আর বলতে হবে না বাবা..তুমি শান্ত হও! জামিল হা করে তাকিয়ে থাকে। সুহাদের মা পাশে বসে শাড়ির আচল দিয়ে চোখ মোছে।

বলে, সুহাদ যদি এই মোবাইলটা দেখে আবার পাগলামী শুরু করবে! কি বলছেন খালা? জামিল হতবিহবলতার মধ্যেও স্থির থাকতে পারে না। বলে, সুহাদকে একটু আগে রাস্তায় দেখা গেছে! একটা মেয়ে.....সুহাদকে ফোন.... জামিলের হাত আবার চেপে ধরে সুহাদের মা। বলে, আস্তে বলো বাবা, সুহাদ সারারাত ছটফট করে একটু আগে ঘুমিয়েছে, ওর বাইরে যাবার প্রশ্নই ওঠে না...ওকে বেধে রাখি আমরা..... জামিলের প্রলাপ মনে হতে থাকে। দাড়িয়ে বলে, খালা, আমি বোধহয় আপনাকে বোঝাতে পারছি না, সুহাদের ছবি আছে এই মোবাইলে মাত্র আধঘন্টা আগে তার ছবি তোলা হয়েছে... সুহাদের মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। জামিলের কথা তার মাথায় ঢোকে না।

দাড়িয়ে বলে, তুমি আমার সাথে আসো! জামিলের হাত ধরে পাশের রুমে নিয়ে যায়। খাটের উপরে ঘড়ঘড় নাক টানছে সুহাদ। জামিল চমকে ওঠে। মুখ ভর্তি দাড়ি। খাটের সাথে একটা শেকল।

পা বাধা মনে হচ্ছে। বিভ্রান্তের মত লাগছে জামিলকে। কিছু বলতে গেলেই সুহাদের মা তার মুখ চেপে ধরে। সুহাদের বেডরুমের দরজা বন্ধ করে তারপরে আবার তাকে ড্রইং রুমে নিয়ে আসে। বিধ্বস্তের মত সোফায় বসে পড়ে জামিল।

সুহাদের মা তার পাশে বসে মুখ খোলে। ওরা একজন আরেকজনকে প্রচন্ড ভালবাসতো, তোমরা যাকো বলো ডাইহার্ড লাভ! জামিল ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যায়। একবার বলার চেষ্টা করে, অতন্দ্রিলা-সুহাদ? হ্যা হ্যা, অতন্দ্রিলাই! হাসপাতালে নিয়ে গেছে....জামিল বলার চেষ্টা করে। হ্যা ..... কিন্তু .... কি আর করা, মাথা দুলায় হতাশায় দুইদিকে সুহাদের মা। তোমাকে প্রথম থেকে না বললে বুঝতে পারবে না।

সুহাদ আর অতন্দ্রীলার কাব্য বিলাস ছিল। চমৎকার সব কল্পনার বুনন থাকতো ওদের লেখায়। আমি বাংলার শিক্ষিকা...এখনও কাব্য পড়াই কিন্তু অতন্দ্রিলা ছিল জীবন্ত এক কাব্য...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.