আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাকিস্তান সোয়াত - আসলেই কী এটা শরিয়া আইনের জন্য যুদ্ধ? (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)



প্রথম পর্বের জন্য Click This Link দ্বিতীয় পর্বের জন্য Click This Link তৃতীয় ও শেষ পর্ব: এবার সুনির্দিষ্টভাবে সোয়াতের প্রসঙ্গে আসি। তুলনামূলকভাবে অন্য ট্রাইবাল বিশেষ অঞ্চলের চেয়ে রাজ্য শাসিত বলে (এর সর্বশেষ ওয়ালি বা শাসনকর্তা মিয়াগুল জাহানজেব ১৯৪৯-৬৯ এর নাতি হলেন ফারুক চৌধুরী কথিত, তাঁর বন্ধু মিয়াগুল আওরঙ্গজেব, আয়ুব খানের জামাতা। ) বাইরের আলো ও অন্ধকার দুটোই তাদের কাছে আসতে পেরেছিল। তাঁরা ভেবেছিলেন ষ্টাটাস পরিবর্তন করে খোদ পাকিস্তান রাষ্ট্রের টেরিটরি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারলে দ্বৈত শাসনের হাত থেকে বাঁচা যাবে। বৃটিশ লিগ্যাল সিস্টেমের অনুসরণে ও ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে থাকা মূলভূখন্ডের পাকিস্তানের বিচার ব্যবস্হার সুবিধা তাঁর সোয়াতের জনগণের জন্য এনে দেয়া যাবে।

পাকিস্তান সরকারের সাথে আধাখেচরা সম্পর্কের কারণে, উল্টা তাঁর পশতুন ট্রাইবাল বহু পুরানো সমাজে যে ট্রাডিশনাল বা সামাজিক দীর্ঘ প্রথাগত পথে যে বিচার ব্যবস্হা গড়ে উঠেছিল তার স্বাধীনভাবে কাজ করা বা বিকাশরূদ্ধ হয়ে গিয়েছিল তা বোধহয় এবার সুরাহা হবে। কিন্তু তাদের কপাল খারাপ। কথায় আছে নৌকা বাধতে হলে শক্ত গাছে বাধতে হয়। নইলে গাছসহ নৌকা হারানোর সম্ভবনা থাকে। নিজের পশতুন ট্রাইবাল এক বহু পুরানো সমাজ।

আধুনিক রাষ্ট্রের সংস্পর্ষে আসার আগে সব সমাজেরই একটা কমিউনিটি বিচার ব্যবস্হা থাকে। ট্রাডিশনাল বা সামাজিক দীর্ঘ প্রথাগত পথে জিরগা প্রথার বিচার ব্যবস্হা তিনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। তাঁর সমাজ ইসলাম ধর্মালম্বী বলে শরীয়া বা ইসলামী জুরিসপ্রুডেন্সের ছোঁয়া ও প্রভাব ওতে থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কলোনী মাষ্টারদের ঝগড়ার মাঝে বাফার জোনে পড়ে গেছিলেন তিনি। এতে দ্বৈত শাসনে পড়ে তার সমাজ বিচার ব্যবস্হার বিকাশরুদ্ধ হয়ে গেছিল।

উদ্ধার পেতে ভেবেছিলেন আধুনিক রাষ্ট্রের সংস্পর্ষে গেলে এই দোষ কাটবে। কিন্তু বৃটিশ লিগ্যাল সিস্টেমের অনুসরণে ছায়ায় গড়ে উঠা সত্ত্বেও পাকিস্তানের বিচার ব্যবস্হা এতই দুর্নীতিপূর্ণ, দীর্ঘসূত্রি, খরুচে আর সর্বপরি সমাজের অলিগর্কি ছোট্ট খাঁচায় বন্দি - যে তিনি টের পেলেন যে পাকিস্তানের "আধুনিক রাষ্ট্রীয়" বিচার ব্যবস্হা তার সোয়াতের বিচার ব্যবস্হার চেয়েও খারাপ। ইসলামাবাদেও ঘরবাড়ি থাকা, আয়ুব খানের জামাতা হবার সুবাদে মিয়াগুল আওরঙ্গজেব বিচার পেলেও বা বিচার ব্যবস্হা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে সুরক্ষা দিলেও তাঁর সোয়াতের জনগণ সেটা কখনও পাবার তৌফিক লাভ করবে না। অতএব তাঁর পাকিস্তান "আধুনিক রাষ্ট্রে" যোগদান এক বিরাট ভুল, তাঁর জনগণের জন্য হতাশা ছাড়া এখান থেকে আর কিছুই তাদের পাবার নাই। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

