আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেমন আছি সৌদি আরবে -ষষ্ঠ পর্ব

স্বাগতম

গ্যাস মাস্ক পড়ে আমি ইরাক যুদ্ধ-১ দেখতে না দেখতেই আমার ছুটির সময় চলে এলো। সেই মোতাবেক আমি মার্কেটিং শুরু করেদিলাম। আমাদের আত্বীয় সংখ্যা প্রচুর বিধায় গিফটের সংখ্যাও ছিল অনেক এছারা এটাই আমার প্রথম ছুটি ছিল। ঢাকার বাসাতে ব্যবহার করার জন্য সনিটিভি, ভিসিয়ার ও একটা ওয়াশিং মেশিন কিনলাম এবং প্রতিজনের নামে তাদের পছন্দ অনুযায়ী টিসার্ট,থ্রিপিস, সেন্ট,ঘড়ি,রেবন সানগ্লাস ইত্যাদি অনেক কিছুই। ইন্ডিয়ান কলিগ নাফিজ আমার কেনা কাটার ধুম দেখে অবাক।

সে আমাকে নানারকম উপদেশ দেয়া রু করলো। কিন্তু কে শোনে ওর কথা। আমার ছুটি থেকে ফিরে আসার পর নাফিজও ছুটিতে যাবে। তার বৌ-বাচ্চা আছে কিন্তু কেনা কাটাতে কোন আগ্রহ নেই! জিজ্ঞেস করলে বলে আমাদের ইন্ডিয়াতে সবই পাওয়া যায়,এ ছারা এয়ারপোর্টের কাষ্টমসের ঝামেলার কথাও বলেন। যাই হোক আমি মোটামুটি তৈরী হয়ে গেলাম ছুটির জন্য।

আমার হাতের কাজগুলো দ্রুত শেষ করছিলাম যাতে দুমাসের ছুটিতে কোন ঝামেলা না বাধে। কিন্তু ঝামেলা বেধে গেল এখানে!একদিন নাফিজ এসে বললো ইরাকের সংগে কুয়েতের কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। আজ জেদ্দাতে মিটিং ছিল সেখানে ভূট্টোর মতো কূয়েতীরাও রেজুলেশন পেপার টুকরা টুকরা করে ছিড়ে ফেলেছে। ইরাকও তাদের হুমকি দিয়ে গিয়েছে। আমি আমার প্রথম ভেকেশনে অশনি সংকেত পেলাম।

পরদিন শুনলাম ইরাক তার সেনাবাহিনী পাঠিয়েছে কুয়েত দখল করার জন্য। সৌদি জনগন তখনও বিস্বাস করতে পারছেনা সাদ্দাম হোসেন এমন কাজ করতে পারে। যাইহোক আমি তার রাজনৈতিক বিশ্লেষনে যাবনা,এখানে শুধু নিজের অবস্থানের কথা লিখে যাবো। আমাদের আলখুবার থেকে কুয়েত মাত্র তিনশ কিলমিটার দুরের রাস্তা। তাই কুয়েতীরা প্রানের ভয়ে সর্বপ্রথম এদিকেই ছুটে আসতে লাগলো।

সৌদি সরকার যথারীতি ইরাকের প্রতি সংযত হওয়ার আহ্ববান জানালো,না হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তারা নেবেন বলে সাদ্দামকে হুশিয়ার করে দিল। এদিকে সিনিয়র বুশও ঘোষনা দিলেন তারা কুয়েত ও সৌদি আরবের পাশে থাকবে। সারা বিশ্বজুরে শুরু হলো কুটনৈতিক কাজ কারবার, আর আমরা আটকে গেলাম মাইঙ্কার চিপায়!নাফিজ তার সিদ্বান্ত পরিবর্তন করে ফেললো। সে অফিসে গিয়ে বললো তাকে হয় ছুটি দিতে হবে নাহলে এক্সিটে(চাকুরী ছেড়ে দেবে)যাবে। আমার বস আমাকে ডেকে বললো,মোহাম্মদ তুমি পরে যাও।

