আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"পাব্লিক" এর চাকর যখন মনিব হয়ঃ

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

"পাব্লিক" এর চাকর যখন মনিব হয়ঃ গত ১৩ মে প্রথম আলোতে "এ কেমন শাস্তি" শিরোনামে ছোট্ট একটা খবর পড়ে খুব অবাক হয়েছিলাম। খবরটা পড়ার পর আমি কয়েকটি দৈনিক পত্রিকার পাঠকের পাতায় এপ্রসঙ্গে লিখেছিলাম। তারপর থেকেই ভাছিলাম-এবিশয় ব্লগে কিছু লিখব। সময়াভাবে যথা সময়ে লেখাটা লিখতে দেরী হলেও আশা করি পাঠকগন জানতে পারবেন-আমাদের তথাকথিত মনিবদের বিকৃত মানষিকতার কিছু কথা। ১২ ই মে ২০০৯ তারিখে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সকল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের মুল্যায়ন সভায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউ এন ও) বক্তৃতা(বক্তৃতা নাবলে বানী বলাই শ্রেয়) দেবার কথা।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার যথা সময়ে উপস্থিত নাহলেও যথা রীতি সভা শুরু হয় সকাল দশটায় এবং পর্যায়ক্রমে সভার কাজ চলতে থাকে। ইউ এন ও সাহেব মিটিং'এ উপস্থিত হন বেলা দেড়টায়। লম্বা সময় যাবত সভা চলায় উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মাঝে একধরনের ক্লান্তি চলে আসে। ইউ এন ও সাহেব তখন বক্তৃতা করছিলেন। বক্তৃতা চলার একপর্যায়ে সভায় উপস্থিত একজন বয়োবৃদ্ধ প্রধান শিক্ষক জনাব আঃ হামিদ ক্লান্তি জনিত কারনে হাই তুলেছিলেন।

প্রধান শিক্ষক আঃ হামিদ সাহেবের হাই তোলা বিচক্ষণ ইউ এন ও সাহেবের চোখ এড়ায়নি। তিনি এটা পছন্দ করলেননা। হামিদ সাহেবকে দাড়াতে বললেন ইউ এন ও সাহেব এবং নির্দেশ দিলেন-যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁর বক্তৃতা শেষ নাহবে-ততক্ষণ পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক মহোদয় জনাব আঃ হামিদ দাঁড়িয়ে থাকবেন!প্রধান শিক্ষক মহোদয় ইউ এন ও'র দেয়া শাস্তি মেনে নিয়ে ৩৫ মিনিটকাল অন্য সকল অতিথিদের সামনে দাড়িয়েছিলেন। অপমানে বিপর্য্যস্ত প্রধান শিক্ষক এই অপমানের প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এই ছিল সংবাদের বিশয়বস্তু।

আলোচ্য ঘটনার নায়ক ইউ এন ও হচ্ছেন একজন সরকারী কর্ম কর্তা। থানা লেভেল তথা উপজেলা লেভেলের সব চাইতে বড় কর্মকর্তা এবং ক্যাডার সার্ভিসের সচিবালয়ের সব চাইতে ক্ষুদ্র কর্মকর্তা (সহকারী সচিব)। যাদেরকে কয়েক বছর পুর্বে পর্যন্ত বলা হতো সেকশন অফিসার। অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক সাহেব একজন মানুষ গড়ার কারিগর। হয়ত তাঁর হাতে গড়া অনেক ছাত্রই ইউ এন ও কিম্বা আরো অনেক বড় সরকারী কর্মকর্তা হয়েও থাকবেন।

ইউ এন ও সাহেবের কাজ জনগনের উন্নয়নে নিজেকে নিয়োজিত করে-জনগনের রক্ত ঘামের বিনিময়ে প্রদত্ত করের টাকায় সরকারী কর্মচারী হিসেবে বেতন গ্রহন করা। তথা জনগনের সেবা করা। এখানে ইউ এন ও সাহেব যা করেছেন-তা জনগনের উপকার্থে নয়-বরং নিজের বাহাদুরী/ ক্ষমতা ফলানো! নিজের ক্ষমতা ফলাতে গিয়ে তিনি নির্মম ভাবে লংঘন করেছেন সকল নৈতিকতা। শিক্ষকদের মুল্যায়ন সভায় একজন বয়বৃদ্ধ প্রধান শিক্ষকের হাইতোলার অপরাধে সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখাটা ক্ষমতার অপব্যবহারই শুধু নয়-চরম অসভ্যতাও। যেকোন মানুষের বিশেষ কোন কারনে শারিরিক ক্লান্তি দেখা দিতেই পারে।

