আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফুল, পাখি, দাদা ম্যাচ, রাজহাঁস, দেবদারু গাছ আর আমাদের সম্পর্ক: একটি কবিতার বই পাঠের অভিজ্ঞতা

তাকায় সবাই, কিন্তু দেখে খুব কম লোকই।

যখন কথা বলি, প্রথমেই ভাবি অনেক সহজ করে অল্প কথায় বলব। প্রচুর বলি, ঘুরিয়ে বলি, পেঁচিয়ে বলি, সহজ আর হয় না। অন্য অনেক কিছু হয়। গদ্য প্রথম প্রথম দীর্ঘ বাক্যে লিখতাম।

এখন ছোট। দীর্ঘ বাক্যে শব্দ আর তাদের সম্পর্ক ছাড়িয়ে কখনও কখনও অন্য দ্যোতনাও এসে হাজির হয়েছে, জ্ঞাতে, অজ্ঞাতে। পড়ে নিজেই উচ্ছ্বসিত হয়েছি। ছোট বাক্যে তা বড় একটা আসে না। এই যে বর্তমান শব্দ, শব্দের পরিক্রমণ, শব্দের সম্পর্ক ছাপিয়ে অন্য কিছু আসা, অন্য কোনও ভাব আসা, অন্য কোনও উচ্ছ্বাস হাজির হওয়া, অনেক অনেক দিন পর, আর একবার পেলাম আনসার আলীর কবিতায়; 'ফুল, পাখী ও অন্যান্য' কাব্যগ্রন্থে।

একবার পেয়েছিলাম সেই কুমার নদীতে। ছোট্ট ডিঙি নৌকার সাথে আকবর বাদশার সম্পর্ক। একবার গাঁদা ফুলের সাথে সম্পর্ক হতে দেখেছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, সেন্ট মার্টিন যেতে যেতে। সেসব কথা এখন বলতে গেলে অন্য অনেক কথা বলা হবে, কিন্তু সেই সহজ ও সাবলীল সম্পর্ক আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমি যখনই কোনও বই বাসায় আনি, প্রথম কয়েকদিন বইটা পড়ি না।

রাখি। কাছে কাছে রাখি। শোবার সময় মাথার কাছে, পড়ার টেবিলে, খাবার টেবিলে, এমনকি মেঝেতে সতরঞ্চি বিছিয়ে চা খেতে খেতে বইটা নাগালের মধ্যে রাখি। দেখি। নাড়ি।

চাড়ি। পড়ি না। একসময় পড়ি। আনসার আলির বইটাও তাই। পড়ছিলাম না।

রাখছিলাম। সেই ফাঁকে পড়ে ফেলল আমার ছয় বছরের কন্যা। পড়ে সে কিছুই বোঝেনাই। না অর্থ, না তার অন্তর্গত ভাব। সেসব তার অজানা।

কিন্তু কয়েকটা শব্দ আর শব্দগুচ্ছ, তাকে বড় আনন্দ দিল। আমাকে ডেকে বলল, 'বাবা দেখ, লিখেছে, মানুষের ভিতরে থাকে মানুষ। বাইরে দেবদারু গাছ। ' কী মজা, তাই না বাবা? বাবা, আমার ভিতরে কি মানুষ আছে? বাবা, আমার বাইরে কি দেবদারু গাছ? আমি বড় চমকে যাই। আমি বড় শব্দহীন হয়ে যাই।

আমি ছুটে চলে যাই আনসার আলীর কাছে। আমি দেবদারু গাছের পাতার কাছে গিয়ে বসে থাকি। তার মধ্যে সন্ধান করতে থাকি এক অচেনা মানুষের। আমি আমাকে দেবদারু গাছের মতো করে চিড়ে তার ভেতরের মানুষটার কাছাকাছি চলে যেতে চাই। যেতে গিয়ে আবিষ্কার করি, আমার করাতে সেই আগের ধার আর নাই।

আনসার আলীর বইয়ের ভূমিকা পড়ে জানতে পারি, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির যন্ত্রের শব্দের ফাঁক গলে গলে তার কাছে আসে কবিতার শব্দবন্ধ আর তাদের সম্পর্কের পরম্পরা। তারা এসে একে অপরের সাথে সম্পর্ক করতে থাকে। কিংবা সম্পর্ক করতে করতে তারা আসে। যেমন সম্পর্ক করে আমাদের শহরে একদিন এসে যায় একজন আনসার আলী আর দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি। কথাটা শোনামাত্র একজন কবি আনসার আলী আলাদা মনোযোগ পেয়ে যায়।

আমার কাছেও তাই পেয়েছিল। ফলে আনসার আলীকে চিনতে আমি ভুল করে ফেলি। আর আনসার আলী আমার কাছ থেকে দূরে চলে যান। আমি স্পষ্টই বুঝি যে তিনি দূরে চলে গেলেন। তখন আমি তার নাগাল পেতে চাইলাম।

দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির যন্ত্র আর যন্ত্রণা আমি বন্ধ করতে চাইলাম। আনসার আলীর বইটাতে একটা ব্রাউন পেপারের মলাট দিয়ে দিলাম। রেখে দিলাম অন্য শতেক বইয়ের ফাঁকে। আমার মেয়ে কয়েকদিন বইটা খুঁজে খুঁজে হয়রান হল। ভাবল তার মজার ছড়ার বইটা বুঝি গেল।

