আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কেমন আছি সৌদি আরবে—প্রথম পর্ব

স্বাগতম

কেমন আছি সৌদি আরবে—প্রথম পর্ব দেশে যখন সরকারী চাকুরীর খোজে হন্য হয়ে ঘুড়ছিলাম সেই সময় এটমিক এনার্জিতে কর্মরত আসরাফ ভাই বললেন সৌদি আরবের ভিসা এসেছে যাবে নাকি?অনেক ভাবলাম কি করব দেশের এই বেকার জীবন নাকি সোনার হরিণের দেশ মিডিল ইস্ট। মিডিল ইস্টে নাকি খুব গরম,তাদের ব্যবহারও খূব খাড়াপ!তবে টাকা ওরে বাতাসে!যে প্রাইভেট ফার্মে তখন কাজ করছিলাম তারাও তখন আমাকে বদলি করলেন ওড়ির চড়ে!সেখানের বাসিন্দাদের জন্য সেল্টার তৈরী করতে হবে। বাপুরে আর কিছু ভাবার আগেই পাসপোর্ট বানাতে দিয়ে দিলাম। খরচ লাগবে সর্বমোট ৫৫,০০০টাকা,কিছু টাকা পরে গিয়ে দিলেও চলবে। সেই সময় আমাদের নিকটবর্তী কোন আত্মীয় মিডিল ইস্টে যায়নি আমিই প্রথম।

তাই বড় ভাই-বোনদের মাঝে দাওয়াত খাওয়ানোর হিরিক পরে গেল। মনে পরে টাংগাইলের এক বোনের বাড়ী গিয়ে তাদের ট্রাক দেখে আমি ড্রাইব শিখতে চাইলাম। তারা খুশিতে (তাঐ বাড়ীর) বললো তুমিকি ড্রাইবার ভিসায় যাচ্ছো? লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম না না ইঞ্জিনিয়ারতো তাই গাড়ি পাবো। কিন্তূ লক্ষ্য করি তারা আমার কথায় মুখটিপে হাসছিলেন, তারা যেন বিশ্বাসই করছিলেননা আমি প্রাইভেট কার পেতে পারি!ব্যপারটা আরো পরিষ্কার বুঝেছিলাম আরো পরে যখন এদেশে সত্যিই চলে আসি। যাগগে আমার কাগজপত্র খুব দ্রুতই এগুচ্ছিল।

আমার ফ্লাইটও ঠিক হয়ে যায় ৫ই মে। মজার ব্যপার সেই সময় আমি শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে একটি ভাইভা কার্ড পাই ২রা মের জন্য। লিখিত পরিক্ষা দিয়েছিলাম প্রায় ৬মাস আগে!জুনিয়র ইনস্ট্রাকটর পদে কাজটি মন্দ ছিল না। তাই আবার দোটানায় পরলাম। আব্বা বললেন ভাইভা দাও,আগে দেখ কি হয় ?কিন্তূ রেজাল্টতো দেবে পরে,যাই হোক সোনার হরিণ তখন আমাকে মোহে ফেলেছে।

যে সরকারি চাকুরী এতোদিন আমার স্বপ্ন ছিল তা আমাকে আর আর্কষন করছেনা। চোখে মুখে তখন বিদেশ যাওয়ার ঝলকানি। মাত্র দিন কয়েক বাকী প্লেনে উঠার। । আর সেই ঝলক মুখেই ভাইভা বোর্ডের সম্মুখীন হলাম।

বোর্ড মেম্বার দেখে আমি আরো অবাক,কারন ছয় জনের মধ্যে ছিলেন আমাদেরই ডিপার্টমেন্ট হেড ও অন্য একজন স্যার সহ দুজন!আমাকে ছয় জনে মিলে প্রচুর প্রশ্ন করেছিলেন। আর আমি ছিলাম একদম টেনশন ফ্রি!তাই পাবলিক সার্বিচ কমিশনের ভাইভার মতো ঘাবড়ে না গিয়ে জবাব দিচ্ছিলাম পট পট করে। শেষের দিকে একজন প্রশ্নকর্তা আমার একটি উত্তর ভুল বলে রায় দিলেন। কিন্তূ আমি তখন সিউর ছিলাম উত্তরটি সঠিক। তাই তৎক্ষনাত চেয়ার ছেরে দাড়িয়ে বললাম,স্যার চাকুরী দেবেননা ভাল কথা কিন্তূ সঠিক উত্তরকে কেন বেঠিক বলছেন?আপনার চাকুরীর আমার প্রয়োজন নেই,চললাম ধন্যবাদ।

আমার ব্যবহার দেখে সবাই হতবাক। ডিপার্টমেন্ট হেড আমাকে বললেন এই ছেলে বসো। আমরাকি এই শিক্ষা তোমাদের দিয়েছিলাম?প্রশ্নকর্তা তোমাদের ক্রস চেক করতেই পারেন। যাইওহোক সে অনেক কথা। আব্বা আমার কথা শুনে বলেছিলেন যাও ফ্লাইটের জন্য রেডি হয়ে নাও,তোমার চাকুরী এদেশে হবেনা।

