আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বুক রিভিউ-১: যদিও জাতিস্মর নই : নষ্টালজিক চেতনার পুনরুত্থান

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...

মোস্তফা তারিকুল আহসান-এর 'যদিও জাতিস্মর নই' তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এর আগে তিনি মূলত ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। কথাসাহিত্যের অঙ্গনে মোস্তফা তারিকুল আহসান পরিচিত নাম কিন্তু আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে তিনি 'যদিও জাতিস্মর নই' কাব্য রচনার মধ্যদিয়ে যাত্রা শুরু করলেন। বিশ শতকের কবিতা হিসেবে 'যদিও জাতিস্মর নই' কাব্যগ্রন্থের স্থান বাংলা সাহিত্যে কতটা স্থায়িত্ব লাভ করবে তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে প্রাসঙ্গিক আলোচনা করে দেখা যেতে পারে, তাঁর এই গ্রন্থের কবিতাবলির প্রথাগত কাব্যমান কতটা উৎকর্ষিত।

প্রথাগত এই আলোচনার ক্ষেত্রে আমরা কবিতার বিষয়বস্তু ও আঙ্গিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে কবির সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ণয়ের প্রয়াস পাবো। তারিকুল আহসানের 'যদিও জাতিস্মর নই' কাব্যগ্রন্থের শুরুর কবিতা 'অনুবাদ' এবং 'যাত্রা' শীর্ষক কবিতাটির মাধ্যমে গ্রন্থের সমাপ্তি ঘটেছে। কবি তারিকুল আহসান জাতিস্মর নন, একথা নিজ মুখে স্বীকার করেছেন এবং তিনি যে-সব ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তাও পূর্বজন্মের ঘটনা নয়; বরং সমকালে তাঁর জীবন পরিক্রমায় 'যদিও জাতিস্মর নই' কবিতায় অতীত ইতিহাসের স্মৃতিচারণ করেছেন। মোস্তফা তারিকুল আহসান নব্বই দশকের কবিদের প্রথাগত নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত; ফলে তিনিও কবিতায় ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং আমাদের জাতিগত গৌরবমময় ঘটনাচিত্র উপস্থাপনে উৎসাহবোধ করেন। কবির এই অতীতচারিতা কখনো কখনো ব্যক্তিগত জীবনেরও সন্ধান দেয়।

যেমন-- পুরোনো গলিতে ঢুকেই পেয়ে যেতাম নিখিলেশকে টিংটিংয়ে শরীর নিয়ে চলেছে কাছারি পাড়ায় দলিল লিখে চালিয়ে নেয় নিজের পেট বাবা ভাই বোন সব চলে গেলো ওপারে সে পড়ে থাকলে বাপের ভিটে কামড়ে এইসব দৃশ্যকল্প আমি প্রতিদিন চোখে নিয়ে ঘুমাতে যাই যদিও কেউ আমাকে জাতিস্মর বলবে না। [যদিও জাতিস্মর নই, পৃ: ৪৬] এ কবিতায় কবি মোস্তফা তারিকুল আহসান-এর ব্যক্তি-জীবনের আনন্দ-বেদনা-ঔৎসুক্য বর্ণিত হয়েছে। যৌবনে পা দেয়ার পর কবি তার পেছনে ফেলে আসা দিনগুলো এখন ঘুমোতে দেয় না; তাছাড়া কবির কৈশোরে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের সময় হানাদার বাহিনী কর্তৃক সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম অত্যাচার ও পাশবিকতার ঘটনাও ¯পষ্ট মনে আছে। সেই সব দিন এখনো কবিকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে, কেননা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও কি সেসব দৃশ্যের পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি; এজন্যই কবি জানিয়েছেন, 'আমাদের সেই বিল নেই, প্রতি বছর বুক হাঁটু জল নেই, নৌকা নেই, সারি সারি কৈ মাছের সাথে সারাদিন পালানো নেই তপ্তদুপুর। নেই কালো কাজল দীঘি, তক্ষক, মাছরাঙা, চতুর শেয়াল' নেই অজস্র রাজহাঁস, নেই শাদা শাদা ডানাওয়াল বকেরা।

