আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাকিস্তান সোয়াত - আসলেই কী এটা শরিয়া আইনের জন্য যুদ্ধ? (প্রথম পর্ব)



[পাকিস্তানের বর্তমান উদ্বাস্তু রাজনৈতিক পরিস্হিতি, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি হবার পিছনে সোয়াত ও "শরিয়া আইন" কে দায়ী করা হয়েছে। সেই সোয়াত ও "শরিয়া আইন" কে একজামিন করতে এই পোষ্ট। বড় লেখা বলে তা পর্বে প্রকাশ করব। এটা প্রথম পর্ব। ] আমরা কমবেশি সবাই মেনে নিয়েছি বা বুঝে গিয়েছি, যেটাকে বলে আমাদের পপুলার পারসেপশন তা হলো, পাকিস্তান সরকার সোয়াতের মোল্লারা যাতে একটা "শরিয়া আইন চালু" করতে পারে সেটার পক্ষে তালেবানদের সাথে একটা চুক্তি করেছে।

এই চুক্তির পরপরই আমরা আমেরিকা, বৃটেন ও ভারত চুক্তির কড়া সমালোচনা করেছে। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সংক্রান্ত ওবামার বিশেষ দূত রিচার্ড হলব্রুক ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মুখপাত্র আব্দুল বাসিত জানিয়েছিলেন, দেশের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্হিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য এটাই তার অগ্রাধিকার। এই নেতাদের সাথে এটাই আমাদের ও মিডিয়ারও পপুলার পারসেপশন বা জনপ্রিয় ধারণা। এরপর সোয়াত থেকে বুনার পর্যন্ত তালেবানদের নড়াচড়াকে কেন্দ্র করে, আবার রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে বুনার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে হওয়ায় আমেরিকা হুমকি দেয় পাকিস্তান সরকার তালেবানদের বিরুদ্ধে একশনে না গেলে আমেরিকান সৈন্য নিজেই পাকিস্তানের মাটিতে একাজ করবে।

ফলে চুক্তি বাস্তবায়ন ফেলে পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে, হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে এতে। পাকিস্তান এর আগে অন্যকে উদ্বাস্তু করেছে অনেকবার; বাংলাদেশে আমাদেরকে, মুজাহেদিন আমলে আফগানদেরকে। এবার খোদ নিজের পালা। মিডিয়া সচল হয়ে উঠেছে এতে। বাংলাদেশেও আমরা এর আঁচ পেতে থাকি, অনেক মিডিয়া রিপোর্ট ছাপা হয়।

এগুলোর মধ্যে থেকে প্রতিনিধিত্ত্বমূলক হবে বিবেচনায় আমি দুটো এখানে আনবো। এদের তুলনামূলক বিচারের উছিলায় নিজের কথা বলব। এর একটা হলো এই ব্লগের মনজুরুল হকের Click This Link পোষ্ট। অন্যটা হলো অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক ফারুক চৌধুরী সম্প্রতি পাকিস্তান সফর করছেন বা এখনও আছেন হয়ত সেখানে। তাঁর পাঠানো রিপোর্ট প্রথম আলো কিস্তিতে ছাপিয়ে চলেছে।

আমার ভুল না হয়ে থাকলে সম্প্রতি তিনি আওয়ামী লীগের সাথে ঘনিষ্ট, গেল নির্বাচনে নোমিনেশন আশা করেছিলেন সম্ভবত। আর সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ বাংলাদেশে আমেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক অর্থাৎ বাংলাদেশে আমেরিকান নীতি বাস্তবায়ন ও স্বার্থ দেখার প্রতিষ্ঠান "আমেরিকান এন্টারপ্রাইজ ইন্সটিটিউট" ও "হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের" কাজ কর্মের সাথে আরও অনেকের মত জড়িয়ে আছেন তিনি। মনজুর পোষ্ট আমি অনেক দেরিতে দেখেছি, সময় দিতে পারি নাই। ফলে অংশগ্রহণ ঘটেনি। ঐ পোষ্টটার সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায় এরকম - ধর্মই সব সমস্যার গোড়া ও আমেরিকান স্টাইলে জঙ্গীভীতি, ঘৃণা ও তদজাত প্রতিক্রিয়া।

তবে মনজুর শেষ লাইনটা ইন্টারেষ্টটিং; আমাদের "সরকার যদি এই আপাত ক্ষুদ্র কিন্তু আদপে বৃহৎ সমস্যার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয় তাহলে আমাদেরকেও এখনকার পাকিস্তানের মত মাশুল গুণতে হবে। হবেই"। হয়ত পরোক্ষে, কিন্তু তাঁর 'জঙ্গি' ভীতি বা আক্ষেপটাকে বলা যায়, দ্বিগবিদিকশুন্য হয়ে আমেরিকান (মনজু সাম্রাজ্যবাদ বলবে কী না জানি না) কোলে ঝাপিয়ে আশ্রয় খোঁজা। আর এটাই অবশ্য এখনকার আমেরিকান পররাষ্ট্র নীতির লাইন। সেকুলারিষ্টদের ভয়কে ব্যবহার করে 'জঙ্গি'দের বিরুদ্ধে নিজের প্রতিরক্ষার দেওয়াল তৈরি করে নিজে বাঁচার চেষ্টা।