এও আরেক সম্পর্ক। আমার ছয় বছরের মেয়ের কাছে কেন কবিতা ভালো লাগবে? পুরো কবিতা ওর ভালো লাগে না। ভালো লাগে একটা লাইন। ওর ভালো লাগে, 'এতটুকু উঠানে এতো রাজহাঁস ক্যানো?' এই কথাটি। জানি না এই কথা ওর কাছে এসে কী সম্পর্ক করে।

আমি কোনওদিন তা জানতে পারব না। আমার বড় বিপদ। আমি আনসার আলীকে মলাট দিয়েও ভুলে যেতে পারি না। শেষে মলাট খুলেই আনসার আলীকে নিয়ে বসি। 'ফুল, পাখী ও অন্যান্য' নিয়ে বসি।

আবার আমার সাথে এসে সম্পর্ক করে 'অন্য'রা। সম্পর্ক করে সব্যসাচী হাজরা, বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পী, সম্পর্ক করে তৌহিদ এনাম ফাউন্ডেশন, বইয়ের প্রকাশক। সম্পর্ক করল ভূমিকায় লেখা আনসার আলীর কথাগুলো। আনসার আলীর কবিতার সাথে এদের কোনও সম্পর্ক নাই। অন্তত কবিতা পড়ার সময় সে সম্পর্ক রাখতে নাই।

সব ভুলে আমি কবিতায় ঢুকলাম। কবিতা পড়লাম। আমি এক ঝটকায় পাখির কাছে, ফুলের কাছে চলে গেলাম। চলে আসলাম। তাদের কাছে আমার মনের কথা খুলে বললাম।

পাখিরা বলল। আমি শুনলাম। আমি সম্পর্ক করলাম। আনসার আলীর কবিতার মতো সহজ সম্পর্ক। তোমাকে উঠানে না দেখার মানে তুমি কিশোরগঞ্জ চলে গেছ।

এমনই সহজ সেই সম্পর্ক। কী অনায়াস! কী দায়িত্বহীন! কী সুন্দর! একটি কবুতরের সকালে গিয়ে দুপুরে আধার নিয়ে ফিরে না আসার মানে আজ সবুজে গোলাগুলি হয়েছে। এইসব সূতা, এইসব সম্পর্ক পুঁজি করে এগিয়ে যাই, এগিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু সূতা ছিঁড়ে আমার আর ফিরে আসা হয় না। আমি কেবল এগিয়েই যাই।

সম্পর্ক করি। সহজ সমীকরণ করি। বীজগণিতের মতো সম্পর্ক করি। আমার সামনে চশমার পাওয়ার আর চশমার দামের সাথে গাণিতিক সম্পর্ক হয়ে ঝুলে থাকল দাদা ম্যাচ, ঝুলে থাকে ইনকাম ট্যাক্স। আমি তারে পারি না এড়াতে।

কোনও একদিন একজন যুবকের যুদ্ধে চলে যাবার সাথে আজকে তার আর তার পরিবারের অনাহারে থাকার কি সহজ সম্পর্কই না চিরন্তন হয়ে গেল আমাদের সবার অজান্তে। স্থায়ী হয়ে গেল। আমরা তা হতে দিলাম। আমরা এর অন্যথা হতে দিলাম না। হারান মাঝির মৃত বউয়ের পোড়ার সাথে সোনার গান্ধী মুর্তির যেমন সম্পর্ক, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরির লোহালক্করের মাঝে বসে যন্ত্রের প্রবল শব্দের সাথে সাথে দম নিয়ে সজোরে কবিতার পড়ার সম্পর্কও একই।

অথবা এখন আমাদের শহরে মৃত মৃত বাগানে তাজা কারনেশন ফুল ফোটার সাথে সিরাজগঞ্জের পোতাজিয়ার চরে বক্কর মিয়ার দুই হাঁটুর মধ্যে ধরা মাটির দোনায় শুকনা গাভীর ওলান থেকে টেনে বের করা দুধের চড় চড় শব্দের খুব ছোট কিন্তু গভীর একটা সম্পর্ক রয়েছে। শনিগ্রহের একবার সূর্য প্রদক্ষিণের সাথে সম্পর্ক রয়েছে বকুল ফুলের মাঝখানের গর্তে, গর্ভাধানে একফোঁটা শিশিরের নিঃশব্দে গড়িয়ে ঢুকে যাওয়ার। আর আমরা কি না সম্পর্ক খুঁজি বিগব্যাঙের সাথে ঈশ্বরের। পৃথিবীসৃষ্টির। কিংবা হয়ত ভালো থাকা না থাকার সাথে রাজনীতির।

সাম্যের। কী এমন এসে যাবে এইসব ছেঁড়া সূতার মিহি সম্পর্ক খুঁজে না পেলে? দুটি চোখ খুলে সাবলীল আর নির্মোহ ফিকিরে দেখে গেলেই তো হয়, কেমন করে শহরের মধ্যিখানে এক একটা আস্ত মানুষ বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এক একটা সঙ্গীহীন দীর্ঘ দেবদারু গাছ?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।