আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সামহোয়্যারে বিজ্ঞাপন প্রকাশঃ প্রতিষ্ঠানের আর্থিক নিশ্চয়তার স্বরুপ...

জীবন্ত মানব সত্তার অস্তিত্বই নিঃসন্দেহে মানবের সকল ইতিহাসের প্রথম আরম্ভ...

ছুটির দিনগুলোতে সময় কাটানোর জন্য বেঙ্গল ফাউন্ডেশন গ্যালারি একটা চমৎকার জায়গা, বিকালের দিকে প্রায়ই কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকে। ঠান্ডা ঘরে বসে প্রিয় মানুষটার সঙ্গে পছন্দের কোন অনুষ্ঠান উপভোগ করা, চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা। ঢাকা শহরে সময় কাটানোর মত জায়গার স্বল্পতার যুগে বেঙ্গল গ্যালারীকে আমার একটা ওয়েসিস মনে হয়। বিখ্যাত শিল্পীদের গান শুনে একটা চমৎকার সন্ধ্যা আপনি কাটিয়ে দিতে পারেন। আর মজার ব্যাপার, এর জন্য আপনাকে একটা পয়সাও খরচ করতে হবে না।

বেঙ্গল গ্যালারীতে আমিও যাই মাঝে মাঝে, আমার বন্ধুদের সাথে। কিন্ত মনে একটা খচখচে ভাব নিয়ে! আবুল খায়ের লিটু সাহেব বিস্তর ধনী মানুষ, গাটের পয়সা খরচ করে বেঙ্গল গ্যালারী তিনি চালাতেই পারেন, কিন্ত কোন কিছু কন্ট্রিবিউট না করে কাঁহাতক আর তার ঘরে বসে গান বাজনা শোনা যায়? আমার অস্বস্তি লাগে... যদিও মাঝে মাঝে ভাবি এই যে ঘর ভর্তি লোক, গান শুনছেন ইফফাত আরা বা সুবীর নন্দীর, এদের প্রত্যেকের কিন্ত অন্তঃত ১০০ টাকা খরচ করে টিকিট কাটার সামর্থ্য আছে। আজকের দিনে ১০০টাকা এমন কিই বা টাকা! অথচ বেঙ্গল গ্যালারী কর্তৃপক্ষ কেন টিকিট কাটার ব্যবস্থা রাখেন না? এটার কোন সদুত্তর নিশ্চয় আছে, কিন্ত আমার তা মাথায় আসে না। তবে আমার খুব ভাবতে ইচ্ছা করে আজ যদি এখানে টিকিট কাটার সিস্টেম থাকতো, ১০০টাকা বা ২০০টাকা,...... এক একটা অনুষ্ঠান যে ভাবে শ্রোতার ভারে জমজমাট— ঠিক আজকের সমপরিমান লোক এখানে জমায়েত হতো কিনা...! বেঙ্গল গ্যালারী বা ছায়ানট কিংবা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সহ অনেকেই প্রায় প্রতি সপ্তাহেই এ ধরনের গানের জলসার আয়োজন করে থাকেন। আমার ধারনা প্রতিষ্ঠান চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে তারা জানেন, গান শোনার জন্য টিকিট না কাটতে হলে, মানুষ বেশি স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে।

কেউ কেউ হয়ত বিনা পয়সায় গান উপভোগ করা তার ন্যয্য হক বলে মনে করে... আমাদের সেই জিলা শহরে ছোটবেলায় স্কুলে যাওয়ার পথে লাঠিতে ভর করে হাটা এক ভিক্ষুকের কথা আমার খুব মনে হয়। খুবই নিষ্ঠাবান এই ভিক্ষুকটি দাড়িয়ে থাকতো রেল ষ্টেশনের প্রধান গেটে, এবং তার খোঁড়া পা দেখিয়ে প্রত্যেক যাত্রীর কাছে তার ভিক্ষা পাওয়ার ন্যয্যতা তুলে ধরতো। তার এই নাছোড়বান্দা মনোভাবে যাত্রীদের অনেকেই বিরক্ত হয়ে ধমক দিত, কিন্ত তাকে কাঁচুমাচু হতে বড়ো একটা দেখতাম না। বরং সুযোগ পেলেই সে আমাদের তার ভিক্ষা পাওয়ার যৌক্তিক দাবীর কথা মনে করিয়ে দিত। আঞ্চলিক ভাষায় যা বলতো, তার সারমর্ম- তোমরা আমাকে অবহেলা করছো, অথচ তোমারা জানো না, এই গোটা শহরটা চলছে আমাদের মত ফকিরদের দোয়ায়...... ভিক্ষুক হিসাবে তার এই গাটস্‌ আমি মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করতাম।

