আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জল পালকিতে দুটি রাত্রী

চলো আবার সবুজ গড়ি

এই পানির তেতো একটা গন্ধ আছে। আর নিচে তাকালেই কালো...। মনে হয় হাজার বছরের অন্ধকার জমাট বেধে আছে। অথচ এখানেই ছিলো এই শহরের প্রাণ। আপনি ঠিক ধরেছেন।

আমি বুড়িগঙ্গার কথাই বলছি। জীবনামৃত এই নদীর ঘাট থেকেই জলযান গুলো উড়াল দেয় প্রবাহমান স্রোত ধারায়। তেমনি একটি বিশাল লঞ্চে চড়ে যাচ্ছি আমার সেই ঠিকানায়। যেখানে বসবাস করেন আমার জীবন গড়ার কারিগর। মা।

লঞ্চটা ভালোই বলা যায়। আপনারা যারা বরিশালের লঞ্চে চড়েছেন তারা হয়তো জানেন এগুলো কতটা লম্বা হয়। আর তাছাড়া ভোলার লঞ্চ গুলো একটু বিলাস বহুল হয়। ভৌগলিক ভাবে এই অঞ্চলের মানুষেরা কিছুটা সৌখিন। গরীব হলে কি হবে? লঞ্চে উঠে দেখলাম চারিদিকে জনারন্য।

আমি কোথাও বসারও যায়গা পেলাম না। কোনো কেবিন খালি নেই। ডেকে বিছানা পেতে শুয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু জনতার চাপে ঐসব অঞ্চলেও কোনো ফাকা নেই। শেষমেশ পরিচিত একজন আঙ্কেলকে পেয়ে তার ব্যাগের পাশে ব্যাগ রেখে চলে গেলাম লঞ্চের সামনে।

এখান থেকে নদীর রূপটা অনেক উন্মুক্ত ভাবে উপভোগ করা যায়। তবে সে সময় এখনো আসেনি। কারন লঞ্চ ছাড়তে এখনো প্রায় আধ ঘন্টা বাকী আছে। অখানে একটা চেয়ার পাতা ছিলো। বসে বসে কুলি আর যাত্রীদের চলাফেরা দেখছি।

ভাবছি সবাই কত ব্যাস্ত নিজের গন্তব্যে পৌছুতে। একজন গ্রাম্য মাকে দেখছি তার শিশু সন্তান টিকে এমন ভাবে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন মনে হচ্ছে ওটা কোনো ফলের কার্টুন। অথবা মুড়ি বোঝাই একটা হালকা বস্তা। আবার ঝাল মুড়ি ওয়ালা তার হাতের প্লাস্টিকের গ্লাসটায় মুড়ি শর্ষে তেল কয়েক দানা বুট আর কিছু পেয়াজ মরিচ সাথে বাড়িথেকে তৈরী করে নিয়ে আসা ঝোল জাতিয় কিছু একটা এক চামুচ ঢেলে ভাল ভাবে ঝাকাচ্ছে। আর গোল হয়ে দাড়িয়ে কয়েক জন খদ্দের মুখের ভেতর ভেজা জিহবা নাড়া চাড়া করছে।

আমওয়ালা আড় চোখে চেয়ে ফাকে পোকা ওয়ালা আমও দিয়ে দিচ্ছে ক্রেতার নেটের প্যাকে। ক্রেতা টের ও পেলোনা। আমরা কবে এই সব অসততা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে পারবো? এই সব প্রশ্নের অজানা উত্তর গুলোকে জমা রেখে কাদামাটির শহর ছেড়ে আমাদের লঞ্চ ভেসে যায় বুড়ীগঙ্গার পটাশিয়াম সায়ানাইড মেশানো পানির বুক চিরে। আমাদের বিদায়ে আকাশের ফুপিয়ে কান্না শুনেছি। তার গুড়ি গুড়ি অশ্রুগুলো আমায় নিরবে ছুয়ে ছুয়ে যায়।

আমি বসে বসে দেখে যাই শহরের আলো পানিতে নৃত্যরত। সেই নৃত্যের মুদ্রায় বেদনার ছবি নিয়ে ভেষে উঠতে দেখেছি...শবনম আর ইয়াসমিন দের অসহায় চোখ। আমি অজানা ভাষায় বলি বোন আমাদের ক্ষমা করিস। আমরা আজো তোর স্বজাতির নিরাপত্তা দিতে পারিনি। এটা এখনো সে দেশের মত হয় নি যেদেশে হেযায থেকে মক্কায় নারীরা নিরাপদে রাত্রী ভ্রমনও করতে পারে নির্ভয়ে।

