আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিরে দেখা আঁতুড় ঘর/৮



ভয় আর নানা অনিশ্চয়তার মধ্যে কেটে গেল প্রায় দু'মাস । এরমধ্যে একদিন ডিউটি থেকে ফিরে মেজদা জানালো আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে । ভালো রেজাল্ট হয়েছে । শিলিগুড়ির অবস্থা একটু ভালো । ফেরা যাবে ।

বি এস সি তে ভর্তি হওয়ার আবার আমার সাধ জেগেছে । এদিকে নক্সালরা বলছে বুর্জোয়া শিক্ষা ব্যবস্থা জ্বালিয়ে দাও । শুধু বলছেনা অনেক স্কুল কলেজ পোড়ানো হয়েও গেছে । তবু আমার সাধ অটুট । আমি বি এস সি পড়বো।

কীভাবে কী হবে জানিনা । এদিকে রাজ্যে রাস্ট্রপতির শাসন । নক্সাল, সিপিএম, আর কংগ্রসের পারস্পরিক লড়াই অব্যাহত গতিতে চলছে । অবশ্য এত দিনে সমীকরণটি তৈরী হয়ে গেছে । যেহেতু সর্বশেষ সিপিএম ভেঙে নক্সাল (সিপিআইএমএল) তৈরী হয়েছে তাই নক্সাল বিপ্লবীদের প্রথম শ্রেণীশত্রু হলো সিপিএম ।

তাই সিপিএম হত্যাযোগ্য । আবার ১৯৬৭ সাল থেকে কংগ্রেস কে ক্ষমতার বাইরে বের করেছে সিপিএম ,তাই কংগ্রেসেরও শত্রু সিপিএম । সুতরাং শত্রুর শত্রু স্বাভাবিক মিত্র । দেখা গেছে অনেক জায়গায় কংগ্রেস নক্সাল ভাই ভাই । ঐ সময় আমার সাদা মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিলো যে একজন কম্যুনিষ্ট একজন কম্যুনিষ্টকে হত্যা করার জন্য একজন বুর্জোয়ার সহায়তা নেয় কীভাবে ।

না কোনো উত্তর ছিলনা । আসলে এটাই শাসকবুর্জোয়ার মিলিত ষড়যন্ত্র ছিলো । কারণ সামনে এগিয়ে আসছিলো নির্বাচন । আর নির্বাচনে জিততে হলে যে পেশী শক্তির প্রয়োজন তা একমাত্র এই লুম্পেন মিশ্রিত নক্সালরাই দিতে পারবে । উপরন্তু তারা নির্বাচন বিরোধী ।

ফলে নির্বাচন কেন্দ্রীক ক্ষমতার প্রশ্নটিও এ ক্ষেত্রে নেই । পুলিশ প্রশ্নটিকে আরো সুচারু রূপে দেখে । তারা নক্সাল এবং সিপিএম উভয়ের নিধনের জন্যই রাজ্য জুড়ে ফাঁদ পেতে ফেলেছে । ফলে পশ্চিম বঙ্গে সেই সময় ছোট বড় কয়েকটি গণহত্যার ঘটনাও ঘটে । তার মধ্যে কলকাতার বরানগর কাশীপুর হত্যাকান্ড অন্যতম ।

এই ধরণের হত্যাকান্ডগুলো পুলিশাশ্রিত কংগ্রসের গুন্ডারাই চালাত । লক্ষ্য থাকতো সেই সিপিএম এবং অবাধ্য নকশালরাই । আর এসব কারণে যেমন হঠাৎই দেখা যাচ্ছিলো নক্সাল গ্রুপ গুলোর মধ্যে তৎকালীন কুখ্যাত যুবকংগ্রেসীরা ভিড়তে শুরু করেছে । ভেতরে ভেতরে লোভ ছড়াচ্ছে যে পুলিশের ব্যাপারটা তারা দেখবে । পুলিশ ছুঁলে আঠারো ঘা ।

