আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

( কল্পগল্প ) --- পেইনি

সখা, নয়নে শুধু জানাবে প্রেম, নীরবে দিবে প্রাণ, রচিয়া ললিতমধুর বাণী আড়ালে গাবে গান। গোপনে তুলিয়া কুসুম গাঁথিয়া রেখে যাবে মালাগাছি। এই ব্লগের©শান্তির দেবদূত।

১. দোকানটার উপরে বিশাল জমকালো সাইনবোর্ডে "দ্যা পেইনি" লেখাটা জ্বলজ্বল করছে, প্রীহা অনেকক্ষণ ধরেই আশে পাশে ঘুরাঘুরি করছিলো কিন্তু ঢুকতে সাহস পাচ্ছিলো না। অবশেষে যা হবার হবে ভেবে সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে দোকানে ঢুকে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়।

একটা মেয়েকে ঢুকতে দেখে কাউন্টারে বসা লোকটা একটু চমকে উঠে, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে , "জ্বী, ম্যাডাম বলেন আপনার জন্য কি করতে পারি" "গতকাল টিভিতে আপনাদের বিজ্ঞাপণ দেখে এসেছি" লোকটার চোখে চোখ রেখে বললো প্রীহা। কোন রকম ভনিতায় না গিয়ে লোকটা বললো, বুঝতে পেরেছি আপনি কি পেইনি ডোজ নিতে এসেছেন ? অস্হিরভাবে মাথা নাড়ে প্রীহা । ম্যাডাম, প্রথম মাত্রার ডোজটা আমরা ফ্রী দিয়ে থাকি, আর আপনি যেহেতু আমাদের প্রথম মহিলা কাস্টমার সেই হিসাবে আপনাকে আমরা দ্বিতীয় মাত্রার ডোজ পর্যন্ত ফ্রী দিতে পারি। তাই ? জ্বী, তাহলে আপনি একটু বসুন আমি যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছি, কোন চিন্তা করবেন না, আমি নিজে আপনাকে ব্যবহার বিধি বুঝিয়ে দিবো। আশা করি আপনি আমাদের সার্ভিস পেয়ে নিরাশ হবেন না, বলেই লোকটা নোংরা দাঁত বের এমন বিশ্রীভাবে হাসলো যে এক অজানা ভয়ে সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো প্রীহার।

এই মুহূর্তে প্রীহার ইচ্ছা করছে ইস্, এক দৌড়ে পালিয়ে যেতে পারতাম ! কিছুক্ষণ পরে লোকটা এক জোড়া হাত মোজা, একটা পাতলা সিলিকনের প্যাড, এক বোতল ম্যানথল আর দশ ইঞ্চি ব্লেডের একটা ছুরি নিয়ে ঘরে ঢুকলো। প্রীহাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বললো, আপনি এই করিডোর দিয়ে গিয়ে একশ পঁচিশ নাম্বার ব্লকে ঢুকবেন। আপানার সময় হলো এক ঘন্টা বিশ মিনিট তারপর বের হয়ে এলে আমিই আপনাকে বাড়ি পৌছানোর জন্য টেক্সিতে উঠিয়ে দিবো । লোকটার হাত থেকে জিনিসগুলো নিয়ে প্রীহা করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে একশ পঁচিশ নাম্বার ব্লক খুঁজে খুঁজে এগিয়ে যাওয়ার সময় আশেপাশের ব্লক থেকে গোঙ্গানী, আনন্দধ্বনি, আহ্ উহ্ ইত্যাদি অদ্ভুত সব শব্দ তার কানে আসতে থাকে। এইসব কিছুকে পাত্তা না দিয়ে সে তার নির্দিষ্ট ব্লক খুঁজে পেয়ে তাতে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

