আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এটি ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা হতে পারে



নিজস্ব আয়নায় পিতামহের ছবি দেখি আব্বা বলতেন, তার পিতামহেরও প্রপিতামহ নাকি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন আট দশ পুরুষ পর তার মতো অবিকল চেহারা হবে তারই উত্তর পুরুষের কোনো একজনের। এবং তিনি নাকি গড়েছিলেন প্রাচীন বটেশ্বরী আর ব্যাবিলনের কোনো এক লুপ্ত গোলাপের বাগানে নগ্ন রমণীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন বুকের পাঁজর। ঠিক এমন ভাবনাই হয়তো ভাবতেন উয়ারী-বটেশ্বরের আবিষ্কারক হানীফ পাঠান। স্কুলে যাওয়ার সময় রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে গভীর দৃষ্টিতে চোখ রাখতেন পথের ওপর। এমন সব জিনিসপত্র তিনি হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন, যা দেখলে লোকে চোখ বড় করে তাকাতো।

এমনকি নিজের সন্তান হাবিবুল্লা পাঠানও প্রথমদিকে এসবের মর্ম বুঝতে পারতেন না। গত ২১ এপ্রিল উয়ারী-বটেশ্বর দেখতে গেলে হানীফ পাঠান বলেন ১৯৫৫ সালের কথাÑ বাবা উয়ারী-বটেশ্বর নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখলেন দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে আমাকে পড়ে শোনালেন। আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। কিন্তু একবার পড়েই ক্ষান্ত হননি।

বেশ কয়েকবার জোরে জোরে পড়ে শোনালেন। বাবার আগ্রহ থেকেই আমার মনের ভেতর এ বিষয়টি গেঁথে গেছে। বলতে পারেন বাবার প্রভাবেই আমি এতদিন ধরে নিভৃতে কাজ করে যাচ্ছি। শুধু তাই নয়, বাবা হানীফ পাঠানের মতো উত্তরাধিকার সূত্রে তিনিও পেয়েছেন সেই শকুন দৃষ্টি। বাবার পথ অনুসরণ করে পথে-প্রান্তরে খুঁজে বেড়িয়েছেন স্বপ্নের সভ্যতার নির্দশন এবং এখনো চলছে সে প্রক্রিয়া।

নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন একটি ব্যক্তিগত সংরক্ষণাগার। বাংলাদেশ জাদুঘরে দিয়েছেন বেশ কিছু সংগ্রহ। মূলত হানিফ পাঠানের প্রতœতাত্ত্বিক দূরদৃষ্টির জন্য এলাকাটি সবার নজরে আসে। আধুনিক প্রতœজ্ঞানের এতসব কলাকৌশল তিনি জানতেন না। কেবল নিজের আগ্রহ আর লোকজ্ঞানের আলোকে এ স্থানটি নিয়ে অতি আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন।

তিনি নরসিংদীর এ স্থানটিকে একটি সভ্যতা বলে দাবি করতেন। যদিও হাল আমলে আধুনিক প্রতœবিদরা এ স্থানটির এত বড় সম্ভাবনা না দেখলেও একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না। তবে তার যোগ্য উত্তরসূরি স্বশিক্ষিত প্রতœবিদ হাবিবুল্লা পাঠান এখনো তার বাবার ভবিষ্যদ্বাণীকে বিশ্বাস করেন। তিনি সে দিনের ( ২১.০৪.০৯ ) আড্ডায় বাবার কথার পুনরাবৃত্তি করে বলেন, এটি ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা না অন্য কিছু তা জানার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গবেষণা। আমরা এখনো স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারিনি, আসলে এ স্থানটি কী ছিল? আমি এ বিষয়ে অনেক সেমিনারে প্রবন্ধ পড়েছি।

বাবার মতো আমিও ওইসব স্থানে বলেছি, এটি ব্রহ্মপুত্র সভ্যতা হতে পারে। যা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। যদি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগোনো যায় তাহলে হয়তো এর প্রকৃত ইতিহাস একদিন উন্মেচিত হবে। আমার এ ধারণার সঙ্গে শিক্ষিতজনরা একমত হননি। তবে অনেকেই তাচ্ছিল্য করেছেন।