এই বলে আমার কোন আপত্তিও তিনি শুনলেননা,শুধু বললেন আমি তোমাকে ভাইয়ের মত দেখে রাখবো। এই যুদ্ধ হবেনা,সাদ্দামকে ইরানের যুদ্ধের সময় সৌদি আরব সাহায্য করেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। কি করব আমার বয়সটাও তখন যুদ্ধে যাওয়ার! তাই নাফিজকে বকা সকা করে আমিই দাহরান এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে উঠিয়ে দিলাম। সে বলতে গেলে একদম খালিহাতেই চলে গেল!আমি এই যুদ্ধের মধ্যে আবারো একাকী হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে আমরা জানতে পারলাম শুধু কুয়েতই নয় সৌদি আরবের ছোট্ট তেল উত্তোলনের শহর আল-খাবজীও ইরাকী আর্মীরা দখল করে নিয়েছে!দুইদিনের যুদ্ধের পর অবশ্য শহরটা আবার পুনরুদ্ধারও হলো।

তখন থেকেই আমরা একটা নুতন টিভি ব্রডকাস্টিং হতে দেখলাম, বাহরাইন থেকে CNNTV.তারা LIVE অনুষ্ঠান শুরু করলো। আমরা যুদ্ধের যাবতীয় সংবাদ এই টিভি থেকে সরাসরি জানতে পারতাম। কোন্ কোন্ দেশগুলো এদেশে আর্মী পাঠাচ্ছে,তাদের সবকথা এখানে প্রচারিত হতো। আমরা একদিন গর্বোভরে দেখলাম বাংলাদেশী আর্মীও এদেশে যুদ্ধের জন্য এসে গেল!তারা যুদ্ধের জন্য ট্রেনিংও নিচ্ছে। বিদেশের মাটিতে আমরা যখন অসহায় বোধ করছিলাম তখন আমাদের দেশী আর্মী আমাদেরই সংগে আছে,তা সিএনএন টিভিতে দেখে আমরা উজ্জিবিত হলাম।

আমার এক সৌদি ক্লায়েন্ট অবাক হয়ে বলেই ফেললো তোমাদের দেশে এতো সুন্দর স্বাস্থ্যের আর্মী রয়েছে আমরা জানতামনা! এদিকে প্রতিদিনই যেমন নুতন নুতন দেশের আর্মী আসছিল তেমনি যুদ্ধের সম্ভবনাও বারছিল। আর ভারতীয় শ্রমিকরা ভয়ে দলে দলে দেশ ত্যাগ শুরু করলো। অনেকে আবার জেদ্দার দিকে ছুটলো,কারন জেদ্দা ছিল যুদ্ধের রেঞ্জের বাইরে। আমার দেশের বাড়ী থেকে ফোনের পর ফোন আসতে লাগলো,একই কথা শীঘ্রি চলে এসো অথবা নিরাপদ স্থানে চলে যাও আমি তাদের অভয় দিয়ে,শান্ত থাকার কথা বলি। কুয়েত থেকে বেচে আসা হাজার হাজার লোকে আমাদের এই আল খুবার শহর ভরে গিয়েছিল।

তাদের থাকার জন্য তাবু নয় বিশাল বিশাল অট্টলিকা দেয়া হলো,যা এখনো কূয়েতী বিল্ডিং নামে পরিচিত। আমরা মসজিদে নামাজ পড়তে গেলে দেখতে পেতাম সর্বহারা এই কুয়েতীরা কেধে কেটে সাহায্য চাচ্ছে। তারা কোটি কোটি দিনার ফেলে চলে আসার বর্ননা দিতে গিয়ে আমাদের সহানুভুতিই পেতো। তাই বাংলাদেশে যারা ছিল তাদের বেশির ভাগ লোকই সাদ্দামকে সমর্থন দিয়েছিল কিন্তু আমরা যারা যুদ্ধ দেখেছি তারা কিন্তু উল্টো মতের ছিলাম! এই যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেন তাদের নির্মিত স্কাড মিশাইল ব্যবহার করবে এবং তাতে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করবে বলে যুদ্ধ বিশারদগণ ধরেই নিয়েছিল। তাই সৌদি সরকার তার দেশে অবস্থানকারী সবাইকে গ্যাস মাস্ক ফ্রিতে দেয়া শুরু করল (ছবিতে দেখুন)।

সেই সাথে বাড়ীর দরজা জানালা কিভাবে এয়ার টাইট করতে হবে,রাস্তাঘাটে চলাকালীন বা গাড়ীতে থাকাবস্থায় স্কাড মিশাইল এলে কি করব ইত্যাদি শেখান হতো। আমরা দোকান থেকে মাসকিন টেপ কিনে দরজা জানালার ফাক ফোকর বন্ধ করলাম। অবশ্য গ্যাস এটাক হলে এই ব্যবস্থা যে মোটেই টিকবেনা আমরা সবাই তা জানতাম!এদিকে একাকী রাতে ঘুম আসেনা। আমার পাশের রুমে ছিল নাবিল নামের একজন মিশরী সেলসম্যান। সেও প্রায় সারা রাত জেগে থাকত,তাই মাঝে মধ্যে তার ওখানে গিয়ে ভয় ভাংগাতাম।

