আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাও বনাম ‘মাওবাদ’

সাংবাদিক

মাও বনাম ‘মাওবাদ’ শান্তনু দে কিউবাও এদের কাছে ‘রিভিসনিস্ট’। ঘোর সংশোধনবাদী। ‘সমাজতন্ত্র, না হয় মৃত্যু’ — তামাম দুনিয়ার মানুষের কাছে কিউবা যখন সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে ধ্রুবতারা, এরা তখন কিউবার থেকে কিছু শেখার আছে বলে মনেই করে না। শুধু তাই নয়, কিউবা বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে দলে কোনওরকম চর্চায় রীতিমতো নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এই মৌলবাদী মাওবাদীরা। ফিদেল, চে’র নাম উচ্চারনে পর্যন্ত রয়েছে নিষেধাজ্ঞা।

চীনের পার্টির ঝউ এন লাই, চু তে, কিংবা ভিয়েতনামের হো চি মিন, গিয়াপের থেকে কিছু শিক্ষণীয় নেই বলে মনে করে জনযুদ্ধের এই ফেরিওয়ালারা। ব্রাজিলের কমিউনিস্ট পার্টির আতিথ্যে গতবছর নভেম্বর মাসে সাও পাওলোতে দুনিয়ার যে ৬৫টি কমিউনিস্ট ও ওয়ার্কার্স পার্টি মিলিত হয়েছিল, এদের মতে, এরা কেউ কমিউনিস্ট পার্টি নয়। সবাই সোস্যাল ডেমোক্র্যাট, সংশোধনবাদী, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী। আর সি পি আই (এম) সামাজিক ফ্যাসিবাদী। পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার কোন্‌ ছাড়, এরা চীন, ভিয়েতনাম, গণতান্ত্রিক কোরিয়াকে আদৌ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে মনে করে না।

এদের চোখে, সর্বত্র পুঁজিবাদের রমরমা। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও পূর্ব ইউরোপের বিপর্যয়কে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ তথা ‘অতিবৃহৎ শক্তির’ পতন হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এরা উদ্বাহু নৃত্য করে। সর্বশেষ নবম কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাবের ‘অন্যান্য এমুহূর্তের কর্তব্যে’ এদের আহ্বান, ‘সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে, বিশেষ করে চীন, ভিয়েতনাম, গণতান্ত্রিক কোরিয়া ও কিউবায়, (মাওবাদীদের মতে, এই চারটি দেশও এখন ‘সাবেক’ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র) যেখানে আধুনিক সংশোধনবাদীরা ক্ষমতায়, সেখানে পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কারণগুলি সম্পর্কে জনগনকে সর্বোতভাবে শিক্ষিত করতে হবে। খুলে দিতে হবে তাদের মুখোশ। এবং এজন্য দুনিয়ার জনগণের বিপ্লবী সচেতনতা ও নজরদারি বাড়িয়ে তুলতে হবে।

এক্ষেত্রে, বিশেষত চীনের সংশোধনবাদী, যারা নিয়ে এসেছে ‘চীনের বৈশিষ্ঠ্য অনুযায়ী মার্কসবাদের’ স্লোগান, তাদেরকে বেআব্রু করে দিতে হবে। ’ তাই শুধু কিউবা নয়, বর্তমান দুনিয়াতে কোনও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র আছে বলেই এরা মনে করে না। আর এভাবেই পরোক্ষে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একমেরু বিশ্বের তত্ত্বকে মেনে নিচ্ছে এই আগমার্কা বিপ্লবীরা। নভেম্বর বিপ্লবের পর সাম্রাজ্যবাদ থেকে সমাজতন্ত্রের অভিমুখে যে নতুন যুগের সূচনা, সেই যুগের কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব — সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতন্ত্রকে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়ে নস্যাৎ করতে চাইছে যুগের মূল বৈশিষ্ট্যকেই। চুলোয় যাক সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ।

এরা একান্তে নীরবে নিভৃতে প্রতিবিপ্লবী সন্ত্রাসবাদ চর্চার জন্য বেছে নিয়েছেন অখন্ড অবসর। ভারতীয় বিপ্লব যে বিশ্ব বিপ্লবের অংশ, সেকথা বেমালুম খারিজ করে দিয়ে এদের মতে, প্রধান দ্বন্দ্ব চারটি। (এক) সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে ভারতীয় জনগণের দ্বন্দ্ব (দুই) সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে ব্যাপক জনগণের দ্বন্দ্ব (তিন) পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব এবং (চার) শাসক শ্রেণীর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। এরমধ্যে প্রথম দু’টি হলো মৌলিক দ্বন্দ্ব। যারমধ্যে দ্বিতীয়টি মুখ্য দ্বন্দ্ব।