তাছারা ঐ সব মুল্যায়ন কমিটির মিটিং'এ উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা সুযোগপেলে কীভাবে নিজেদের বাহাদুরী ফলাতে পারে-সেটাও আপনারা অনেকেই ধারনা করতে পারেন। এমনই কোন পরিস্থিতিতে জনাব হামিদ সাহেব যদি হাইতুলে একান্তই অন্যায় করেই থাকেন- তার শাস্তি ওভাবে সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হতে পারেনা। একজন সম্মানিত শিক্ষককে এভাবে অসম্মানিত করে তিনি নিজে কি পেতে চাইলেন সেটা আমার বোধগম্য নয়। এটা কি তার একধরনের মানষিক বিকৃতি নয়? এধরনের বিকৃত মানসিকতার একজনকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়াটা কি ঝুকিপুর্ণ নয়? আর হতভাগ্য হামিদ সাহেবের মানসিক বিপর্যস্তাকে কেউ কি একবার ভেবে দেখেছেন? ভাবুন তো একবার, অপমানিত ঐ প্রধান শিক্ষক পরদিন কী স্কুলে যেতে পেরেছিলেন? পথ ঘাটে, স্কুলে, এমনকি নিজ ঘরেও যখন কেউ তাঁর দিকে তাকিয়েছে-তখনই তিনি কুকড়ে গিয়েছেন লজ্জায়। ভেবেছেন-সবাই বুঝি জানে তার ঐ অপমানের কথা! এভাবে ব্যাক্তিগত অপমান নিয়ে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা সম্ভব নয়।

নিজেকে মাথা তুলে সমাজে চলার শেষ চেস্টা হিসেবে জনাব হামিদ সাহেব ইউ এন ও'র বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেছেন জেলা প্রশাসক সাহেবের কাছে। অভিযোগ করে কি হবে! যার কাছে অভিযোগ করা হয়েছে-তিনিতো ইউ এন ও'র বড় ভাই। অর্থাৎ ক্যাডার সার্ভিসের সিনিয়র সহকারী সচিব হন ইউ এন ও এবং উপ সচিব হন ডিসি। একই প্রশাসনের অফিসার তারা। ডি সি সাহেব ইউ এন ও সাহেবের প্রশাসনিক বড় ভাই-অপমানিত প্রধান শিক্ষকের কেউ নন।

আসলে এধরনের ঘটনা আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। ডিসি ইউ এন ও'রা নিজেদের জেলা উপজেলার সর্বেসর্বা মনে করেন। এম পি এবং অধুনা উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর ইউ এন ও দের দাপট কিছুটা কমলেও ডিসিদের আচরনে সামন্ত জমিদারী ভাবটা কিন্তু আগের মতই রয়ে গিয়েছে। ডিসি অর্থাৎ ডেপুটি কমিশনার শব্দের আভিধানিক অর্থ "জেলা প্রসাশক" কিভাবে হয়-সেটাই আমার বোধগম্য নয়! অথচ প্রতিটি জেলায় ডিসি'র অফিস এবং বাসায় নেম প্লেট লাগানো থাকে-"জেলা প্রশাসক"। আসলে নিজেদের তারা সেভাবেই ভাবতে পছন্দ করেন, সেভাবে আচরন করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন।

এই অন্যায়টা বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে-কোন প্রতিকার নেই। প্রতিকার হচ্ছেনা একারনে- প্রতিকারটি হবে যে প্রকৃয়ার মাধ্যমে তার গুরুত্বপুর্ণ স্তরগুলোতে বসে আছেন তাদেরই প্রশাসনিক বড় ভাই-প্রশাসন ক্যাডারের অফিসারেরা অর্থাৎ সচব মহোদয়েরা। ইংরেজীতে "পাব্লিক সার্ভেন্ট" বলে একটা কথা আছে। সরকারী চাকুরী যারা করেন-তারা সবাই এই গোত্রভুক্ত। সরল বাংলা করলে এর অর্থ দাঁডায় "জনগনের চাকর"! চাকরের কি কাজ-তা আমরা সবাই জানি।

