আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেমন আছি সৌদি আরবে -তৃতীয় পর্ব

স্বাগতম

কেমন আছি সৌদি আরবে -তৃতীয় পর্ব (এদেশকে জানতে হলে পড়তে হবে) যখন সৌদি এসেছিলাম তখনও স্যাটেলাইট টিভির যুগ শুরু হয়নি। সৌদি আরবে মাত্র তিনটা টিভি স্টেশন। সৌদি রাজকীয় চ্যানেল আরবী ও ইংলিশ এবং আরামকোর চ্যানেল-থ্রী। এ ছাড়া উচু স্থানে বা ছাদে এন্টেনা লাগিয়ে বাহরাইন ফিফটি ফাইভ চ্যানেল ,দুবাই, কাতার, সারজাহ থেকে কিছু চ্যানেল দেখা যেত। তবে বুধবার থেকে শুক্রবার এই তিনদিন হিন্দি সিনেমা দেখাত বলে আমরা সবাই বেশ উৎসাহ নিয়ে টিভি দেখতাম।

বলে রাখা ভাল যে এখানে কোন সিনেমা বা থিয়েটার হল আজ অব্দি নেই। তাই দেশ থেকে এসে টিভির প্রতি আসক্ত হওয়া ছারা বিকল্প কিছু ছিলনা। প্রথম প্রথম পুরানো বাংলাদেশীদের রুমে গিয়ে টিভি এবং আড্ডা দুটোই চলতো। আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিলাম। লোক বাছাই করে মেলা-মেশার চেস্টা শুরু করলাম।

আমার কলিগ ছিল পাশের রুমে দিল্লির ইঞ্জিনীয়ার নাফিজ সাহেব। আমার থেকে কম করেও দশ বছরের বড়। আমার হিন্দি কথা শুনে হাসতো বলে এতোদিন কথাই বলতামনা। ইদানীং ইংলিশ,আরবী,উর্দু বা হিন্দিতে কথা বলতে শিখে গিয়েছি। তাই নাফিজ সাহেবের সংগে ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম।

তখন তাদের ছিল বিরাট কমিউনিটি। উনার সংগে ঘুরে ফিরে অনেক অভিজ্ঞতা হলো। তাদের দেশীয় হোটেলে মজার মজার খাবার খেতাম। আর তাদের দেশের গল্প শুনতাম। ইন্ডিয়ায় তারা সংখ্যা্লগু হিসেবে কিভাবে নির্যাতিত হতো বা ছোটবেলা থেকেই কি করে হিন্দুদের হাত থেকে আত্নরক্ষার কৌশল শিখে নিতো।

এছারা রায়টের দু একটা লোমহর্ষক ঘটনাও জানলাম। ইতিমধ্যে আমি একটা টিভি ও ভিডিও কিনে ফেললাম। রাতে নফিজ সাহেব মিলে পুরানো হিন্দি ছবি দেখতাম। এই পুরানো ছবি খুজতে কতো না দুরে যেতে হতো। মাঝে মধ্যে তার বন্ধুরাও আমাদের এখানে আসতো,আমাকে পরিচয় করাতেই অনেকে বলতো তুমি বন্ধু(বাংগালীদের ইন্ডিয়ান-পাকিস্তানীরা এই বলে ডাকে)? আমাদের কোম্পানিতেও অনেক বন্ধুভাই আছে।

আমি জানতাম আগে বাড়ালেই বলবে তারা সবাই লেবার, তাদের বেতন ৫০০ রিয়াল,তারা এক লক্ষ টাকা খরচ করে এখানে এসে এখন কাধছে!ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই আমি এসব কথা একদম এড়িয়ে যেতাম। নাফিজও জানতো আমার মন-মানষিকতা তাই তিনিও ওদের থামিয়ে দিতো। আস্তে আস্তে আমি ও নাফিজ ভাল বন্ধু হয়ে গেলাম। তিনি রান্না জানতো আর আমি পাশের বাংলাদেশী দিয়ে রান্না করাতাম।

তাই তিনি একত্রে রান্না করার আমন্ত্রন জানালেন। আমিও তাদের সুস্বাদু খাবারের লোভ সামলাতে পারলামনা। আমি সব হাড়িপাতিল,প্লেট-গ্লাস ধুয়ে মুছে দিই আর উনি রান্না করেন। এরইমধ্যে খবর পেলাম ঢাকায় আমাদের মহল্লার নাজমুল দাম্মাম শহরে একটা ক্লিনিং কোম্পানিতে সুপারভাইজার পদে আছেন বেশ কিছুদিন যাবৎ । আমার অফিসে বেশ কয়েকবার ফোনও করেছিল।