আব্বা-আম্মা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে বিদায়ের দিনে আমাদের ঢাকার বাসা আত্মীয় স্বজনে পরিপূর্ণ রুমে তিল ধরনের ঠাই নেই। সবাই এসেছে আমাকে এয়ারপোর্ট অব্দি এগিয়ে দিতে। সকাল হতেই সবাই তৈরী মিনিবাস ভাড়া করেছে। সবার জায়গা হচ্ছেনা বলে কেউ কেউ অন্য যানে এয়ারপোর্ট চলে যচ্ছে। আমাকে আব্বা-আম্মা জরিয়ে ধরে দোয়া দরুধ পড়তে লাগলো।

আর কান্নাকাটিতো চলছেই। আমার ভেতর তখন অন্য আনন্দ, কারো কান্না আমাকে স্পর্শ করছিল না। আমার নিকট মনে হচ্ছিল সেইতো ভাল ব্রীজ বানাতে আমাকে গ্রামে থাকতে হবেনা বা বদলী হয়ে উড়ীর চড়েও যেতে হবেনা। যেতেই যদি হয় যাবো বিদেশ থাকবো আয়েসে, কামাবো টাকা। বাসা থেকে বের হয়ে যখন গাড়ীতে উঠছিলাম চেয়ে দেখি মহল্লার সব চাচি-খালারাও ভীড় করেছে আমাকে বিদায় দিতে! আম্মা আমাকে বাসা থেকেই কেদে কেটে বিদায় জানালো কিন্তূ আব্বা আমার সংগে এলো।

গাড়ী যখন বিটিভি ছাড়িয়ে বাড্ডা অতিক্রম করছিল তখনই প্রথম অনুভব করি বুকের ভেতর বেদনার অনুভূতি। সেই যে শুরু হলো ফ্লাসবেক ছবি,আর চলছে আজ অব্দি! এয়ারপোর্ট পৌছে দেখি এলাহি কান্ড,মানুষ আর মানুষ। খণ্ড খণ্ড জটলা আর কান্নাকাটির রোল। পরিবার পিছু বিদায় জানাতে এসেছে গড়ে প্রায় দশজন হবে। আমি ভীড় ঠেলে ভেতরে চলে গেলাম।

পাসপোর্ট ও টিকিট নিয়ে লম্বা লাইনে দাড়ালাম। একসময় বোর্ডিং পাস ওকে করে আবারো আমার আত্মীয় স্বজনের কাছে ফিরে এলাম। আমাকে ধরে তারাও হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিল। ইতিমধ্যে আমার এজেন্সীর অন্যান্য লোক এসে তারা দিল একত্রে সবাইকে প্লেনে উঠতে। আমি সহ মোট ছয়জন ছিলাম তাদের পেসেঞ্জার লিস্টে।

শেষে আমারও চোখে পানি এসে গেল। ভেজা চোখেই ইমিগ্রেসনের দিকে পা বাড়ালাম। প্লেনে উঠার অভিজ্ঞতা আমার আগেই ছিল। ছাত্রাবস্থায় একাধিকবার কলকাতায় গিয়েছিলাম এখান দিয়েই। কাজেই আমার চিন্তা তখন অন্যদিকে।

ভাবতে লাগলাম কোথায় যাচ্ছি;কেমন হবে আমার নুতন চাকুরীস্থল। ভাবতে ভাবতেই প্লেনের ভেতর ঢুকে পড়লাম। গালফ এয়ারের বিশাল প্লেনের ভেতর প্রচুর পেসেঞ্জার,প্রায় সবার চোখে মুখেই বিষাদের ছায়া,কেউ কেউ ভীতও বটে। আমার ছিট জানালার ধারে নির্ধারিত ছিল। তাই প্লেন আকাশে উড়তেই আমি আমার রামপুরা এলাকা খুজতে লাগলাম।

একসময় দেখতেও পেলাম। বুকের ভেতর দ্বিতীয়বার চিন চিন করে উঠল। আবারো শুরু হল ফ্লাশবেক ছবি। আব্বা আম্মা,ভাই-বোনদের চেহারা চোখের ভেতর ভেসে বেড়াচ্ছিল,আর বিষাদে মনটা ভাড় হয়ে ঊঠছিল। জীবনের অনেক ঘটনাই ছবি হয়ে ফুটে উঠছিল মনের পর্দায়।

এরই মধ্যে আমাদের খাবার পরিবেশিত হলো যদিও তখন রোজার মাস ছিল কিন্তূ অতি টেনশনে ছিলাম বলে রোজা রাখা হয়নি। খেয়ে দেয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বলতে পারবোনা। পাইলটের গলার আওয়াজে জেগে উঠলাম। আমরা আর কিছুক্ষনের মেধ্যেই দাহরান এয়ারপোর্টে নামতে যাচ্ছি। প্লেন থেকে নেমেই হোচট খেলাম,একি এতো ছোট এয়ারপোর্ট!হিসাব মেলাতে পারছিলামনা এতো বড় দেশে টিনসেডের এই এয়ারপোর্টটি দেখে।