নিজের ধ্বংসের বিপদ অন্যের উপর চাপিয়ে দেয়া। অন্যদিকে পোষ্টের মন্তব্যগুলোর মধ্যে, কায়েস মাহমুদ ও আহসান হাবিব শিমুলের কাছ থেকে কিছু গুরুত্ত্বপূর্ণ পয়েন্ট এসেছিল। কিন্তু আগে থেকে তৈরি হয়ে যাওয়া কমিউনিষ্ট সেকুলার আবহের আধিপত্যের মধ্যে তা মুখ্য হয়ে আলোচনার ফোকাস হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়। কেন আমি গুরুত্ত্বপূর্ণ পয়েন্ট বলছি সেটাই আসলে এই পোস্টের ফোকাস। তাই নিয়ে আমার কথা তুলব।

সেকথায় যাব, তবে ফারুক চৌধুরীর লেখা সম্পর্কে আগে বলে নেই। ফারুক চৌধুরী সম্পর্কে আগে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছি। তিনি কাদের স্পনসরে পাকিস্তানে গিয়েছেন আমি জানি না। তবে লেখায় সোয়াতের প্রাক্তন ওয়ালি (শাসনকর্তা) মিয়াগুল আওরঙ্গজেবের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত পুরানো বন্ধুত্ত্ব সূত্রে দেখা করা ও বর্তমান পরিস্হিতি নিয়ে বন্ধু মিয়াগুলের ভাবনাগুলো অবজেকটিভ সততার সাথে নিজের লেখায় তুলে এনে তিনি খুবই প্রশংসনীয় একটা কাজ করেছেন। এটাকে আমরা একটা মাঠের ভাষ্য হিসাবে নিতে পারি, কিছু মৌলিক তথ্যও আছে সেখানে।

সোয়াত ইস্যু বুঝবার জন্য যা খুবই জরুরী ও আমাদের দৃষ্টি প্রসারে ব্যাপক সাহায্য করবে বলে আমার বিশ্বাস। ফারুক চৌধুরী তাঁর লেখায় আমাদের জানাচ্ছেন, "মিয়াগুল আওরঙ্গজেব হলেন প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের জামাতা। ১৯৬৯ সাল থেকে সোয়াত পাকিস্তানের ওতেপ্রোত অংশ হিসাবে পরিগণিত হচ্ছিল। সোয়াতের ওয়ালি তাঁর সিংহাসন হারিয়ে পাকিস্তান সরকারের অধীনে বিভিন্ন সময় দায়িত্ত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ছিলেন বেলুচিস্তানের গভর্ণর।

সোয়াতে তাঁর যথেষ্ট জায়গাজমি রয়েছে, রয়েছে বসতবাড়ি। ইসলামাবাদ তাঁর আবাসস্হল হলেও সোয়াতে তিনি প্রায়ই ফিরে যেতেন। মাত্র দুই সপ্তাহ আগেও তিনি সোয়াত সফর করেছেন"। এই বক্তব্যে আমাদের এখানের জন্য মূলকথা হলো, তিনি সোয়াতের বাসিন্দা ও ১৯৬৯ এর আগে ওয়ালি বা রাজ্য-শাসক ছিলেন। সর্বশেষ দুসপ্তাহ আগে তিনি সোয়াত সফর করা ব্যক্তি।

ফলে মিয়াগুলের চোখ দিয়ে দেখা ফারুক চৌধুরীর বরাতে টাটকা কিছু তথ্য পাচ্ছি। এখানে একটা লাইন বোল্ড করা আছে, আমার করা। সবচেয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ তথ্য লুকিয়ে আছে ওখানে, তাই। সরাসরি সেখান থেকে শুরু করা যাক। ১৯৬৯ সাল থেকে সোয়াত পাকিস্তানের "ওতেপ্রোত অংশ" হিসাবে পরিগণিত হচ্ছিল।

তার মানে ১. ১৯৬৯ এর আগে এক ভিন্ন শাসন ব্যবস্হা ওখানে ছিল। ২. সোয়াত সবসময় পাকিস্তানের "ওতেপ্রোত অংশ" ছিল না। আর ৩. ১৯৬৯ সালই বা কেন? আমাদের রাজনৈতিক গণঅভ্যুত্থানের গৌরবগাথা ৬৯ এর সাথে এর কী কোন সম্পর্ক আছে? অবশ্যই আছে। আগাগোড়া। জনসংখ্যার হিসাবে ১৯৪৭ সাল থেকেই পূর্ব পাকিস্তান পাঞ্জাব, সিন্ধ, বেলুচিস্তান আর ফ্রন্টিয়ার (NWFP) ও অন্যান্য মিলে সারা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশি ছিল।

