আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আকবরনামা -৪ (আকবরের চিঠি)

সুবহানাহু তায়া’লা ওয়ারাআল ওয়ারাই ছুম্মা ওয়ারাআল ওয়ারাই-জ্ঞান ও অনুভূতি যে পর্যন্ত পৌছে, আল্লাহতায়ালার জাতে পাক তার পরে, বরং তারও আরো পরে।

বাদশাহ্ জৈন সাধুদের দ্বারাও যথেষ্ট প্রভাবাম্বিত হইয়াছিলেন। সাধু সঙ্গ লাভের পর হইতে তাঁহার নিকট সবসময় এমন কি ভ্রমণের সময়ও একজন জৈন সাধু থাকিত। হির বিজয় সূরী নামক এক সাধুকে তিনি ‘জগৎগুরু’ উপাধি দিয়াছিলেন। নন্দা বিজয় সূরী নামক একজন সাধুকে তিনি ‘খশফহম’ উপাধি দিয়াছিলেন।

হির বিজয় সূরীকে খুশী করিবার জন্য তিনি ধর্মপর্ব ‘পর্যুষণে’ বার দিন জীব হত্যা নিষিদ্ধ করিবার ফরমান জারী করিয়াছিলেন। জৈন ধর্ম অনুযায়ী বাদশাহ্ নিজেও মাংস আহার করা ছাড়িয়া দিয়াছিলেন। এই বিষয়ে বাদশাহ্ স্বয়ং সূরীজিকে এক পত্র প্রেরণ করেন। উহাতে তিনি সূরীজি কর্তৃক কিরূপ প্রভাবাম্বিত হন তাহার পরিচয় পাওয়া যায়। পত্রটি নিম্নরূপbr /> ‘আমি আপনার উপদেশ অনুযায়ী সম্পূর্ণরূপে জীবহিংসা পরিত্যাগ করিতে পারি নাই।

তবে আমি আগের চেয়ে এখন অনেক কম মাংস আহার করি। আপনি হয়তো জানেন যে, আমি ফতেহপুর হইতে আজমীর পর্যন্ত রাজপথের পার্শ্বে প্রতি এক ক্রোশ পর পর একশত চৌদ্দটি স্তম্ভ নির্মাণ করিয়াছি। ঐগুলি প্রায় ছত্রিশ হাজার হরিণের শিং দিয়া সজ্জিত করিয়াছি। ঐগুলি আমি নিজ হাতে শিকার করিয়াছিলাম। আমি এত জীবের প্রাণ সংহার করিয়াছি।

আমার মতো পাপী কেহ নাই। ইহা ছাড়া প্রতিদিন নানা প্রকার জীবের মাংসসহ পাঁচশত চড়াই পাখীর জিহ্বা দ্বারা উদর পূর্তি করিতাম। ঐ কথা ভাবিতে গেলেও এখন আমি আতংকিত হইয়া উঠি। আপনার শ্রীমুখের অমিয়বাণী আমাকে মাংসাহারে অরুচি আনিয়া দিয়াছে। এখন বৎসরে ছয় মাস বা ততোধিক সময় আমি মাংস আহার করি না।

’ অগ্নিপূজকদের দ্বারাও বাদশাহ্ যথেষ্ট প্রভাবাম্বিত হইয়াছিলেন। তাহার আদেশে দরবারের সম্মুখে সর্বক্ষণ অগ্নির প্রজ্জ্বলন করিবার ব্যবস্থা করা হয়। ঘণ্টাধ্বনি প্রভৃতি গ্রহণ করা হয় খৃষ্টানদের নিকট হইতে। মোটকথা কেবল মাত্র ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মই বাদশাহর চোখে সুন্দর মনে হইত। তাঁহার চোখে সর্বাপেক্ষা সুন্দর মনে হইত হিন্দুধর্ম।