সোয়াতের জনগণ সত্য কথাটা প্রকাশ্যে বলা শুরু করে দিয়েছে যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্হার চেয়ে তাদের নিজস্ব জিরগা, ট্রাইবাল বিচার ব্যবস্হার রেওয়াজ (Customary Law) ও শরীয়া আইন ব্যবস্হা অনেক ভালো ছিল। এই নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠতে সময় লাগার কথা নয়। Tehrik-e-Nifaz Shariat Muhammadi (TNSM) বা বাংলায় মুহম্মদি-আইন বাস্তবায়ন আন্দোলনের মৌলানা সুফি মুহাম্মদ এর নেতৃত্ত্ব দিতে শুরু করেন ১৯৯৪ সালে। সেই সাথে তরুণদের নেতা হিসাবে তাঁর পাশে এসে দাড়ায় মৌলানা ফয়জুল্লাহ। পরে ফয়জুল্লাহ তাঁর জামাতা হন।

এভাবে অসন্তোষ, ক্ষোভ আন্দোলনের উথাল-পাথালের ভিতর দিয়ে নিস্ফলা কেটেছে যতদিন তালেবান আলকায়েদা রাজনীতি হয়ে ফিরে না আসছে। ৯/১১ এর পর পাকিস্তান তালেবান নেতা বায়তুল্লাহ মেহসুদের প্রভাব পড়তে থাকে তরুণ মৌলানা ফয়জুল্লাহর উপর। ফ্রন্টিয়ার প্রাদেশিক সরকার মৌলানা সুফি মুহাম্মদকে গ্রেফতার করে রাখেন আর জামাই মৌলানা ফয়জুল্লাহ দল ভেঙ্গে আলাদাভাবে লড়াকু রেডিক্যাল তৎপরতার দিকে ঝুকে পড়েন। । মৌলানা ফয়জুল্লাহ ও তালেবানদের সশস্ত্র আক্রমণ হামলার মুখে ২০০৯ সালে ১৬ ফ্রেব্রুয়ারী পাকিস্তান সরকার ও ফ্রন্টিয়ার প্রাদেশিক সরকার (বর্তমানে সেক্যুলার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতায়) একসাথে উদ্যোগে মৌলানা সুফি মুহাম্মদকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে তাঁর সাথেই দাবি মেনে চুক্তি সই করেছে।

এটাই মিডিয়ায় হৈ চৈ ফেলেছে। বলা হচ্ছে, পাকিস্তান সরকার তালেবানদের সাথে আপোষ করে "শরীয়া আইন" চালুর চুক্তি করেছে। মজার ব্যপার হলো, চুক্তি তালেবানদের সাথে হয়নি। চুক্তি হয়েছে NWFP এর প্রাদেশিক সেকুলার সরকার ও মৌলানা সুফি মুহাম্মদের TNSM এর সাথে। বরং তালেবান নেতা বায়তুল্লাহ মেহসুদ ও জামাই মৌলানা ফয়জুল্লাহ এই চুক্তিতে প্রচন্ড নাখোশ।

একই রকমভাবে নাখোশ হয়েছে আমেরিকা, বৃটেন ও ভারত। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংক্রান্ত ওবামার বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। এরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। আর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মুখপাত্র আব্দুল বাসিত জানিয়েছিলেন, দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্হিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এটাই তার অগ্রাধিকার। কিন্তু পাকিস্তান নিজের কথার উপরে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি।

নিজেরই জনগনের উপর নির্বিচার বোমাবর্ষণ, হেলিকপ্টার গানশিপ দিয়ে সব ঝাজরা করে দিয়েছে। মৌলানা সুফি মুহাম্মদের বড় ছেলে এই হামলা মারা গেছেন। হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। অনন্ত যুদ্ধ চলছে । আমেরিকা ও আলকায়েদার প্রস্তুত হচ্ছে আরও বড় যুদ্ধের।

তারই আপাত সরাসরি ব্যাটেল গ্রাউন্ড পাকিস্তান। সেই যুদ্ধে কেউ না কেউ পরাস্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধের এই পর্যায় শেষ হবার নয়। এখানে সোয়াতের মৌলানা সুফি মুহাম্মদ অথবা জারদারির পাকিস্তান নিমিত্ত মাত্র। ফলে আপাতত বিলিয়ন ডলার সাহায্য ও ড্রন ফাইটার জাহাজের আব্দার করে আমেরিকান যুদ্ধ লড়া ছাড়া পাকিস্তানের আর কোন পথ খোলা নাই। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।

সোয়াতের মৌলানা সুফি মুহাম্মদ কী আসলে "শরিয়া আইন" ফেরত যেতে চাইছিলেন? পশ্চাদপদতায়? আমাদের ষ্টেরিওটাইপ সেকুলার মন সহসাই এই সিদ্ধান্তে পৌছাবে। আমেরিকা , বৃটেন, ভারত সাফ নজরে আমাদেরকে সেটাই দেখিয়েছে, মন তৈরি করতে বলেছে। আছে মিডিয়া। আমরাও তৈরি। কিন্তু সোয়াতের বাসিন্দারা "আধুনিক রাষ্ট্রের" দরজায় প্রচন্ড খটখটিয়ে আমাদের জাগাবার চেষ্টা করছিল না কী? বিচার চাচ্ছিল।