দুই মিটার বাই দুই মিটারের ছোট একটা ব্লক, মাঝখানে একটা রোলিং চেয়ার বসানো, আর একটা ছোট গোল টেবিল, মাথার উপর কম পাওয়ারের একটা ডিম লাইট। হাতমোজা গুলো পড়ে গেঞ্জির বা-হাতাটা টেনে উপরে তুলে উদম বাহুতে সিলিকনের প্যাডটা পেঁচিয়ে নেয় প্রীহা, তারপর সিলিকনের প্যাড থেকে বের হওয়া পাঁচটা স্বর্ণের তার পাঁচটা আঙ্গুলের নোখের মাথায় ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে তুলে নেয় ছুরিটা। এক ঘন্টা বিশ মিনিট পর টলতে টলতে "দ্যা পেইনি" থেকে বের হয়ে টেক্সিতে উঠে প্রীহা। এইসময় তার সারা শরীর মন বিষাদে ডুবে ছিলো, বার বার হাটু ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছিলো সে, শুধু চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছিলো অঙ্গারের মত। ২. সকাল থেকেই অস্হির লাগছে প্রীহার, একটু পরপর সময় দেখছে আর ভাবছে কখন সন্ধ্যা হবে ।

সারা মাস তীর্থের কাকের মত অপেক্ষা করে কখন মাসের শেষ সাপ্তাহিক ছুটির দিন আসবে ! সবসময়ই শেষে এসে আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারে না সে, এই দিনে সকাল থেকেই ঘরময় হাটাহাটি শুরু হয়ে যায় তার। আজ নির্ধারিত সময়ের আগেই সে চলে যায় "দ্যা পেইনিতে" । কাউন্টারে বসা লোকটা একটু মুচকি হেসে বলে ম্যাডাম, আপনার সময়তো এখনও আসেনি ! আমি ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করবো, সময় হলে আমাকে ডেকে দিবেন। ও, আর একটা কথা, আপনারা কি কোন ভাবে সার্ভিসটা মাসিক থেকে সাপ্তাহিক করতে পারেন না ? ম্যাডাম, আসলে বিজ্ঞান কাউন্সিল থেকে আমাদেরকে মাসে একবারের বেশি পেইনি ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয়নি, তাই ইচ্ছা থাকলেও আমরা দিতে পারবো না, দুঃখিত । পঞ্চম মাত্রার ডোজের সিলিকনের প্যাড বাহুতে পেঁচিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকে প্রীহা, চাপা নিঃশ্বাসটা আস্তে আস্তে ছাড়ে তারপর ছুরিটা হাতে নিয়ে আচমকা গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে পোঁচ মারে সিলিকনের প্যাডে ।

গলা চিড়ে বের হয়ে আসে গগন ফাটানো তীব্র চিৎকার, ব্যাথায় হাত পা থরথর কাঁপতে থাকে, হাতের মুঠি জোরে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে থাকে প্রীহা কিছুক্ষণ। তারপর বোতল থেকে কিছু তরল ম্যানথল নিয়ে প্যাডের উপর মালিশ করে দেয় সে, নিজের অজান্তেই পরম সুখের ধ্বনি 'আহঃ' বের হয়ে আসে তার মুখ দিয়ে। কিছুক্ষণ পর হাতে পেঁচানো প্যাডে আবার গায়ের জোরে ছুরি চালায় সে, মূহূর্তেই প্যাড থেকে ব্যাথার অনুভূতিগুলো স্বর্ণের তারের মধ্যে দিয়ে আঙ্গুল পর্যন্ত পরিবাহিত হয়ে যায়, আঙ্গুল থেকে এই অনুভূতি মস্তিষ্কে যেতে সময় নেয় যেন অনন্ত কাল ! উহঃ কখন শেষ হবে এই ভয়ংকর ব্যাথা !! দশ সেকেন্ডের জন্য চেতনা হারিয়ে ফেলে প্রীহা, তারপর ম্যানথল মালিশের কারনে তীব্র ব্যাথার পর আসে তীব্র সুখের অনুভূতি ! পৃথিবীর কোন অনুভূতির সাথে এর কোন তুলনা নেই, সে এক স্বর্গীয় অনুভূতি ! ইস্ চিরদিন এই অনুভূতি ধারন করতে পারতাম, মনে মনে ভাবে প্রীহা। আবার ছুরি চালায় সে , আবার ম্যানথল মালিশ, আবার ছুরির পোঁচ আবার ম্যানথল মালিশ, একসময় অনুভূতি সর্বোচ্চ স্তরে পৌছে যায় প্রীহা, ব্যাথা বা সুখের কোন অনুভূতিই আর অবশিষ্ট থাকে না তার। টলতে টলতে ব্লক থেকে বের হয়ে আসে সে, বাড়ি ফেরার তাগিদে, আবার সেই একাকি ফ্ল্যাট, সেই একঘুয়েমি চাকুরি, সেই অনুভূতিহীন জীবন ! ৩. প্রীহাকে দেখে একটু অবাকই হয় কাউন্টারের লোকটা, তার তিন বছরের অভিজ্ঞাতায় সে দেখেছে, কোন কাস্টামারই অষ্টম ডোজের পরে আর এই দোকান মুখি হয় না, সেই হিসাবে প্রীহার আজকে দশম ডোজ হবে।