এক উইকএন্ডে চলে গেলাম তার ক্যাম্পে। আমাকে দেখেই জরিয়ে ধরলো। আসলে সে সময় এতো বাংলাদেশী সৌদি আরবে ছিলনা। তাই পরিচিত কাউকে পেলে আবেগে কান্না চলে আসতো। সেদিন নাজমুল নিচের একটি সিরিয়ান রেস্টুরেন্ট আবু-নাওয়াজ থেকে চিকেন ব্রস্টেড আনিয়ে খাওয়ালো।

কারন সে রান্না করে খেতনা। নাজমুল ভাল ফুটবল খেলতো ওর আব্বা ছিলেন ফুড ডিপার্টমেন্টের উচ্চপদের অফিসার। ক্লাবের আড্ডা থেকে দুরে সরানোর জন্যই তাকে নাকি এখানে পাঠিয়ছিলেন। কিন্তু ৬০০রিয়ালের এই চাকুরী থেকে বাসায় কিছুই পাঠানো সম্ভব হচ্ছিলনা। তার মা নাকি আক্ষেপ করে চিঠি লিখেছেন বাবা নাজমুল তোমার সংগে যাওয়া দেশের বাড়ীর আসা্দ শুনেছি ২৫০রিয়াল বেতন পায় কিন্তু সে ইতিমধ্যেই ষাট হাজার টাকা পাঠালো আর তুমি ওদের সুপারভাইজার হয়ে কোন টাকা পাঠালেনা!নাজমুলও কম যায়না,সে আসাদের কিছু ছবি উঠালো।

ডিউটির পর আসাদ যখন গাড়ী ক্লি্নিং অর্থাৎ দশ রিয়াল নিয়ে অন্যের গাড়ী ধুইতে ছিল। ছবি গুলো মাকে পাঠিয়ে প্রশ্ন করল মা আমি কি এই কাজ করে তোমাকে টাকা পাঠাবো? কিছুদিন পর শুনলাম নাজমুলের মা তাকে ফিরে যেতে চিঠি লিখেছেন। তার ছয় মাস পর নাজমুল চলে গেল। এখন সে বৌ পোলাপানসহ ইটালিতে ভালই আছে। একদিন অফিসে গিয়ে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি পেলাম।

খুলে আমার চক্ষু ছানাবড়া!আব্বা পাঠিয়েছেন শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে ইস্যু হওয়া আমার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি। সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে জুনিয়র ইনস্ট্রাক্টর পদে নিয়োগ পেয়েছি। ভেবে পেলেমনা এতোকিছুর পরও চাকুরী হলো কিভাবে!সিদ্ধান্ত নিতে পারছিনা। তাই আব্বার সংগে কথা বলার দরকার। সেই সময় মোবাইল ফোনতো দুরের কথা ডিজিটাল ফোনও আমাদের দেশে চালু হয়নি।

আমাদের ঢাকার বাসায়ও লাইন ছিলনা। তাই পাশের বাসাতে ফোন করে ডেকে এনে কথা বলতে হতো। এখানেও(সৌদিতে)কল কেবিন ছিলনা,বিভিন্ন মার্কেট বা পার্কে কয়েনবক্স টেলিফোন ছিল। একশ রিয়ালে কয়েন পেতাম নব্বুইটি,মিনিটে এগারো রিয়াল চার্জ ছিল। চিন্তা করুন কয়েন ঢালবো নাকি কথায় মনযোগ দেব!আর বংলাদশে লাইন পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যপার!যাইহোক সেদিন পাশের বাড়ী ফোন করে বললাম প্লিজ আব্বাকে একটু ডেকে দিন।

ও প্রান্ত থেকে বললেন ভাই,রাস্তায় অনেক পানি যাব কিভাবে?আমি রেগে গেলাম ঢাকার রাস্তায় পানি?ইয়ার্কি মারছেন,আমি সৌদি থেকে বলছি। না মোজ়ামভাই সত্যি বলছি ঢাকার রাস্তা ঘাট সব পানিতে ডুবে গেছে,বিশ্বাস না হলে কাল সকালবেলা ফোন করবেন আমি খালুকে ডেকে এনে বসিয়ে রাখবো। আগেই বলেছি তখন স্যাটেলাইট টিভির যুগ শুরু হয়নি তাই আমরা জানতেও পারিনি এতোবড় বন্যায় ঢাকা শহর তলিয়ে গিয়েছে। আমার পুরা পরিবার যখন একমাস যাবত পানির সংগে যুদ্ধ করছে আমি তখন জীবন সংগ্রামে সঊদি আরবে দিনানিপাত করছি,হায়রে জীবন! কিছুদিন পর বন্যার পানিতে বাড়ীঘড় ডূবে যাওয়ার বেশ কিছুও ছবি পাঠালো,আর চিঠিতে বিস্তারিত লিখে জানালো। দেখতে পেলাম আমাদের নিচতলা বাড়ী হাটু পানিতে সায়লাব!রাস্তা দিয়ে রিক্সার বদলে নৌকা চলছে! চিঠির প্রসংগ আসতেই বলতে হয়,এখানে চিঠি পেতে আমাদের ১৫দিন লাগতো।