তাই তাহার নতুন ধর্ম দ্বীন-ই-ইলাহীর বেশীর ভাগ উপাদানই গৃহীত হইয়াছিল হিন্দুধর্ম হইতে এবং সঙ্গত কারণেই হিন্দু ও রাজপুতদের নিকটই এই অদ্ভুত ধর্ম সমাদর লাভ করিয়াছিল সব চাইতে বেশী। সম্ভবতঃ বাদশাহ্ আকবরও ইহাই কামনা করিয়াছিলেন। দ্বীন-ই-ইলাহীর মূলমন্ত্র ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আকবারু খলিফাতুল্লাহ! যাহারা ধর্মে দাখিল হইত তাহাদিগকে এইরূপ শপথ বাক্য উচ্চারণ করিতে হইতঃ- ‘আমি অমুকের পুত্র অমুক এতদিন বাপ-দাদাদের অনুকরণে ইসলাম ধর্মের উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিলাম এখন স্বেচ্ছায় ও সজ্ঞানে পূর্ব ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া দ্বীন-ই-ইলাহী গ্রহণ করিতেছি এবং এই ধর্মের জন্য জীবন, সম্পদ ও সম্মান বিসর্জন দিতে প্রস্তুত আছি। ’ দ্বীন-ই-ইলাহীর অনুসারীরা চিঠিপত্রের শিরনামায় ‘আল্লাহু আকবর’ লিখিত এবং পরস্পরের সাক্ষাতের সময় সালামের পরিবর্তে একজন বলিত ‘আল্লাহু আকবর’ এবং অপরজন বলিত ‘জাল্লা জালালুহু’। বাদশাহ্ তাহাদিগকে শিজরা স্বরূপ একখানি প্রতিকৃতি প্রদান করিতেন।

তাহারা বাদশাহর এই প্রতিকৃতিটি পরম শ্রদ্ধাভরে নিজ নিজ পাগড়ীতে বসাইয়া রাখিত। বাদশাহ্ যে সব পূজাপার্বণ করিতেন অনুসারীগণকেও সেই সব করিতে হইত। উপরন্তু তাহাদেরকে বাদশাহ্কে সেজদাও করিতে হইত। ভণ্ড সুফীদের সর্দার তাজুল আরেফিন বাদশাহ্কে সেজদা করা ওয়াজেব বলিয়া ফতোয়া দান করেন। এই সেজদার নামকরণ করা হয় ‘জমিন বোছ।

’ তিনি বলেন, বাদশাহর প্রতি আদব প্রদর্শন করা ফরজে আইন এবং তাহার চেহারা কেবলায়ে হাজত ও কাবায়ে মুরাদ। কতকগুলি দুর্বল রেওয়ায়েত এবং হিন্দুস্থানের ভ্রষ্ট সুফীদের কার্যপ্রণালী দলিলরূপে খাড়া করিয়া তিনি ইহার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। সাধারণ ব্যক্তি ছাড়াও বিশিষ্ট আলেমগণও এই শেরেকি কার্যে অভ্যস্ত ছিলেন। তাহারাও বাদশাহকে সেজদা করিতেন। সেজদাই ছিল শাহী দরবারের প্রধান আদব।

এই নতুন ধর্মে সুদ ও জুয়া ছিল হালাল। খাছ দরবারে জুয়া খেলার জন্য একটি ঘর নির্মাণ করা হয় এবং জুয়াড়ীদিগকে রাজকোষ হইতে সুদি কর্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মদ্যপান করা হালাল সাব্যস্ত করা হয়। বাদশাহ্ স্বয়ং দরবারের নিকটে একটি শরাবখানা খুলিয়া দেন। নওরোজ অনুষ্ঠানে অধিকাংশ আলেম, কাজী ও মুফতিগণকে শরাব পান করিতে বাধ্য করা হইত।

এই সব অনুষ্ঠানে বিভিনড়ব লোকের নামে পেয়ালা নির্বাচিত হইত। ফৈজি বলিতেন, ‘আমি এই পেয়ালাটি পান করিতেছি ফকিহদের অন্ধ বিশ্বাসের নামে। ’ এই ধর্মে দাড়ি মুণ্ডনের ব্যাপারে অত্যধিক গুরুত্ব দেওয়া হইত। বাদশাহ্ এই ব্যাপারে রাজপুত পতড়বীদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হন। নাপাকীর জন্য গোসল করা ইসলামে ফরজ।