আমাদের তাই প্রবল প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে হবে, সাম্রাজ্যবাদের তীব্র আগ্রাসন সত্ত্বেও টিকে আছে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদকে। তুলে ধরছে সমাজতান্ত্রিক শ্রেষ্ঠত্ব। সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ বনাম নিপীড়িত মানুষের দ্বন্দ্ব, পুঁজিবাদী দেশগুলিতে পুঁজিপতি ও শ্রমিকশ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের দ্বন্দ্ব — চারটিই ক্রিয়াশীল। এখন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির দ্বন্দ্বের তীব্রতা বাড়ছে।

মার্কসবাদীদের কাছে ‘ইজম’ বা মতবাদ একটি মতাদর্শগত নির্মাণ — যা তত্ত্ব ও প্রয়োগ উভয়েরই ভিত্তি। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ‘স্তালিনবাদ’ বা ‘মাওবাদ’ বলে কিছু হয় না। এটা ঠিক, বিশ শতকের মহত্তম বিপ্লবী নেতাদের অন্যতম মাও জে দঙ। তাঁর নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের জনগন একটি পিছিয়ে পড়া দেশে গনতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কাজ শুরু করে। মাওয়ের ঐতিহাসিক ভূমিকা, তত্ত্ব ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর মহার্ঘ অবদান থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহন করেছে দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলন।

কিন্তু মাওবাদ কী ? ধারনা হিসেবে ‘মাওবাদ’ একটি আপাদমস্তক ভ্রান্ত বা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ধারনা। ভ্রান্ত কেননা, তাতে মাওয়ের তত্ত্ব ও প্রয়োগধারাকে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের চিরায়ত ও বিকাশমান ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করার কাজই সাধিত হয়। তাছাড়া, উদ্দেশ্যপ্রনোদিতভাবে ‘মাওবাদ’ শব্দটি আগেই ব্যবহৃত হয়েছে কট্টর মাও-বিরোধী, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি-বিরোধী তাত্ত্বিকদের হাতে। স্তালিন বলেছিলেন, ‘লেনিনবাদ সম্রাজ্যবাদ ও সর্বহারার বিপ্লবের যুগের মার্কসবাদ’। যুগ একটিই, যুগের প্রেক্ষাপটে লেনিনের সুনির্দিষ্ট দার্শনিক ও প্রয়োগের অবদানের ভিত্তিতে ‘লেনিনবাদ’ শব্দের সৃষ্টি।

তাই সম্রাজ্যবাদ যতক্ষণ পর্যন্ত ধনতন্ত্রের শেষ পর্যায়, ততক্ষণ নতুন ‘বাদের’ সম্ভাবানা নেই। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কোনওদিনই , মাওয়ের জীবদ্দশায় কিংবা তাঁর মৃত্যুর পরে কখনও ‘মাওবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করে নি। এমনকী পার্টির নবম কংগ্রেসে (এপ্রিল, ১৯৬৯)-ও নয়, যাকে ভারতের নকশালপন্থী ধারার ও তথাকথিত ‘মাওবাদী’ ধারার পার্টি ও গোষ্ঠীগুলির উল্লেখযোগ্য অংশ পথপ্রদর্শক হিসেবে মানে। সি পি সি বরাবর বলেছে ‘মাও জে দঙ চিন্তাধারা’। মাও জে দঙ থট।

মাওবাদ নয়। নবম কংগ্রেস, যা লিন বিয়াও কংগ্রেস নামে পরিচিত, তাতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ কর্মসূচীতে বলা হয়েছিল, ‘চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও জে দঙ চিন্তাধারাকে তার চিন্তার নির্দেশক ও তাত্ত্বিক ভিত্তি বলে মনে করে’। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি বলেছে ‘চীনের বিপ্লবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রয়োগ ও বিকাশই মাও জে দঙ চিন্তাধারা। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বজনীন সত্যকে চীনের বিপ্লবের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগের সঙ্গে সমন্বয় ঘটানোরই তা ফসল’। সি পি সি বলেছে, ‘মাও জে দঙ চিন্তাধারা হলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বজনীন নীতিগুলির সঙ্গে চীনের বিপ্লবের সুনির্দিষ্ট প্রয়োগের সংযুক্তি’।

স্পষ্টতই চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মাও জে দঙ চিন্তাধারাকে সর্বজনীন ভাবার বিরুদ্ধে। অথচ, মাওবাদীরা সেটাই করে বসেন। এরা প্রাক্‌ চীন বিপ্লবের পরিস্হিতিকে নিজের দেশের বর্তমান বাস্তবতায় চাপিয়ে দেয়। বিপ্লবী তত্ত্বগুলিকে আওড়ে যায় ধর্মীয় আমলার মতো। আদ্যোপান্ত নকল করতে চায় বিপ্লবী পথকে।

