আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: দূরের রক্তবৃষ্টি ও সুখি ছেলেমেয়েদের যৌথনাচ ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

আজও সন্ধ্যার পর থেকে ভাল্ লাগছিল না শান্তনুর । বাইরে ঝিরঝির বৃষ্টি। এরকম সময়ে বিষাদ ভর করল।

বিষাদটা কাটাতেই রেইনকোটটা নিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লোকাল একটা বারে ঢুকেছিল । জিনিসটা আগে তেমন খেত না -কেবল কল্যাণীতে অপলা বৌদির বাড়ির রোববারের আড্ডায় ...। এখানে এসে তক নিয়মিত হয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা। কী আর করা- একলা বৈদেশিকী মনোযন্ত্রণা ...কিংবা, নিঃসঙ্গ পরবাস। এখনও কবিতা লেখে শান্তনু ...যে কারণে ওর ভাবনায় কবিতার শব্দ ভর করে ।

বারের ভিতরে খদ্দেরের ভিড় তেমন ছিল না। ( এদের অবশ্যি খদ্দের না-বলাই ভালো) ...বাইরে ততক্ষনে জোর সন্ধ্যা নেমে গেছে। ম্লান আলো জ্বলে ছিল ভিতরে। বাতাসে ভাসছিল হুইশকির গন্ধ। কাঠের টুলের ওপর সামান্য ঝুঁকে বসা শান্তনুর কন্ঠনালী দিয়ে নেমে যাচ্ছিল ঈশৎ তেতো তরল স্কটিশ ঝাঁঝ।

সহসা কী কারণে শক্তির দুটো লাইন খেয়ালে এল- ঘরে ফিরে এ দৃশ্য কোন্ দৃশ্যে মেলাব ক্যাম্প করে রাত্রিবাস করে দেখব আমার উঠানে ... কবিতার নামটাই মনে পড়ছে না। ধুরচ্ছাই। সহসা ওর চোখ দুটো চলে যায় কাউন্টারের বাঁ-পাশের দেয়ালে সাঁটা বড় টিভিটার মনিটরে। বাগদাদের রাস্তায় আমেরিকান সৈন্যদের সশস্ত্র টহল... দৃশ্যটায় কী ছিল ... ভিতরে ভিতরে প্রবল ঝাঁকি খেল সে। শান্তনুর মনের বিষাদের ধরন গেল বদলে।

এতক্ষণ কোলকাতার জন্য মন খারাপ হচ্ছিল ওর। এখন মধ্যপ্রাচ্যের একটা বিপর্যস্ত দেশের জন্য বিষাদ বোধ করতে থাকে ও। আশেপাশে তাকায়। পাশেই নীল টি-শার্ট পরা মধ্য বয়েসী শনচুলো লালচে একটা মার্কিনীরা বসে ...নির্বিকার ... শেষটুকু গলায় ঢেলে বিল মিটিয়ে দ্রুত বারের বাইরে চলে এলো শান্তনু । ঝিরঝির করে বৃষ্টিটা পড়েই যাচ্ছিল।

দু-বছর হল এ দেশটায় আছে শান্তনু; এই সময়টায় বেশ বৃষ্টিপাত হয় সিয়াটলে । হায়, বৃষ্টি তুমিও তো কোলকাতায় ঝর ... রাস্তায় সার সার গাড়ি, পেট্রলের গন্ধ, হর্নের আওয়াজ, হেডলাইটের আলো; ভিজে ফুটপাতে সেই আলো এসে পড়েছে। ফুটপাতটা প্রায় ফাঁকা। প্রায়ই সন্ধের পর এ ফুটপাতটা ধরে একা একা হাঁটে শান্তনু। ডান দিকে বাঁক নিলে সরকারি একটা পার্ক।