আমাদের গ্রাম বাংলার সেই জমিদারী আমলে রায়ত (প্রজা) হিসাবে সাধারন মানুষ চিত্ত বিনোদনের এবং আমোদ ফুর্তির খরচ জোগানো জমিদারের পবিত্র কর্তব্য মনে করতো। জমিদার বাড়ীর খরচে গ্রামে দুর্গাপুজার আয়োজন, সে উপলক্ষে যাত্রা বা নাচ গান আর বিজয়া দশমীতে গ্রামের সবার পেটভরে খাওয়ার দাওয়াত, এই কালচার খুব বেশিদিনের পুরানো নয়। জমিদারীর আমলে মানুষ কেন গাঁটের পয়সা খরচ করে আমোদ ফুর্তি করবে? এটা তো রায়তদের পাওনা... জমিদারী আমল চলে গেছে- কিন্ত রায়ত হিসাবে আমরা আমাদের হক আদায়ের দাবী মনে হয় আজও ছাড়ি নাই। তফাত হলো আগে জমিদারের দেওয়া ভুরিভোজের পরে ঢেঁকুর তুলে জমিদারের গুন গাইতাম— জমিদার বাবু মানূষ ভালা, এবার লুচির লগে দই মিষ্টিও দিছে। আর এখন তার বদলে বেঙ্গলে গান শুনতে শুনতে বলি— বহুৎ টাকা কামাইছো বাপ, এখন বেঙ্গল গ্যালারীর পিছনে টাকা পয়সা ঢেলে খানিক সংস্কৃতির চর্চা করো।

তোমার এখানে এসে হল ঘর ভর্তি করার জন্য তো আমরা আছিই, এতেই তো তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত!!! প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমাদের মনোভাব এ রকমই। আমরা যাবতীয় সেবা উপভোগ করতে চাই, কিন্ত তার জন্য প্রতিষ্ঠান কিভাবে টাকা পয়সা যোগাড় করবে, তার আর্থিক সমস্যার সমাধান করবে, সে আলোচনায় আমি ঢুকতে চাই না, তা নিয়ে আমি সবচেয়ে কম ভাবতে চাই। প্রত্যকেরই হয় তো ধারনা কোন এক গায়েবি যাদুবলে কর্তৃপক্ষ এ সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন। তবে সমস্যা এখানেই শেষ নয়, ধরা যাক বেঙ্গল আগামী অনুষ্ঠান থেকে স্পনসর নেবার প্রথা চালু করলো এবং সে অনু্যায়ী মঞ্চের পিছনে স্পনসরের ব্যনার টাঙ্গিয়ে দিল। এই বার দেখবেন এক শ্রেণীর শ্রোতাদের মহা আপত্তি, সেই ব্যানারের রঙ নাকি তাদের সঙ্গীত উপভোগে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে...... সাম্প্রতিক সময়ে সামহোয়্যার প্রতিষ্ঠান হিসাবে তার টিকে থাকা এবং বিকাশের স্বার্থে ফ্রন্ট পেজে বিজ্ঞাপন নেওয়ার কথা ঘোষনা করেছে, পরবর্তীকালে এ্যকটেল কোম্পানীর একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশও শুরু হয়েছে।