কিন্তু বাদশাহ্ আকবরের ধর্মে ইহার বিপরীত মত প্রকাশ করা হয়। বলা হয় যে, ‘মনী’ উৎকৃষ্ট মানুষ সৃষ্টির বীজ। তাই গোসল করিয়া সহবাস করাই উত্তম। ইহা ছাড়া বিবাহ সম্পর্কে আইন করা হয় কেহ তাহার চাচাত, মামাত, ফুফাত ইত্যাদি সম্পর্কের বোনকে বিবাহ করিতে পারিবে না। ষোল বৎসর বয়সের পূর্বে বালক এবং চৌদ্দ বৎসর বয়সের পূর্বে বালিকাদের বিবাহ দেওয়া চলিবে না এবং কেহ একাধিক বিবাহ করিতে পারিবে না।

যুবতী নারীদের বাধ্যতামূলকভাবে চেহারা খোলা রাখিয়া পথ চলা ছিল এই নতুন ধর্মের আইন। ব্যাভিচারও ছিল আইন সঙ্গত। সেই জন্য শহরের বাহিরে পতিতাদের বসতি স্থাপন করা হয় এবং এই সবের নাম দেওয়া হয় ‘শয়তানপুর’। এই সব স্থানে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়। বার বৎসর বয়সের পূর্বে বালকদের খৎনা করা ছিল নিষিদ্ধ।

খৎনারূপ সুনড়বতকে মিটাইয়া দিবার জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইয়াছিল। মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে এই বিধান জারী হয় যে এই ধর্মাবলম্বী কোন লোকের মৃত্যু হইলে তাহার গলায় কাঁচা গম ও পাকা ইট বাঁধিয়া তাহাকে পানিতে নিক্ষেপ করিতে হইবে এবং যেখানে পানি পাওয়া যাইবে না সেখানে মৃতদেহ জ্বালাইয়া দিতে হইবে অথবা পূর্ব দিকে মাথা ও পশ্চিম দিকে পা করিয়া দাফন করিতে হইবে। একদিন আবুল ফজল বাদশাহ্কে একখানি কেতাব দেখাইয়া বলিলেন, ‘আপনার জন্য ইহা ফেরেশতা আসমান হইতে আনিয়াছে। ’ সেই কেতাবের একস্থানে একটি আরবী বাক্য লিখিত ছিল যাহার অর্থ এইরূপঃ ‘হে মানুষ তুমি গাভী হত্যা করিও না। যদি কর তবে জাহানড়বামে প্রবিষ্ট হইবে।

’ নিরর বাদশাহ্ ইহা বিশ্বাস করিলেন এবং গরু জবেহ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করিলেন। কানুন জারী করিলেন, কসাই এর সহিত কেহ আহার করিলে তাহার হাত কাটিয়া দেওয়া হইবে। এমনকি তাহার স্ত্রীও যদি তাহার সহিত আহার করে তবে তাহার আঙ্গুল কাটিয়া দিতে হইবে। এই নতুন ধর্মে গরু, উট, ভেড়া প্রভৃতি জানোয়ারের গোশ্ত হারাম বলিয়া ঘোষিত হয়। পক্ষান্তরে বাঘ ভালুকের গোশ্ত হালালের মর্যাদা লাভ করে।

মোট কথা সর্বক্ষেত্রে ইসলামের বিরোধিতা করাই ছিল দ্বীন-ই-ইলাহীর মূল উদ্দেশ্য। (যারা ইতিহাস পড়তে ভালবাসেন তাদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ রচিত খ,ম, আমানুল্লাহ কর্তৃক প্রকাশিত হজরত মোজাদ্দেদে আলফে সানি রহঃ -এর অবিস্মরণীয় জীবন কথা ‘নূরে সেরহিন্দ’ গ্রন্থ হতে চয়িত অংশ বিশেষঃ) সেরহিন্দ প্রকাশন , ৩৮/২-ক, বাংলাবাজার, ঢাকা-১১০০।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।