ফুটপাত ঘেঁষে সাদা রং-করা কাঠের রেলিং ...ওপাশে ওক গাছের ঘন সারি ...আরও কী সব গাছ। হাঁটতে হাঁটতে গাছের বাকলের ভিজে গন্ধ পায় শান্তনু ...বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে ওঠে। বিষাদ কাটছে না ... বাগদাদের রাস্তায় আমেরিকান সৈন্যদের সশস্ত্র টহল ... বাগদাদ জ্বলছে ... প্যান্টের পকেট থেকে মালবোরোর প্যাকেট আর লাইটারটা বার করে, দাঁড়িয়ে, কৌশলে বৃষ্টি এড়িয়ে সাদা একটা সিগারেট ধরিয়ে আবার হাঁটতে থাকে শান্তনু । কোলকাতায় থাকতে নিয়মিত সিগারেট খেত না শান্তনু-ঐ শ্যাম বাজারের ধ্রুবর পাল্লায় পড়ে মাঝেমাঝে ...। এখানে এসে নিয়মিত হয়ে যাচ্ছে।

নিঃসঙ্গ পরবাস। তা ছাড়া- সঙ্গীতা রায়ের মুখখানা খুব মনে পড়ে ... কেবলই সঙ্গীতা রায়ের মুখটা মনে পড়ে ... অত্যন্ত নিমর্মভাবে ফিলটারটায় কষে টেনে তামাক পোড়া অনেকটুকু ধোঁওয়া বুকের ভিতরে ঠেলে দেয় সে। সঙ্গীতারা থাকে রাসবিহারী এভিনিউ ... থাক। কে হায় হৃদয় খুলে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে? ডান পাশের পার্কের ওক-পাইনের পাতার ওপর বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দ ক্ষীন; ভিতর তত অন্ধকার নেই, নিয়ন আলোও জ্বলছে। তাতেও গাছপালা আবছাই দেখায়।

পার্ক কি তপোবন? সহসা এই প্রশ্নটা ভেসে ওঠে মাথার ভিতরে। তপোবনের সমাহিত ধ্যানী পরিবেশ কি সাজানো গোছানো পার্কে পাওয়া যায়? তাও আবার মার্কিন মুলুকের পার্কে! রেইনকোট পরা লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে পার্কে। কেমন, নিশ্চিন্ত আর সুখি ওরা । ঐ আমেরিকানরা। সুন্দর দেশের সুন্দর মানুষ।

... বড় সুন্দর দেশ এই আমেরিকা। তবে এ সৌন্দর্য ধরে রাখতে হলে চাই ট্রিলিয়ন- ট্রিলিয়ন টন তেল। হ্যাঁ। ভীষণই তেলের তৃষ্ণা দেশটার - বড় তেল খায় এ দেশটা । এখন যেমন ইরাকের তেল শুষে খাচ্ছে ... ঝির ঝির বৃষ্টির ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে শান্তনু ফুঁসে উঠতে থাকে।

শান্তনুদের বউবাজারের বাড়ির প্রায় সবাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের ঘোর সমর্থক হলেও শান্তনু কী করে যেন শৈশব থেকেই প্রবীণ কমিউনিষ্ট নেতা জ্যোতি বসুর ভারি ভক্ত হয়ে গিয়েছিল । কাজেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শান্তনুর চোখে কট্টর সাম্রাজ্যবাদী দেশ। শৈশব থেকেই শান্তনু মেধাবী-কাজেই, অনেকটা মেধার কল্যাণেই সাম্রাজ্যবাদী মার্কিন দেশের সিয়াটল শহরে চলে আসতে হল। দু-বছর ধরে সিয়াটলে আছে সে- সিয়াটলের প্যাসিফিক ইউনিভারসিটিতে ফোক-থিয়েটারের ওপর থিসিস করছে। থিসিসটা শেষ করেই পশ্চিম বাংলায় ফিরে যাবে ।