এই বিজ্ঞাপন প্রকাশকে কেন্দ্র করে এক শ্রেণীর ব্লগাররা যে মাত্রার প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন এবং এ্যড ব্লকারের পাইকারী সুপারিশ করেছেন তা খুবই দ্বায়ীত্ব জ্ঞানহীন এবং একটা প্রতিষ্ঠানের প্রতি নির্মমতা বলে আমার মনে হয়েছে। দ্বায়ীত্বজ্ঞানহীন- কারন এর মাধ্যমে আমি প্রমাণ করলাম, প্রতিষ্ঠানের সেবা আমি নেব অথচ তার বাজেট কোথা থেকে আসবে সে দায়ীত্ব আমি নেব না...... একই সাথে নির্মম, কারন আমি এ্যড ব্লকারের মাধ্যমে অচলাবস্থা তৈরি করছি যাতে বিজ্ঞাপন প্রকাশের কাজটা নির্বিঘ্ন না হয়। উটপাখির মতো চোখ মুখ আমরা যতই ঢাকি না কেন, এটাই তো সত্য যে আমরা পুঁজিবাদি একটা অর্থব্যবস্থার অধীনে বসবাস করছি। এই ব্যবস্থায় মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কটাও হবে পুঁজিবাদি। এই ব্যবস্থায় একটা প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে আর বেড়ে উঠে এই পুঁজিবাদি সম্পর্ক গুলো ব্যবহারের মাধ্যমে।

বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা এবং তার বিনিময়ে অর্থ সংগ্রহ একটা স্বীকৃত পদ্ধতি—আমাদের এটাই করতে হবে, অর্থ যোগানের জন্য কোন জমিদারবাবুকে আমরা এখানে পাবো না। প্রতিষ্ঠানের সেবা যদি নিতে চাই, তবে এই পুঁজিবাদি সম্পর্কের যুগে তার আর্থিক সমস্যা সমাধানের অধিকারটাও আমাদের মানতে হবে। ভিক্ষাবৃত্তি আমাদের সমাজে মহান পেশা, ভিক্ষুকের দোয়ারও একটা মুল্য আমরা নির্ধারন করে দিয়েছি (ভরপেট খাওয়া আর হাইকোর্ট মাজার থেকে যাওয়া আসার রিক্সাভাড়া) কিন্তু তা দিয়ে তো প্রতিষ্ঠান চলবে না। জমিদারী আমল হলে হয়তো চলতো!!! ফলে অর্থ সংগ্রহের বিকল্প কোন পথ বাতলে না দিয়ে আমরা যদি সামহোয়্যরের এ্যডের কালার নিয়ে সস্তা টিটকারী মারি, এডব্লকার ব্যবহারের গনতান্ত্রিক অধিকারের কথা তুলি, আমার ডেস্কটপ স্লো হয়ে যাওয়ার অনু্যোগ জানাই— এরপর সামহোয়্যরের জন্য আর বাকী থাকে কোন রাস্তা? ভিক্ষাবৃত্তি নাকি জমিদারের রায়ত হয়ে যাওয়া? রঙ্গতামাশা বা কৌতুক করার জন্য নিশ্চয় এক ধরনের স্মার্টনেস দরকার হয়। কিন্ত আমার বিশ্বাস প্রতিষ্ঠান হিসাবে সামহোয়্যরের টিকে থাকার জন্য আর্থিক এই নিশ্চয়তা কতটা জরূরী এটা বোঝার মধ্যেও অন্য ধরনের স্মার্টনেশ প্রয়োজন।

প্রতিষ্ঠান কিভাবে গড়ে উঠে এবং কিভাবে টিকে থাকে তা করে দেখানোর অনেক চ্যালেঞ্জ আমাদের তরুন ব্লগাররা নিশ্চয় ভবিষ্যতে তাদের পেশাগত জীবনে সাফল্যের সাথে নিবেন। প্রকল্প পরিকল্পনার সাথে সাথে সে প্রকল্পের আর্থিক নিশ্চয়তা যোগার করাও যে আধুনিক ব্যবস্থাপনার দায়ীত্ব সে বোধও এই সঙ্গে আশা করি তারা অর্জন করবেন। ভিক্ষাবৃত্তি অথবা জমিদারের রায়ত হয়ে যাওয়া, কোনটাই আমাদের সমাধান এনে দিবে না। আমাদের দেশে পুঁজিবাদি্ ব্যবস্থা দ্রুত বিকাশমান। এখনই সময়, এ থেকে যাবতীয় সামন্তীয় চিন্তা ভাবনার অবশেষগুলো আমাদের ঝেড়ে ফেলতেই হবে...... বের হয়ে আসতে হবে রায়ত প্রজাদের মানসিকতা থেকে।

অন্যথায় যাবতীয় পুঁজিবাদি সম্পর্কের প্রতি আমাদের মধ্যবিত্ত সুলভ ক্ষিপ্ত মনোভাব শুধু কৌতুকই পয়দা করবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।