রানওয়ে হেটে যখন ভেতরে গেলাম। দেখলাম চারটি সারিতে সবাই দাড়িয়েছে একটি শুধু মহিলাদের জন্য। অন্য একটি প্লেনে করে তারা শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছে কাজের বুয়া(খাদ্দামা)ভিসায়,ভাবলাম এটাও সম্ভব!আমার সংগী অন্যরা সহ পাসপোর্টের যাবতীয় ফর্মালিটিস সেরে আমরা দূরু দুরু বুকে বাইরে বের হলাম। সেখানে দেখি আমার নাম লিখে এক ভদ্রলোক লাইন বেধে অন্যান্যদের সংগে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের পরিচয় দিতেই জরিয়ে ধরলেন।

তিনিও বাংলাদেশী আমাদের ভিসাগুলো তিনিই কিনেছিলেন। নাম আঃসাত্তার পেশায় ড্রাইভার। উনি আমাদেরকে একটি মিনিবাসে উঠালেন এবং সোজা উনার ক্যাম্পে নিয়ে গেলেন। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্ব্যাবেলা মাগরিব নামাজের আজান হচ্ছে,রাস্তা ঘাট যদিও বেশ চওড়া কিন্তু আমাদের দেশে হরতাল হলেও এতো ফাকা রাস্তা দেখা যায়না। সাত্তার সাহেব বললেন রাত সারে নটায় অফিস শুরু হবে তখন তিনি আমাদেরকে সেখানে নিয়ে যাবেন।

আমি অবাক হলাম রোজার রাতে অফিস হবে জেনে। আমাদের দেশে তখন তারাবী নামাজ সেরেই আমরা ঘুমাতে জেতাম। যাইহোক সাত্তার সাহেব আমাদের নানা বাহারির ইফতার করালেন। ফলমুলের সমাহার দেখে আমাদের চক্ষু ছানাবড়া!খেলাম বেশ মজা করে। তারপর আবারো ঘুমিয়ে পড়লাম।

রাত নটায় আমাদের ডেকে তুলে অফিসে নিয়ে চললো। আল-আকরাবিয়া নামক স্থানে অফিস। অফিসে ঢুকেই সাত্তার সাহেব সৌদি মালিকের সংগে হ্যান্ডশেক ও বিরবির করে আরবিতে কিছু বলছিলেন এবং নাকে নাক ঘষলেন। এটা তাদের পরিচয় পর্বের রীতি। তার পর রং চা এলো এবং আমার পরিচয় পর্ব।

মালিককে প্রথম দেখেই আমার একরকম শ্রদ্ধাবোধ এসে গেল। ধবধবে সাদা পোষাক পকেটে গোল্ডেন কলম মাথায় লাল রুমালের মধ্যে কাল রিং এবং পায়ে সেন্ডেল। সিম্পল ড্রেস কিন্তু দেখতে অলিয়াওলিয়া মনে হচ্ছিল। আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল রাস্তায় কোন অসুবিদা হয়েছে কিনা,এ দেশ কেমন লাগছে,আমার বয়স কম কাজ করতে পারবো কিনা,ড্রাইব জানি কিনা ইত্তাদি। তখন আর সব বাংলাদেশীদের মতো আমার ইংরেজীও ছিল খুব দূর্বল।

আমি ইয়েস নো জাতীয় কথা বলে কাটিয়ে দচ্ছিলাম। তিনি আমাকে অনেক উপদেশ দিলেন। পাশের একটি রুম আগেই রেডি ছিল আমার জন্য। আমি আমার অফিসরুমে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষন পরই নিয়ে গেলেন আমাদের জন্য নির্ধারীত বাসস্থানে।

তখন রাত বারোটা। আমার রুম নিচ তলায় সিংগেল বেড,ফ্রিজ,কুকিং বার্নার সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব কিছুই রেডি। তবে বস আমাদের বলে দিলেন রমজান মাস তিনি আমাদেরকে ফ্রি খাওয়াবেন। উনার নিজের হোটেলে ফোন করে বলে দিলেন আমরা যা যা খেতে চাই দুই বেলাই যেন সাপ্লাই দেন। আমি শুনে ভয় পেলাম যে,দিনের বেলা কোন হোটেল খোলা থাকেনা।

অর্থা্ত না খেয়ে হলেও রোজা রাখতে হবে!কিন্তূ জ়েনে খুশি হলাম যে রোজার মাসে এদেশে দৈনিক মাত্র ৬ঘন্টা ডিউটি করতে হবে। সাত্তার সাহেব আমাদেরকে পরদিন রাতে দেখতে আসবে বলে বিদায় নিলেন। আমরা নিজেদের রুম গুছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.