আমরা কত সহজেই না তাদের উপেক্ষা করতে পেরেছি। প্রায় একশ বছরের সমস্যা তাঁরা জ্বলেছে। গত চল্লিশ বছর ধরে "আধুনিক রাষ্ট্রের" দরজায় দরজায় ঘুরেছে কষ্ট নিপীড়নে, কান্নাকাটি করেছে আমাদের নজর কাড়েনি, মন গলাতে পারেনি। "আধুনিক রাষ্ট্রের" অলিগর্কিতে বসে আমরা টেরই পাইনি। যখন তাঁরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে, ফিরে যেতে চাচ্ছে পুরানো অভিজ্ঞতার জামাটাই আবার গায়ে দিতে - আমরা শম্বিত ফিরে পেয়েছি।

তবে, বলছি ওরা পশ্চাদপদ; আধুনিক, অগ্রসর সেকুলার জীবনের মর্ম ওরা কিছু বুঝে না। সমাজে কোন ভাল অবদান নাই ওদের। সেইজন্য ওরা "শরিয়া আইন" চাইছে। "শরিয়া আইনে" পুরে মরতে চাইছে। হেলিকপ্টার গানশিপ নিয়ে আসো।

আমার কথা এবার থাক। শেষ করব ফারুক চৌধুরীর বরাতে মিয়াগুল আওরঙ্গজেবের জবানী দিয়ে। আমার কথার সাথে পাঠক মিলিয়ে পড়বেন। আমার এই লেখা পড়ে আমরা যদি আমেরিকান বয়ানে "পশ্চাদপদদের শরিয়া আইন চাওয়ার বিরুদ্ধে" পশ্চিমের ন্যয়ের যুদ্ধ বলে মানতে অস্বীকার করতে পারি তবেই আমার শ্রম কিছুটা সার্থক বিবেচনার সুযোগ মিলবে। ফারুক চৌধুরীর নিচের লেখাটার লিঙ্ক:http://www.prothom-alo.com/archive/news_details_mcat.php?dt=2009-05-09&issue_id=1273&cat_id=1&nid=MTU0NzM2&mid=MQ== "বর্তমান অবস্হার ওপর তাঁর কথা হলো যে, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে যোগদানের পর থেকেই সোয়াতের জনগণ পাকিস্তানের অদক্ষ, দূর্নীতিগ্রস্ত এবং ব্যয়বহুল বিচারব্যবস্হা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিল।

তারা ফিরে যেতে চাইছিল পুরানো দিনের পাহাড়ি বিচারব্যবস্হায়, যা ছিল স্হানীয় প্রথা এবং ইসলামিক আইনের একটি গ্রহণযোগ্য সংমিশ্রণ। যার ফলে সোয়াতের জনগণ দ্রুত বিচার পেত এবং তারা বেশ কিছুদিন আগ থেকেই সেই বিচারব্যবস্হায় ফিরে যাওয়ার দাবি তোলে। এই দাবিতে মালাখন্দ অঞ্চলের সাধারণ মানুষও যোগ দেয়। তারা তাদের দাবিকে ‘শরিয়াহ আইন’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু তাদের দাবির কোন রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না।

মিয়াগুল আওরঙ্গজেবের মতে, তাদের দাবির প্রতি সরকারের চরম নির্লিপ্ততার কারণেই এ অবস্হার সৃষ্টি হয়েছে। এ অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে স্হানীয় মোল্লারা কঠোর ইসলামিক অনুশাসনের দাবি তোলে এবং তাদের দাবিকে সহিংস রূপ দিয়েছে তালেবানরা, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের ইচ্ছায়। আওরঙ্গজেব আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, সপ্তাহ, মাস কেন, এমনকি তাঁর জীবদ্দশায়ও তালেবানদের সেই সব অঞ্চল থেকে নির্মূল করা যাবে না (তিনি অবশ্য আমার সমবয়সী - অতএব তাঁর জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার প্রয়োজন না-ও হতে পারে!)। শুধু তাই নয়, এখন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ভূতপূর্ব ব্রিটিশাসিত জেলাগুলো, যথা ডেরা ইসমাইল খান, কোহাট, বাননু ও হাঙ্গু জেলায় তালেবানরা ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি মনে করেন, তালেবানরা আফগানিস্তান আবার ক্ষমতায় ফিরবে − যতই সময় লাগুক না কেন তাতে, এবং তাদের সঙ্গে পাকিস্তানের তালেবানদের রয়েছে নাড়ির সম্পর্ক।

সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে, যেখানে পাকিস্তানের দূর্নীতিপরায়ণ শাসকেরা সরকারের অর্থ আত্মসাৎ করছেন, সেখানে তালেবানরা সাধারণ মানুষকে অর্থদানে বাধ্য করছে। তালেবানরা মানুষ হত্যা করছে, সরকারও তো নিরীহ মানুষের প্রাণ নিতে কুন্ঠিত নয়। অতএব তালেবানদের আমরা যে দৃষ্টিতে দেখি, পার্বত্য অঞ্চলের সাধারণ মানুষ তাদের ঠিক সেই দৃষ্টিতে দেখে না, যদিও তালেবানদের সামাজিক কড়াকড়ি তারা পছন্দ করে না।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.