আমি সত্যই দেখি বুড়ীগঙ্গার নিকষ কালো বুকে ফুলে পচে ওঠা সেই সব লাশের আত্মাদেরকে যারা আমাদের পাপের কারনে লাশ হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলো আপন স্বজনদের বুক থেকে। সঠিক নিয়ম মেনে নৌযান তৈরি না করার কারনে ঘটিত দুর্ঘটনায় নিহত নারী আর শিশুদের অশরীরি কান্নায় আমার হৃদয়টা ভিজে ওঠে। আমি আর সহ্য করতে না পেরে উঠে চলে যাই। আঙ্কেলের ওখানে। উনি আমায় দেখে অবাক।

আরে তুমি লঞ্চে ছিলে? আমি বললাম জি চাচাজান। আমি ছিলাম। আমরাতো আরো ভেবেছি তুমি হয়তো লঞ্চে উঠতে পারনি। টেনশন করতে করতে শেষ। তোমার ব্যাগ রেখে গেলা।

এখানে যদি দামী কিছু থাকে তাহলে তো এটাকে রক্ষা করা মুশকিল হয়ে যাবে। আমি বললাম চাচাজান আমি গরীব মানুষ আমার ব্যাগে দামী কিছুই নাই। থাকলে কিছু দামী বই আছে। আমার কাছে এটাই সবচেয়ে দামী। উনি অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছিলেন।

বললেন এতক্ষন কোথায় ছিলে? সামনে বসে নদী দেখছিলাম। আমার কথা শুনে আমার সামনে যে কয়জন ছিলেন তারা হো হো করে হেসে দিলেন। তারা খুব অবাক হলেন বোধহয়। চাচা এমন ভাবে বললেন নদী দেখেছো?? মনে হলো এর মতো অর্থহীন কাজ আর বুঝি নেই। তার কাছে নদী দেখাটা কোনো কাজ না।

এটা একটা অকাজ বলা যায়। তার চেয়ে বসে বসে আল্লাহর জিকির করাটা অনেক গুরুত্ব পূর্ণ। কারন উনি তাবলিগের একজন মেহনতি কর্মী। তবে আমার অভিমত ভিন্ন। উনি যা মনে করেন সেটা অবশ্যই গুরুত্ত্ব পূর্ণ তবে যেহেতু আল্লাহর সকল সৃষ্টির মধ্যে জ্ঞানী ব্যাক্তিদের জন্য নিদর্শন সুতরাং সেই সব জিনিশ গুলো অবলোকন করতে তো হবে।

আর সেখানেই আমি খুজে বেড়াবো স্রষ্টার মহান অস্তিত্ত। তার অফুরন্ত অসাধারন সৃষ্টি শৈলী। আমি আবার গিয়ে লঞ্চের করিডোরে পাতা চেয়ারে বসি। আর জোছনার আগমনের অপেক্ষায় অপেক্ষিত কিঞ্চিত অপুর্ণ চাদের মাঝে তাকিয়ে। বৃষ্টির ক্ষুদে ক্কুদে জলকনারা আমায় এখনো ছাড়েনি।

ছলাত শব্দ আর মাঝিদের ছোট ছোট ছেলেদের অনুচ্চ চিতকার সাথে মেঘবৃষ্টির কিছুটা মিষ্টি অনুভুতি আর রাতের মোহনিয়তায় বিমুগধ আমি কতক্ষন যে ওখানে বসে ছিলাম তার হিসেব দেয়াটা অনেক কঠিন একটা কাজ মনে হচ্ছে। ফিরে এসে দেখি চাচাজানের পাশে একজন মধ্য বয়ষ্ক চিকনা চাকনা ভদ্রলোক চারজনের জায়গা একাই দখল করে শুয়ে আছেন। আমি কিছুটা রিকোয়েষ্ট করতেই ভালো মানুষের মতো এক হাত জায়গা আমার জন্য ছেড়ে দিলেন। যদিও তার ওপাশে আরো তিনজন মানুষ অনায়াসেই শুতে পারে এমন খালী যায়গা রয়েছে তবুও আমায় এতটুকু দিয়েছেন বলে তার শুকরিয়া আদায় করলাম। ঘুমিয়ে পরলাম।

রাত দুটোয় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কারন খুজতে গিয়ে বুঝলাম এতটুকু জায়গায় আমার শরীরটাকে ঠিক মত আটাতে পারছিলাম না। তার ওপাশে যে যায়গা আছে সেখানে ইচ্ছা করলে আমি শুতে পারি...কারন উনি ঘুমাচ্ছেন। তার পরও অনুমতি না নিয়ে শোয়া ঠিক হবেনা ভেবে আবার চলে যাই রাতের সৌন্দর্য অবলোকন করতে। বাকিটা রাত তারাদের সাথেই কাটিয়ে দেই... মায়ের আদর মাখা চুমু কপালে একে শুরু হয় আমার আর একটি দিন।

