আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনের কথা বলুন কবি, মানুষের কথা বলুন

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!

বাল্মিকী নামে একজন হিন্দু সাধু রামায়ন রচনা করেছিলেন। রামায়নের রাম হিন্দুদের অবতার। হিন্দুরা তাঁকে ভগবান বিষ্ণুর মানবরূপ হিসেবে মানে। বাল্মিকীর রামায়ন সংস্কৃত ভাষায় রচিত। সংস্কৃত কুলীন ও পন্ডিতদের ভাষা।

সাধারণ মানুষ এ ভাষার ব্যবহার করতনা, জানতনা। যা সাধারণের নয় তা টিকে থাকেনা- পৃথিবীর অবধারিত এই নিয়ম অনুসারে একদিন সংস্কৃত বিলুপ্ত হয়। সংস্কৃতের সাথে বিলুপ্ত হওয়ার কথা ছিল মহাকবি বাল্মিকী, তাঁর রামায়ন এবং একই সাথে ভগবানেরও। কিন্তু তা হয়নি। কারণ ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষার কবিরা এটিকে নিজের ভাষায় রূপান্তর করে নিয়েছিলেন।

বাংলায় এর অনুবাদ করেছিলেন মহাকবি কৃত্তিবাস। কৃত্তিবাসের রামায়ন এতোটাই জনপ্রিয় ছিল যে তাঁর জীবিতাবস্থায়ই এর চরণগুলো লোকের মুখে মুখে ফিরত। তাই একদৃষ্টিতে বলা চলে মহাকবি কৃত্তিবাস রামায়নকে কুলীনদের ভাষার খোলস থেকে মুক্ত করে সাধারণের করেছিলেন বলে এই বাংলায় রামায়ন টিকে আছে, একই সাথে টিকে আছেন স্বয়ং ভগবান। আজকাল বাংলা কবিতাগুলোকে বাল্মিকীর সংস্কৃত রামায়নের মতোই মনে হয়। অতিমাত্রায় দুর্বোধ্য, নিশ্চিত দুর্ভেদ্য।

সত্যিকার অর্থেই কবিতাগুলোকে দেখলে মনে হয় কোন সুরক্ষিত দুর্গ বা ক্যান্টনম্যান্টের মতো। সাধারণের প্রবেশ নিষেধ এখানে। ক্যান্টনমেন্টের নীল রক্তের প্রাণীগুলো যেমন নিজেদের অন্যের চেয়ে আলাদা ভাবেন, নিজের সিদ্ধান্ত, নীতি, বিচার-আচার নিজেরাই করে থাকেন তেমনি কবিতাগুলোকে দেখলে মনে হয় এগুলো শুধুই কবির নিজের বা নিজের গন্ডির জন্য। কবিতার পাঠক কবি। কবিতার সমালোচকও কবি।

কলেজে পড়ার সময়ে আমার এক শিক্ষক বর্তমানের বাংলা কবিতাগুলোর একটি নমুনা দেখিয়েছিলেন। বাংলা ডিকশনারীর কিছু কঠিন ও দাতভাংগা শব্দ ব্লাকবোর্ডে লিখে লেখার উভয় পাশ থেকে দু' ইঞ্চি পরিমাণ ডাস্টার দিয়ে মুছে তিনি বলেছিলেন এটাই আধুনীক বাংলা কবিতা। আধুনীক বাংলা কবিতার যে নমুনা তিনি উপস্থাপন করেছেন তাঁর সাথে হয়তো অনেকেই একমত হবেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি কবিতা অতোটা সহজে লেখা যায় বলে বিশ্বাস করিনা। কবিতা অবশ্যই সাধনার বিষয়।

কবি নিঃসন্দেহে একজন সাধক। তবে বর্তমানে এই সাধকের সাধনার বিষয়ের প্রকাশ ও বিকাশ এতোটাই দুর্ভেদ্য যে সাধারণের পক্ষে সে দেয়াল ভেদ করা সম্ভব নয়। আধুনীক কবিতা অতিমাত্রায় রূপক। অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করি অতিমাত্রার এই রূপকতা কবিতাকে অতি কঠিন এবং সাধারণের ধরাছোয়ার বাইরে নিয়ে গেছে। আর আধুনীক কবিতায় রূপকতার একটি প্রভাবশালী উপাদান হচ্ছে নারী।

রূপক হিসেবে ব্যবহারের জন্য পৃথিবীতে অনেক উপাদান বিদ্যমান থাকলেও বর্তমানের কবিরা কেন বেশিরভাগক্ষেত্রেই নারী অঙ্গের স্পর্শকাতর অংশগুলোকে বেছে নিচ্ছেন তা আমার বোধগম্য নয়। অনেকে বলেন এটা শিল্প, অশ্লীলতা বা বিকৃতি নয়। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে মনে হয় আমাদের সামাজিক বিকৃতির ক্রমবর্ধমান ধারাটি বোধ হয় ইতোমধ্যেই কবির মননের সীমা পর্যন্ত পৌছে গেছে। কবিতায় রূপকতা বা শিল্পের নামে নারী অঙ্গের এই প্রকাশ আসলে আমাদের সামাজিক বিকৃতিরই কাব্যিক বহিঃপ্রকাশ। কবিতা বাংলাসাহিত্যের অন্যতম প্রাচীন এবং অন্তত উনিশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সবচেয়ে জনপ্রিয় শাখা।