ওদিকে আমার ক্লাসমে্ট বন্ধু রিয়াজেরও একই অবস্থা হলো । সে আমাকে ফোন করে তার ভয়ের কথা বললো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম রাতে আমি দাম্মাম গিয়ে তাকে নিয়ে আসব। এবং যুদ্ধের সময় একসাথে থাকবো। এদিকে যুদ্ধের ডেডলাইনও ঘোষিত হলো ১৫ই জানুয়ারী।

আমরা সন্ধ্যা রাত থেকেই মাস্ক নিয়ে ঘড়ে বসে CNNTV/BBCTVতে খবর নিয়ে বসলাম। মাঝে মধ্যে বাহরাইন ও দুবাই টিভিও টিউন করি কিন্তু কোথাও কোন আক্রমন হয়েছে এমন খবর আসছেনা। শুধু টক শো চলছে আর মাঝে মধ্যে দাহরান হোটেল থেকে সরাসরি টিভি রিপোর্টারকে দেখাচ্ছিল। কারন সেই হোটেলটিতে তখন আমেরিকান ও ইউরিপিয়ান সিটিজেনরা আশ্রয় নিয়েছিল। আমি রুমের জানালা দিয়ে দুরের হাইওয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি দু-একটা গাড়ী মাত্র রাস্তা দিয়ে চলছে।

দোকানপাট প্রায় সবই ছিল বন্ধ। এভাবেই টেনশন করে আমাদের রাত কেটে গেল কিন্তু কোন অঘটন হলোনা। সেদিন আমরা কাজ করবোনা বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলাম। তাই একটু বেলা করে উঠলাম। ঘুম থেকে উঠে নাস্তা সেরে রিয়াজকে নিয়ে তার কোম্পানীর ক্যাম্পে গেলাম।

গিয়েতো আমাদের চক্ষু চড়কগাছ! কেউ নেই সেখানে,দেয়াল টপকে রুমের সামনে গিয়ে একটা চিরকূট পেলেম। ওদের ম্যানেজার ছিল প্যালেস্টাইনের নাগরিক সে লিখে গিয়েছে সবাই জেদ্দা যাচ্ছি তুমি সম্ভব হলে চলে আসো এই রইলো তোমার আকামা। ওটা রিনিউ করার জন্য তাদের নিকটই ছিল। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম মারা গেলে আমরা এখানে একই সংগে মরবো কিন্তু আলাদা হবোনা। আমরা রুমে ফিরে এলাম এবং আমি বসকে গিয়ে বিস্তারিত খুলে বললাম।

বস খুবই আন্তরীকতার সঙ্গে রিয়াজকে দেখতে চাইলো এবং প্রয়োজনে আমাদের কোম্পানিতে তাকে কাজ দিতে তার আপত্তি নেই বলে জানালেন। আমরা খুবই খুশী হলাম এবং সেই থেকে আজ অব্দি আমরা একই সঙ্গে কাজ করে আসছি। যাইহোক ২য়দিন রাতে এলো প্রথম আক্রমন। রাত ন’টার দিকে সমস্ত টিভি চ্যানেলে রেড এলার্ট সহ খতরা(বিপদ সংকেত)বলে চিৎকার শুরু করে দিল। আমরা দরজা-জানালা ভাল করে বন্ধ করে মাস্ক পরে ফেললাম।

তারপর ইংলিশ চ্যানেলগুলো টিউন করে বুজলাম একটি স্কাড মিশাইল ইরাক ছেরেছিল কিন্তু আমেরিকান সোলজার তা পেট্রিয়টদ্বারা এইমাত্র আকাশেই নিষক্রিয় করে দিয়েছে। আমরা যারা মাস্ক পরেছিলাম তাদেরকে তা খুলে ফেলতে বললেন। আমরা হাফ ছেড়ে বাচলাম এবং বাইরে গিয়ে দেখার চেস্টা করলাম কোথায় ঘটনাটি ঘটেছিল। একটু পর আবারো বাইরে এবং টিভিতে সাইরেন বেজে উঠলো। আমরা দৌড়ে রুমে গেলাম তখন সিএনএন লাইভ শুরু হয়েগিয়েছিল।

দেখলাম আকাশ পথেই দুটো মিশাইলের সংঘর্ষ হল এবং এবারও স্কাডটি টুকরা টুকরা হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.