কি জানি , মনে হয় মেয়েদের স্বাভাবিক অনুভূতিগুলো খুব বেশি প্রখর নয়, তাই তারা বাহিরের অতিরিক্ত অনুভূতি সহ্য করতে পারে, ভাবে সে। দশম মাত্রার ডোজে ছুরির প্রথম পোচেই জ্ঞ্যান হারায় প্রীহা, এমন কি চিৎকার দেওয়ার সময়টাও সে পায় নি। এক ঘন্টা পর তার জ্ঞ্যান ফিরে, ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায় সে, সেই চোখে নেই কোন প্রাণ, নেই কোন অনুভূতি, একেবারে শতভাগ শুন্য দৃষ্টি। সাথে সাথে এলোমেলো পা ফেলে বের হয়ে আসে সে তার ব্লক থেকে। ট্যাক্সি নিয়ে কিভাবে বাসায় এসেছে বলতে পারবে না, ট্যাক্সি ড্রাইভারকে কোন রকমে শুধু বাসার নাম্বারটা বলতে পেরেছিলো এতটুকুই তার মনে আছে।

ঘরে ঢুকে সোফার উপর বসে থাকে কিছুক্ষণ, চুপচাপ নিথর নিশ্চুপ । বের হওয়ার সময় টিভি বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলো, খবর হচ্ছে তাতে, রিপোর্টার অতি দ্রুতবেগে কি সব বকে যাচ্ছে, সমগ্র বাসায় শব্দ বলতে এতটুকুই, তবে তার কোন কিছুই মাথায় ঢুকছে না প্রীহার। চোখ দিয়ে অনবরত ঝরছে জল, মাঝে মাঝে শুধু ফুঁপিয়ে উঠছে সে, একটু একটু কেঁপে উঠছে সমগ্র শরীর একটু পর পর। মানুষের অসীম সংখ্যাক অনুভূতির মাত্র একটা অনুভূতিই ধারন করতে পারছে না প্রীহা ! নিজেকে অনেক অনেক তুচ্ছ মনে হয় তার, এই আমাদেরই এত অহংকার ! আমরা পৃথিবীর সর্বকালের সবচেয়ে অগ্রগামী জাতি, জ্ঞ্যান বিজ্ঞানে চরম শিখরে উঠে বসে আছি আমরা ! অথচ মানুষের একটা মাত্র অনুভূতির কাছেই আমার পরাজিত ! ঘোরের মধ্যে চলে যায় প্রীহা, কাঁপা কাঁপা পদক্ষেপে ড্রায়ারটা খুলে, টান দিয়ে বের করে আনে এটোমিক ব্লাস্টার, ধীরে ধীরে মাথায় তাক করে ভয়ংকর এই আগ্নেয়াস্ত্রটা, টেনে দেয় ট্রিগার, মুহূর্তের মধ্যে মাথার অংশটা উধাও হয়ে যায় প্রীহার, শুধু গলার উপর দিয়ে কতগুলো পোড়া তার ও ঝলসানো আই.সি বের হয়ে ঝুলতে থাকে। ঐদিক দিয়ে রিপোর্টার বলে চলছে, "গত দুই বছরে আত্মহত্যার হার আশংকাজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বেশ কিছু দিন আগে সেন্টাল ইন্টিলিজেন্স এজেন্সী তদন্তে নামে।

তাদের রিপোর্টে "দ্যা পেইনি" নামক একটা বিনোদনমূলক সংগঠনকে এর জন্য দায়ী করা হয়। আজ সকালে সেই রিপোর্টের উপর ভিক্তি করে বিজ্ঞান কাউন্সিল "দ্যা পেইনিকে" ব্যান ঘোষনা করে এবং পৃথিবী থেকে অপসারিত মানুষের কোন রকম আবেগ অনুভূতির উপর গবেষণা নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছে চিরদিনের জন্য ............ "

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।