১৯৭১ সালের হিসাবেও, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা সাড়ে সাত কোটি আর, সারা পশ্চিমের মোট সাড়ে পাঁচ কোটি। অথচ সমগ্র পাকিস্তানের রাজনৈতিক শাসক আধিপত্যের দিক থেকে মাছের মাথা-মুড়াসহ প্রায় সবাই পশ্চিমের। যার মধ্যে আবার মাখন বড় অংশটা ছিল একাই পাঞ্জাবের। যদি জাতিগত (racial) জনগোষ্ঠি হিসাবে দেখা হয় তবে একা পাঞ্জাব বা সিন্ধের জনসংখ্যা পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যার ধারে কাছেও নয়। সেই না দেখতে চাইলেও সবার চোখে পড়া উদোম ঘটনা ঢাকতে আড়াল করতে ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে কেবল দুই প্রাদেশিক ইউনিটারি ব্যবস্হা ঘোষণা করা হয়।

পূর্ব বাংলা এক প্রাদেশিক ইউনিট আর সারা পশ্চিম মিলে এক প্রাদেশিক ইউনিট। এভাবে ছাড়া কেন্দ্রীয় শাসকের কাছে বাংলার কাছাকাছি জনসংখ্যা দেখানোর আর কোন রাস্তা ছিল না। অথচ জাতিগত (racial) জনগোষ্ঠি বিবেচনায় নিলে স্হানীয় প্রাদেশিক আইন সভা কেবল পূর্ব আর পশ্চিম এভাবে দুইটা প্রদেশ না হয়ে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্হান, ফ্রন্টিয়ার ও বাংলা - এভাবে প্রত্যেকে একএকটা প্রদেশ ও কেন্দ্রের অধীনে সবগুলোর প্রাদেশিক আইন সভা হবার কথা। আমাদের ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান হলো আরও অনেক কিছুর সাথে সেই দুই প্রাদেশিক ইউনিট প্রথার প্রশাসন ভাঙ্গার ইতিহাস ও সাফল্য। ঐ আন্দোলনের একটা অন্যতম দাবি ছিল দুই ইউনিট প্রথা ভেঙ্গে দেওয়া।

আয়ুব খান তা মেনে নেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭০ সালের জুলাই মাসে দুই ইউনিট ব্যবস্হা বিলুপ্ত করে দেয়া হয়। তবে ঘটনা হলো আমরা শুধু দুই ইউনিট প্রথা ভেঙ্গে ফেলেই থেমে থাকিনি, প্রাদেশিক ইউনিট জিনিষটাই আমাদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক করতে পেরেছিলাম। পাকিস্তান খোদ নিপীড়ক রাষ্ট্রটাই আমাদের রাষ্ট্র হিসাবে মানতে অস্বীকার করেছি, নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করেছি। এরপর থেকে দুই প্রাদেশিক ইউনিট প্রথা ভাঙ্গার সুফল পাঞ্জাব বাদে সবাই ভোগ করছে; ৬৯ এরপর থেকে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্হান, ফ্রন্টিয়ার এগুলোর প্রত্যেকটাই কেন্দ্রে অধীনে আলাদা আলাদা প্রশাসনিক প্রদেশ ও প্রত্যেকটাতেই প্রাদেশিক আইন সভা চালু হয়।

এই নতুন আলাদা পাঁচ প্রদেশের আইনসভা ও কেন্দ্রের মোট ৩০০ কনষ্টিটিউয়েন্সী মধ্যে ১৬২ টা বাংলায় ও বাকি ১৩৮ টা পশ্চিমের চার প্রদেশে ভাগ করে ১৯৭০ এর (কনষ্টিটিউশন প্রণয়নের লক্ষ্যে সভার প্রতিনিধি) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সম্ভবত ১৯৭৩ সালের কনষ্টিটিউশনের পর থেকে, সব জায়গায় স্হানীয় প্রাদেশিক আইন সভা চালু হয় সেখানে এবং এখনও তাই চালু। আমাদের রাজনৈতিক মাইলফলকে ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানের গৌরবগাথা এভাবে ইতিহাস হয়ে জড়িয়ে আছে পাকিস্তানের "প্রদেশ রাজনীতি" বা ইউনিট প্রথা রাজনীতির সাথে। কিন্তু আসল প্রসঙ্গ, সোয়াত পাকিস্তানের "ওতেপ্রোত অংশ" ছিল না - এর উত্তরে সবটা এখনও যাওয়া হয়নি। পশ্চিম পাকিস্তান আর এক প্রাদেশিক ইউনিট রইল না তাতে সোয়াতের সাথে এই ইউনিট রাজনীতির সম্পর্ক কী? সে প্রসঙ্গ অনেক বড় আমার সংক্ষেপ করা ছাড়া উপায় নাই।

wiki তে অসমর্থিত কিছু তথ্য পাওয়া যেতে পারে। আমি এখানে কেবল রাজনৈতিক দিকগুলো ধরিয়ে দেবার মধ্যে নিজেকে সীমিত রাখব। দ্বিতীয় পর্বের জন্য Click This Link তৃতীয় পর্বের জন্য Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.