এই তেলখাকি পিশাচ-সুন্দর দেশে তার থাকার ইচ্ছে নেই তার ... এ বড় জ্যান্ত ... মূর্তিমান দানব...বড় তৃষ্ণার্ত দানব...বড় তেলের পিপাসা এর ...এ বড় জান্তব ...এ কেবলি বিভীষিকার জন্ম দেয় ...ইরাকে-ভিয়েতনামে ...সাক্ষাৎ ভ্যাম্পপায়ার এ ... দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অকারণে পরমাণু বোমা ফেলে লক্ষ লক্ষ নিরীহ জাপানিকে হত্যা করেছে...এখন মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশে রক্তবৃষ্টি ঝরাচ্ছে ... এ দেশ সাক্ষাৎ ভ্যাম্পপায়ার ... ঝির ঝির বৃষ্টির ভিতরে হাঁটতে হাঁটতে শান্তনু ফুঁসে উঠতে থাকে। বৃষ্টিটা কিছুটা কমেছে। রেইনকোটের আড়ালে নিজেকে সি আই এর গুপ্ত ঘাতকের মত মনে হয় শান্তনুর। মদের ঝাঁঝটা এখনও মাঝে মাঝে গলা দিয়ে উঠে আসছে। সেই সঙ্গে সঙ্গীতার শ্যামলা মিষ্টি মুখটা মনে পড়ে যেতেই কড়া একটা টান দিয়ে বুকের ভিতরে পুদিনার গন্ধমাখা মালবোরোর ঠান্ডা ধোঁওয়াটুকু চালান করে দেয় সে।

সঙ্গীতা এখন শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনকে তপোবন বলে সঙ্গীতা। থাক ... পার্কটা কখন পিছনে ফেলে এসেছে ও। এখন ড্রাম বিটের ধিপ ধিপ স্থূর শব্দ কানে যেতেই ডান দিকে তাকাল সে। স্বচ্ছ একটা গ্লাসের দেয়াল ... আলো জ্বলছে ...বড় একটা হলরুম ... মাঝখানে বড় একটা সুইমিং পুল।

অনেকগুলি অল্পবয়েসি ছেলেমেয়ে ... মিউজিকের তালে তালে নাচছে। পুল পার্টি? মনে হয়। ম্লান হাসে শান্তনু। কী নিশ্চিন্ত সুখে নাচছে ছেলেমেয়েগুলো ...যেন ...যেন ... বাকুবা ...বাগদাদ ... মশুলে বোম পড়ছে না .. যেন প্রতি মুহূর্তেই নিহত হচ্ছে না ইরাকি শিশুরা ...শান্তনু দাঁড়িয়ে পড়ে। কড়া চোখে তাকায় কাচের ওধারের হলরুমের দিকে।

সুইমিং পুলের জলে অনেকগুলি অল্পবয়েসি ছেলেমেয়ে। শান্তনু জানে-ওখানকার একটি মেয়ের মুখেও সঙ্গীতার মুখের টলটলে লাবণ্য নেই ...কেননা, ইতিহাস আবার পিছন দিকে ঘুরে নোনামাংসের প্রাগৈতিহাসিক যুগে ফিরে গেছে ... কোথাও এখন তপোবনের সমাহিত শান্তি নেই ...সুইমিং পুল ঘিরে অনেকগুলি অল্পবয়েসি ছেলেমেয়ে। সাদা-কালো আমেরিকান। মিউজিকের তালে তালে নাচছে। আশ্চর্য! দূরের রক্তবৃষ্টি ও সুখি ছেলেমেয়েদের যৌথনাচ ...বাগদাদে এখন প্রতিমুহূর্তে রক্তবৃষ্টি ঝরছে আর ওরা সে সব ভুলে সস্তা সুখে ভেসে যাচ্ছে ... শান্তনুর ভিতর থেকে উঠে আসতে থাকে থকথকে দলা দলা ঘৃনা ... (উৎসর্গ: কাকশালিখচড়ুই গাঙচিল।

যেহেতু সে খানিকটা বোঝে এসবের ...)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.