যেমন নকশালপন্থীরা একসময় শ্রীকাকুলামের অভ্যুত্থাণের তুলনা টেনেছিলেন ইয়েনানের সঙ্গে। ১৯৭০এ কলকাতায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আক্রমণের তুলনা টেনেছিলেন ১৯১৯ সালের ৪মে চীনের ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে। শ্রেণীশত্রু খতম অভিযানের তুলনা টেনেছিলেন চীন-জাপান যুদ্ধের সময় চীনের কমিউনিস্ট পার্টির খতম অভিযানের সঙ্গে। এরাও তাই। চীনের প্রাক্‌বিপ্লবী পরিস্থিতির মিল খুঁজে বার করে সিদ্ধান্ত নেয়, ‘এভাবেই আমাদের বিপ্লব অনুসরণ করবে চীন বিপ্লবের পথ।

’ অথচ, বিপ্লবের তত্ত্ব প্রয়োগের নামে এই টুকলিকে ঘৃণা করতেন মাও নিজে। মাও বলেছেন, বিপ্লব রপ্তানি করা যায় না। মাও নিজে বলেছেন, যে পার্টি নিজের দেশের বিকাশমান পরিস্থতির বিশ্লেষণ করতে পারে না, তার বদলে অন্য দেশের অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ ছাড়া নকল করার চেষ্টা করে (মাওবাদীরা যা করছে), তারা আদতে ‘সংশোধনবাদ ও সঙ্কীর্ণতাবাদের এক গোজামিল, সেই পার্টিকে মার্কসবাদ-লেনিনিবাদের দ্বারা পরিচালিত বলে গণ্য করা যায় না। ’ নিজস্ব ভঙ্গীতে মাও এজাতীয় প্রবনতা তুলনা টেনেছিলেন, ‘চোখ বন্ধ করে চড়ুই ধরতে যাওয়ার’ সঙ্গে। ‘বামপন্থী কমিউনিজম ও শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলা’ গ্রন্থে লেনিন এদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘পুঁজিবাদের বিভীষিকায় ‘উন্মত্ত’ পেটি বুর্জোয়া একটি সামাজিক সত্য — নৈরাজ্যবাদের মতোই এটি সমস্ত পুঁজিবাদী দেশসমূহের বৈশিষ্ঠ্য।

এই বিপ্লবীদের অস্থিরতা, বন্ধ্যাত্ব, অতিদ্রুত আত্মসমর্পণ, নির্লিপ্ততা বা আকাশকুসুম রচনায় পরিণত হওয়ার সম্ভবনা, এমনকি (এই বিপ্লবীদের পক্ষে) কোন না কোন বুর্জোয়া খেয়াল নিয়ে ‘পাগলের মতো’ মাতামাতি — এসবই সকলের জানা কথা। ’ থাকলে ভালো হতো, তবে বিপ্লবে কোনও শর্টকাট পথ নেই। অধৈর্য, অবাস্তব, কল্পনাবিলাসী, চটকদার বুলি আওড়াতে অভ্যস্তদের কোনও জায়গা নেই। কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ বহুদিন আগে এব্যাপারে আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘পথের শেষে পৌঁছাতে হলে সমস্ত পথ পার হয়ে যেতে হবে। মধ্যপথে পথ সংক্ষেপ করে গন্তব্য স্থলে পৌঁছনো অসম্ভব।

হটকারীরা তাই করতে চান। সংগ্রাম করার ধৈর্য ও একাগ্রতা তাঁদের নেই। তাঁদের লক্ষ্য সস্তার বাজিমাত। ’ তাহলে পথ কী? ‘সুকঠোর শ্রেণী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে এগিয়ে গিয়েই শ্রমজীবী জনগণ একদিন দেশে ক্ষমতা দখল করবেন। হটকারিতার পথ বিপ্লবের পথ নয়, ক্ষমতা দখলের পথও তা নয়।

হটকারিতা জনগণকে দুঃখ-দুর্ভোগের অতল সাগরে ডুবিয়ে দেয়। ’ এটিই কাকবাবুর শিক্ষা। ১৯৬৭র ২রা জুলাই। রবিবার। গণশক্তি’র সান্ধ্য দৈনিকে কমরেড মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ স্বাক্ষরিত প্রথম সম্পাদকীয় — ‘কমিউনিস্ট পার্টির পথ হটকারিতার পথ নয়’।

কাকাবাবুর প্রত্যয়, ‘যত দুঃখ হোক, যত কষ্ট হোক, যত কাঁটা বিছানোই হোক না কেন আমাদের পথ — আমরা বিপ্লবের পথ ধরেই চলব। হটকারীরা আর যাই কিছু হোক না কেন, তাঁরা বিপ্লব বিরোধী। ’


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।