হানীফ পাঠান তার জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি তার স্বপ্নের সম্ভাবনার সভ্যতার উৎখনন কাজ। তিনি কেবল চাষাবাদ, নালা কাটা কিংবা নিত্যপ্রয়োজনে মাটি কাটা হলে যেসব জিনিসপত্র বেরিয়ে আসতো এগুলো সংগ্রহ করে এর সম্ভাবনাকে নির্দেশ করেছেন। অনেক সময় দেখা গেছে ভারী বর্ষণের ফলে মাটির নিচ থেকে বের হয়ে আসা প্রাচীন বস্তু কুড়িয়ে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন। এসব কিছুই তিনি করেছেন গত শতকের তিরিশের দশকে। সেই সময় তার এ কাজ প্রফেশনাল প্রতœবিদের দৃষ্টিগোচর হয়নি।

অবশ্য দৃষ্টিগোচর না হওয়া নিয়ে প্রতœগবেষক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের বক্তব্যটি যথাযথ বলে মনে হয়। তিনি লিখেছেন, এটা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ অন্যান্য প্রতœস্থলের মতো উয়ারী-বটেশ্বরে মাটির উপরে তেমন কোনো দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থাপনা নেই। আর দশটা গ্রামের চেয়ে উয়ারী-বটেশ্বর আলাদা কিছু নয়। উয়ারী-বটেশ্বর দীর্ঘদিন জনমানুষের অগোচরে থাকলেও ১৯৮৯ সালে এ অঞ্চলে প্রতœজরিপ চালানো হয়।

আর ২০০০ সালে শুরু হয় প্রতœতাত্ত্বিক খনন। ইতিমধ্যে খননের ফলে অনেক সম্ভাবনার কথাই বলা যায় এবং অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ব্রহ্মপুত্র ও আড়িয়াল খাঁ নদীর তীরে অবস্থিত এ স্থানটি প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো। এ রকম মনে করার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও রয়েছে। ২০০০ সালের খনন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে জানা গেছে এখানে ৬০০´৬০০ বর্গমিটার আয়তনে চারটি দুর্গপ্রাচীর রয়েছে।

অন্যদিকে এ স্থানটির পাশে ব্রহ্মপুত্র নদের উপস্থিতির জন্য মনে করা হচ্ছে এটি ছিল নদীবন্দর। এ স্থানটি সম্ভবত ব্যবহৃত হতো বাণিজ্য বন্দর হিসেবে। এ ধারণাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এখানে প্রাপ্ত প্রতœবস্তু। যেমনÑ পুঁতি প্রাপ্তি, রাজকীয় ও জনপদের মুদ্রা আবিষ্কার এবং বাটখারার ব্যবহার। তবে এখন পর্যন্ত যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে তা থেকে নিশ্চিত করে বলা যায় এখানে একদিন নগর ছিল।

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশিয়া প্রতœতত্ত্ব বিভাগের প্রধান দিলীপ কুমার চক্রবর্তী টলেমির উল্লিখিত বাণিজ্য নগরী সোনাগড়া হিসেবে এ স্থানটিকে মনে করেন। প্রতœবিদ সুফি মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন রোলেটেড মাটির পাত্র, স্যান্ডউইচ কাচের পুঁতি, নবযুক্ত কাচের পাত্র, হরেক রকমের পুঁতি, মন্ত্রপূত কবচ প্রভৃতি থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে উপমহাদেশের অনেক স্থানের সঙ্গে উয়ারী-বটেশ্বরের যোগাযোগ ছিল। উয়ারী-বটেশ্বর কি সভ্যতা না প্রাচীন কোনো জনপদ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। দিলীপ কুমার চক্রবর্তীর মতে, উপমহাদেশে যে ষোড়শ মহাজনপদ ছিল সে জনপদের রাজধানী উয়ারী-বটেশ্বর। এখানে খনন কাজ শুরু হওয়ার পর থেকেই নতুন নতুন প্রতœবস্তু আমাদের ইতিহাসের সম্ভাবনাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলছে।

এ স্থানে পাওয়া গেছে নব্য প্রস্তর যুগের হাতিয়ার। যদিও সুনির্দিষ্ট করে এ যুগের কিছু খোঁজা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, হাতিয়ারগুলো প্রাগৈতিহাসিক যুগের ইঙ্গিত করে। তারা ভাবছেন এ অঞ্চলে হয়তো সে সময়ও মানুষের বসতি ছিল। অবশ্য যা এখন আবিষ্কার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ যাবৎকালে উয়ারী দুর্গনগরীর বাইরে আরো ৪৭টি প্রতœস্থান আবিষ্কৃত হয়েছে। নিবিড় অনুশীলন আর গবেষণার ফলে হয়তো একদিন প্রমাণিত হতে পারে আমাদের পূর্বপুরুষদের সোনালি দিনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।