সুতরাং অলিখিত একটা গ্রুপ জন্ম নিলো নাম 'কংসাল' । অবশ্য এই প্রচারটা করতো সিপিএমই । কারণ এই সাঁড়াশি আক্রমনের মুখে তাদের তখন অস্তিত্বের সংকট । অথচ এটা ভাবলে ভীষণ অবাক লাগে যে এ বাংলায় বামপন্থিয়ানার মেঘ তখন এত প্রবল যে পাশের দেশটিতে চলা একটা জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ তাদের মনযোগ আকর্ষণ করতে পারছেনা । সেই যুদ্ধে লিপ্ত স্বজন স্বভাষীদের জন্য এই বিপ্লবের পক্ষ বিপক্ষ কেউই বিশেষ চিন্তিত ছিলেন বলে মনে হয়না ।

অবশ্যই এটা আমার সেই বয়সের উপলব্ধি । রাজনীতির এক মরণমুখি তাড়না তখনকার পশ্চিমবঙ্গকে যেন শুধুই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে । এই আবর্তনে পড়ে সেইসব মানুষেরা যারা উদ্বাস্ত, যাদের স্বজনরা তখনও পড়ে রয়েছে ওখানে তারা শুধু নীরবে আবার এক দুঃস্বপ্নের আড়ালে মুখ ঢেকে গুনছে অনন্ত প্রহরের কাল । প্র‌থম কথা, যুদ্ধটা ,যতই পেছনে ভাষা থাকুক ,এটা একটা জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ । যা বুর্জোয়া পাতিবুর্জোয়ারা করে থাকে ।

এতে সর্বহারাদের ভূমিকা নেই কিছু । এটা তো সর্বহারাদের বিপ্লবের যুগ । কারণ সর্বহারাদের একনায়কত্ব ছাড়া দেশের খেটে খাওয়া মানুষের মুক্তি নেই । বিপ্লবের সর্বশেষ ভার্সান মাওবাদ তাই বলে । কপিবুক বিপ্লব, কপিবুক মার্কস মাও চর্চার বেদীতলে কত যে রক্তাক্ত প্রাণ স্থবির হয়ে গেছে তার হিসেব নেই ।

আসলে একটু পেছনের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় ৭০ দশকে দাপিয়ে বেড়ানো বিপ্লবীদের পূর্বজরাও বঙ্গভঙ্গ, দেশভাগ, স্বাধীনতা,দ্বিজাতীয়তা কোনো ব্যাপারেই তারা তাদের অবস্থান, ভূমিকাকে স্পস্ট করে তুলতে একই ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলো । বরং নানা সাময়িক বিতর্কিত অবস্থানের জন্য পরবর্তীতে ভুল স্বীকার বা সংশোধনের আয়োজন করেছে । সমালোচকেরা বলে থাকেন যে একসময় দেশভাগের সমর্থক বামপন্থীরা পশ্চিমবঙ্গে তাদের রাজনৈতিক শক্ত ভিত বানিয়েছে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের দ্বারা । শিলিগুড়ি ফিরে এসে যেদিন কলেজে আবার ভর্তি হলাম তার পরদিনই খবর এলো মা বাবা সমেত আমাদের বাকি পরিবার সেই বাঘমারা ক্যাম্পে এসে আশ্রয় নিয়েছে । বড়দা'র নির্দেশে আমি তার পরদিনই রওনা হয়ে গেলাম বাঘমারার উদ্দেশ্যে ।

মা বাবা সমেত সবাইকে নিয়ে আসার জন্য । সেই বাঘমারা, যেতে যেতে একটু স্মৃতিতাড়িতও লাগছিলো মনে হয় । পথে পড়ছিলো সেই তুরা, ডালু ক্যাম্প ইত্যাদি । তবে এবার দৃশ্যের বদল ঘটে গেছে । পথে পথে গাড়ি থামিয়ে সামরিক বাহিনীর তল্লাসী ।

সংগে পরিচয় পত্র না থাকলে ডালুর পরে আর এগোতে দিচ্ছেনা । পথে দু এক জায়গায় ট্রেনিং ক্যাম্প দেখা গেছে । বাসের যাত্রীরা বলাবলি করছিলো ওগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প । (ক্রমশঃ)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.