চাকরের কাজ হচ্ছে-মালিকের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা। মালিককে সন্তুস্ট রাখা। কিন্তু এসব তথাকথিত সরকারী কর্মকর্তাদের আচরণে কি সেই চরিত্র আদৌ দেখা যায়? জনগনের সেবায় নিয়োজিত জেলার সব চাইতে বড় চাকরটি কি ভাবে নিজেকে জেলার "প্রশাসক" মনে করে-সেটাও বুঝতে পারিনা। এসব "প্রশাসক" নামধারীর আচরণ এবং কর্মকান্ড জনগন কী আদৌ খুশী? খুশী নাহলে তার প্রতিকার করার কিম্বা নিদেনপক্ষে প্রতিবাদ করার কোন অধিকার কি জনগনের আছে? বরং পরিস্থিতি এখন সম্পুর্ণ উলটো। কেউ দুর্ণীতি করলে দুদক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে-এটাই স্বাভাবিক।

দেশের সংবিধান, দুদক আইনে সেই ক্ষমতা দুদককে দিয়েছে। কিন্তু সচিবেরা আবদার করেছেন-সচিবদের সেই আইনের বাইরে রাখার জন্য। অর্থাৎ সচিবদের বিরুদ্ধে দুদক সরাসরি কোন মামলা করতে পারবেনা! দুর্ণীতির অভিযোগে দুদুক তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা করতে পারবেনা-এটা কেমনতরো আব্দার! তাদের বিচারতো এই অনৈতিক আব্দারের জন্যই হওয়া উচিত। গত ১৩ ই মে অফিস শেষে সংস্থাপন মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনাব জাহিদ হোসেনের সভাপতিত্বে সে বৈঠকে স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয়, আইন মন্ত্রনালয়, আভ্যন্তরীন সম্পদ বিভাগ সহ অনেক মন্ত্রনালয়ের প্রতিনিধিগন উপস্থিত ছিলেন-যা প্রায় সবগুলো জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ১৪ ই মে তারিখের দেখেছিলাম। সেই বৈঠকে হয়ত অনেক বিশই আলোচিত হয়ে থাকবে-তবে তাদের ব্যক্তিগত সুবিধাদির বিশয়েই মুলত এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

ইউ এন ও'র বক্তৃতার সময় হাই তোলার অপরাধে যদি একজন প্রধান শিক্ষককে দাঁড় করিয়ে রাখা যেতে পারে-তাহলে অফিস শেষে সরকারি অফিসেই নিজেদের দাবী দাওয়া নিয়ে মিটিং করার সময় যে বিদ্যুতের অপচয় ঘটিয়ে, ব্যাক্তি স্বার্থ আদায়ের জন্য সরকারের যে ক্ষতি হয়েছে-সেজন্য সেই সব বড় কর্মকর্তাদের কি শাস্তি হওয়া উচিত নয়? নিশ্চই এহেন অপরাধে জনগন, যাদের ট্যাক্সের টাকায় সেইসব কর্মকর্তাদের বেতন ভাতার সংস্থান হয়-তাদেরকে পল্টন ময়দানে জনসমক্ষে দাঁড় করিয়ে রাখার প্রস্তাব দেয়-সেটা কি খুব বেশী অন্যায় হবে? আমি জানি-আমার এই চিন্তাকেও প্রচলিত ব্যবস্থায় মারাত্মক অন্যায় হিসেবে চিনহিত করা হতে পারে। কারন, ভৃত্য হিসেবে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে, নিয়োগ প্রাপ্তির পর থেকেই তারা নিজেদের উলটো জনগনের মনিব ভাবতে শুরু করেছে-তাদের কাছে আমরা হচ্ছি "পাব্লিক"(উর্দ্দি ওয়ালারা আরো একটু বাড়িয়ে বলে ব্লাডি পাব্লিক)!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।