চর্যাপদের কবি কাহ্নপা থেকে শুরু করে চন্ডীদাস, শাহ মুহম্মদ সগীর, আলাওল, ঈশ্বরচন্দ্র চন্দ্র গুপ্ত, মাইকেল মধুসূধন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস কিংবা হালের শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, আল মাহমুদ সহ হাজারো কবি তাদের অবিনাশী সৃষ্টি দিয়ে সাহিত্যের এই শাখাটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাদের কবিতাগুলোতে জীবনের উচ্ছাস ছিল, গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের যন্ত্রণা ছিল, না পাওয়ার বেদনা ছিল, আশার কথা ছিল, ছিল ছোট ছোট সুখ-দুঃখের বর্ণনা। দেশপ্রেম ছিল, সংগ্রামী চেতনা ছিল, ছিল শোষকের বিরুদ্ধে লড়ার অবিনাশী মন্ত্র। সেই কবে ‍'অন্ধবধু' নামে একটা কবিতা পড়েছিলাম। গ্রামের একজন অন্ধনারীর আকুলতা এবং মনোযন্ত্রণার যে ছোয়া আমি তাতে পেয়েছিলাম তার উপস্থিতি এখনো টের পাই।

কবিতাটির প্রতিটি লাইন এখনও আমার মনে পড়ে, হৃদয় ছুয়ে যায়। নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাগুলো এখনও আমার নেতিয়ে পড়া ধমনীকে নতুন রক্তের স্রোতে ভাসিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের ছোটনদী কবিতাটি এখনও যখন নিজের অজান্তে আবৃত্তি করি তখন মনে হয় এ যেন আমার গ্রামেরই চিরন্তন বর্ণন, যা আমি ফেলে এসেছি এবং যেখানে আমি আর কোনদিন ফিরে যাব না। জন্মস্থানের সাথে আমার বিচ্ছেদ আমাকে রক্তাক্ত করে। কেউ হয়তো হেসে বলবেন এটাতো শিশুদের জন্য লেখা।

এটা কেন আপনাকে এতো আবেগতাড়িত করে। হ্যা, এটা শিশুদের কবিতা। আমার কাছে তাই সর্বোচ্চ যা আপনার শিশুস্বত্তা-কে জাগ্রত করে। কারণ কেবলমাত্রই সে সময়টাতেই আপনি নিষ্পাপ ছিলেন। জাগতিক কোন দ্বন্দ্ব বা পাপ আপনাকে স্পর্শ করেনি।

ঠিক ঐ সময়টাতে যে লেখা আপনাকে ফিরিয়ে নিতে পারে অর্থাৎ আপনার নিষ্পাপ স্বত্ত্বাকে যে জাগিয়ে তুলতে পারে তাইতো সত্যিকারের শ্রেষ্ঠ লেখা। কিন্তু কবিতায় মানুষের ভাবাবেগের উপস্থাপনের বিষয়টি এখন গৌণ। কবি এখন কবিতা সাজান ডিকশনারী খুঁজে বের করা কঠিন শব্দমালা দিয়ে। কাউকে বুঝানো বা প্রণোদিত করার কোন প্রচেষ্টা তাঁর নেই। তিনি অভিজাত, তিনি কুলীন।

জনসাধারণের স্পর্শ তার আরাধ্য নয়। স্বৈরাচারী এরশাদ ক্ষমতা থাকাকালীন সময়ে শামসুর রাহমানের লেখা, '‍অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ' কবিতাটির পর অন্তত এই বাংলার কবিদের কাছ থেকে আমি এমন কোন কবিতা পাইনি যাতে মানুষেরে আবেগের বিষয়টি স্থান পেয়েছে, মানুষকে প্রণোদিত করেছে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলেছে। হ্যা, এটা হয়তো সত্যি যে, কবি এখনও তাঁর কবিতায় নাগরিক যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলেন। তবে এর উপস্থাপন এতোটাই কঠিন এবং কুলীন যে, একমাত্র কবি ব্যতিত অন্য কারো তাকে নিয়ন্ত্রণে আনার সামর্থ্য নেই। কবিতার ভাব, উদ্দেশ্য তাই এখন সাধারণের ভাব নয়।

কবি বা কবিতা কেউই এখন সাধারণের নন। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, যা অতিমাত্রায় কুলীন, যা বাস্তবতা এবং সাধারণের মতকে অবজ্ঞা করে তা নিশ্চিহ্ন বা বিলুপ্ত হতে বাধ্য। সংস্কৃতের মতো কুলীন ভাষা পৃথিবী থেকে মুছে গেছে। কারণ তা সাধারণের উপযোগী ছিলনা। ভয় হয় ঠিক একই কারণে হয়তো একদিন কবিতা বা কবি সম্প্রদায়েরও বিলুপ্তি হবে।

আমার ধারণা এ বিষয়ে অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন। কবিতার একজন একনিষ্ট ভক্ত এবং পাঠক হিসেবে এই চিন্তাটা আমাকে সব সময়ই ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন করে। অত্রএব কবি একজন সাধারণ ভক্ত হিসেবে, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনার/আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে দয়া করে অস্তিত্বের স্বার্থে এই কুলীনতা, এই আভিজাত্য, এই দুর্বোধ্যতা পরিহার করুন। সাধারণের কথা বলুন, সাধারণের মতো ভাবুন। জীবনের কথা বলুন কবি, মানুষের কথা বলুন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.