কিন্তু রেজিস্টারড পেতে মাস দুইও লাগতে পারে। কারন চিঠিগূলোর ভেতর কি জাতীয় ছবি আছে ডাকবিভাগ বা অন্য কোন সংস্থা তা পরখ (সেনসর)করে তবেই প্রাপকের হাতে ছিরা খামটা পৌছাতো। এভাবে আমি অনেক চিঠি বা ছবি পাইনি। আবার আমরা এখান থেকে কোন চিঠির ভেতের ছবি পাঠালে খামের মুখ খোলা রেখে পোস্ট করতাম। এখানে আসার পর থেকেই শুনে আসছিলাম মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামীদের এদেশে প্রকাশ্যে গলাকাটা হয়।

আমার খুব ইচ্ছে ছিল এই গলাকাটার দৃশ্য দেখা। এক শুক্রবার জুম্মা নামাজের আগে মহসিন দৌড়াতে দৌড়াতে এসে খবর দিল আজ নামাজের পর গলা কাটবে। আমি দ্রুত তৈ্রী হয়ে চলে গেলাম ঘটনাস্থলে। জুম্মা মসজিদের পাশের এক বিরাট পার্কিংলট পুলিশ একদম খালি করে রেখেছে। চারদিক তাদের কড়া বেস্টনী,ছাদের উপড়ও তারা অবস্থান নিয়েছে।

আমার মতো আরো অনেক লোক নামাজ কাজা করে চারদিক ঘিরে দাড়িয়ে আছে। নামাজ শেষ হতেই একটি এম্বুলেন্স করে অপরাধীকে চোখ ও পিছমোড়া করে বেধে নিয়ে এলো। সে সৌদি নাগরিক বলেই মনে হলো,তাকে দেখে মনে হচ্ছিল আধা মরে গিয়েছে, হাটছিল খুব আস্তে আস্তে। তাকে ধরে এনে হাটুগেড়ে মাথা নিচু করে নিচে বসালো। কালো,লম্বা ও চিকন দেখতে একজন জল্লাদও আমাদের নজরে এলো।

সে তখন কাপড়ে জরানো তরবারি বের করে ধা্র পরিক্ষা করতে ব্যস্ত। আরো লক্ষ্য করলাম সে ঘনঘন সিগারেট ফুকছে এবং আসামীর আশে পাশে পায়চারি করছে। অন্যদিকে পুলিশ ও অন্যএক অফিসার(ম্যাজিস্ট্রেট হবে হয়তো)তার অপরাধের বর্ননা পড়ে শুনাচ্ছিল। তাদের পড়া শেষ হলে অপরাধীকে দোয়া পড়ানো হলো। তারপর পায়চারিরত জল্লাদ হঠাৎ আমরা কিছু বুজে উঠার আগেই তার তরবারি দিয়ে কোপ বসাল।

একটা গেচ শব্দ শুনলাম,চেয়ে দেখি অর্ধেকেরও বেশি লোক দৌড়ে পালাচ্ছে,আমিও ভো দৌড়। দুমিনিট পর হুশ হলো পালাচ্ছি কেন,দেখিইনা কি হয়!আমি একাই ফিরে এসে দেখি ঐ অফিসার মৃত্যু নিশ্চিত করতে নার্ভ দেখছেন। মাথা নেড়ে বললেন মরেনি। জল্লাদ আবারও তার গলায় কোপ দিলেন,তারপর তরবারি দিয়ে খুচিয়ে দেখছে ধর কেটেছে কিনা, এবার আমি স্পষ্ট দেখলাম। তারা নিশ্চিত হলেন এবার মারা গিয়েছেন।

ঘাড় কেটে মাথা মাটিতে পড়ছে জল্লাদ তার তরবারি নিয়ে পুলিশের গাড়ীতে করে চলে গেল। এম্বুলেন্সের লোকজন মৃতের পা ধরে টেনে হিচরে গাড়ীতে তুলে চলে গেল। সংগেসংগে মিউনিসিটিপ্যলের ক্লিনার এসে সব রক্ত পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললো। আমি এক সিনেমা সদৃশ ভয়াবহ বাস্তব দৃশ্য দেখে কাপতে কাপতে রুমে ফিরে এলাম। (চলবে)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.