ছোট ভাই বোনদের সাথে গল্প করা, আমার প্রিয় সব খাবারের ঘ্রাণ, আর পিচ্চি ভাইটার সাথে গায় ঘসা ঘসি আর কাধে করে দৌড়াদৌড়ি করা, তাদের জন্য নিয়ে যাওয়া গিফট দেয়া। আম্মুর সাথে নানুবাড়ী বেড়াতে গিয়ে শুয়ে থাকা বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত নানাজান, পুকুরে মাছ ধরা অবস্থায় মামার সাথে দেখা করা, পিচ্চি বাবু আনাসকে নিয়ে ঘর সামলানো ছোট খালামনির ব্যাস্ততা কি খাওয়াবেন... আর সুপাড়ীর খোস ছাড়ানোর কাজে ব্যাস্ত কাজের লোকদের পরিচালনা রত মামীজান... পাশে নানার ভাইদের ঘরে বড় হয়ে যাওয়া আমার খেলার সাথীরা... আর ভালবাসা মেশানো গ্রামবাসীদের চাহনি এই সব পেড়িয়ে আবার ছুটে আসি সেই লৌহ নৌযানে। যে আমাকে সংযুক্ত করবে আপনাদের সাথে আর বিচ্ছিন্ন করবে আমার সেই প্রিয় খুকি...আমার আম্মীর কোল থেকে। যেখান থেকে লঞ্চ ছাড়ে এর নাম খেয়া ঘাট। সম্প্রতি এই খালে একটি ব্রীজ করা হয়েছে।

সন্ধ্যার চুড়ি যাওয়া আবছা আলো আধারীতে একটা একাকী নিশ্বঃঙ্গ নৌকাকে দেখেছি জেলের দুখ নিয়ে একাই দাড়ীয়ে আছে চুপচাপ। নামাজ আদয় করে বসে বসে নৈসর্গীক প্রকৃতি দেখছি। আসার সময় আম্মু আমাকে একটি ব্যাগে কয়েকটি বার্গার আর কলিজি দিয়ে বানানো সিঙ্গারা দিয়ে দেন। সবার সামনে খেতে লজ্জা লাগছে। কোথাও যায়গা না পেয়ে একদম ছাদে উঠে যাই।

বসে বসে জিহবায় অনুভব করি মায়ের আদর। এত্তো মজা... ভাবি আমার মা’ই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাধুনী। আজও কোনো যায়গা পাইনি পিঠ টাকে পাটাতনে লাগাবার। কি আর করার পরিচিত একজনের কাছে ব্যাগটা রেখে জায়নামাজটা বের করে ছাদে গিয়ে শুয়ে পরি। আকাশ নামক অদ্ভুত জিনিষটাকে খুব কাছে মনে হচ্ছিলো।

মনে হয় হাতটা বাড়ালেই ধরতে পারতাম। কিন্তু হাত বাড়ানোর সাহস করিনি। আমি এই অসুন্দর মানুষটা কিভাবে এত্তো সৌন্দর্যে ভরপুর এক জগত ছুইবো? আজও চাদের সাথে দেখা হয়ে গেলো। তবে আমাদের সাক্ষাতে মাঝে মাঝেই মেঘদের উপস্থিতিও ছিলো লক্ষ্যণীয়। অয়াদের ঝড়িয়ে যাওয়া হঠাত পশলা আমাকে মাঝে মাঝে এই স্থানটিও খোয়াবার ব্যাপারে ভীত করে তুলতো।

বৃষ্টী জোছনা আর তারাদের আদরে কখন যে ঘুমিয়ে পরি টের পাইনি। নাকে পরিচিত গন্ধ আমাকে বুঝিয়ে দেয় আমি এখন বুড়ীগঙ্গায় আছি। সবাই নাক চেপে আছে। আমি বেশ ভালো ভাবেই বসে আছি ছাদে। আমাকে নাক চাপতে হয়নি।

কারন আমি ভেবেছি আমাদের পাপের ফল আমাদেরকেই ভোগ করতে হবে। তবে আনন্দিত হতাম যদি ঐসব কারখানা মালিকদেরকে যদি এখানে একটি ঘর বানিয়ে বাধ্যতা মুলক এক সপ্তাহ অবস্থানের আইন করা হতো। খানেই গোসল খাওয়া ইনপুট আউটপুট ...সব। বুড়ীগঙ্গার কালো বিষাক্ত পানিতে গোসল করা ঐসব পিচ্চি পিচ্চি ছেলেমেয়েদের নিয়ে পাড়ে দাড়ীয়ে হাত তালী দিতাম। লাল বৃত্ত বিকাল4.17 09.07.09


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।