তবু তুমি কি মতিচুর স্বপ্ন দেখো দুপুরের ঘুমে--' [সুস্মিতাদি, পৃ. ২৩]। পরিবর্তন হয়নি, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনের। ফলে সমাজ-জীবনের অনড়-অবিচল প্রথাগত চিন্তাচেতনার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে কবিকে নতুন জীবন, সমাজ, পৃথিবীর সন্ধানে যাত্রা করতে হয়। আর তাই কবির কণ্ঠে উচ্চারিত হয় আমি যাচ্ছি আমার মতো আমি যাচ্ছি উদ্দেশ নেই তেপান্তরের ওপার থেকে নতুন করে যাত্রা হবে নতুন করে নদী পাবো সাগর পারো হাওয়া নদী গন্ধ পাবো নীল আকাশের চাদর গায়ে হেঁটে যাবো নীল দুনিয়ায় ভেতর থেকে হাঁটতে গিয়ে নতুন করে জোয়ার পাবো শব্দ তখন আগল খুলে বকুল মালা পরিয়ে দেবে নতুন চাঁদের জোছনা মেখে সেই মেয়েটি কথা দেবে [যাত্রা, পৃ: ৪৮] মোস্তফা তারিকুল আহসানের কবিতা নব্বই দশকের কবিতার বৈশিষ্ট্য নিয়েই বিশ শতকে যাত্রা শুরু করেছে। অবশ্য একটা প্রসঙ্গ তারিকুল আহসানের কবিতায় নব্বই দশকের কবিতার বিপরীত ঢঙে উঠে এসেছে তা হচ্ছে তার প্রত্যেকটি কবিতায় এক কিংবা একাধিক গল্পের সমাবেশ পরিলক্ষিত হয়।

তাছাড়া তার কবিতায় বিমূর্তায়নের বিষয়টি নেই বললেও অত্যুক্তি করা হয় না। তারিকুল আহসান কবিতায় সহজ কথাটি যেন সহজভাবেই বলতে চান, উপরন্তু সহজ কথাটিকে আরো খানিকটা সহজ করে তিনি কবিতায় গল্পের প্লট নির্মাণ করেন। অর্থাৎ বিষয়বস্তু নির্ধারণে মোস্তফা তারিকুল আহসান বিশ শতকের কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও বলার ঢঙে তিনি প্রাচীনপন্থী। তবে 'নিকট আলো নিকট অন্ধকার', 'অন্য আরেক দিন', 'কাল বিকেলের ছায়াটা', 'সুস্মিতাদি' প্রভৃতি কবিতা সম্পূর্ণ নব্বই দশকের গদ্য ঢঙেই রচনা করেছেন। গদ্য আঙ্গিকে কবিতা রচনা করলেও তারিকুল আহসান কবিতায় সর্বদাই মূর্ত বিষয়বস্তু তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

তার কবিতায় বিমূর্ত বিষয় নেই বললেই চলে সহজ মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না-যন্ত্রণা, রোগ-শোক সহজ-সাবলীল ঢঙে কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, তারিকুল আহসানের চেতনায় রয়েছে-- নব্বইয়ের নষ্টালজিয়া। তার 'যদিও জাতিস্মর নই' কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতাই অতীত স্মৃতির চর্বিত-চর্বন। ছন্দ রচনায় তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দীর্ঘ, প্রলম্বিত অক্ষরবৃত্তের প্রাধান্য দিয়েছেন, তবে ‘যাত্রা’, ‘একটি কৌণিক দৃশ্যের পক্ষে’ প্রভৃতি কবিতায় অক্ষরবৃত্তের আদলে স্বরবৃত্তের স্বাদ আনতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন, বাদ্য বাজে ঢোলক বাজে শিরায় শিরায় রক্ত বাজে প্রাণের নেশায় চপল হাওয়ায় নেশায় নেশায় পরাণ বাজে ভ্র“ কাঁপে বিকেল কাঁপে হাওয়ার সাথে কাঁপে হরিণ বুক যাবে আমি সেই গলিতে যাবো আমি যে-যাই আমার বলুক।

(যাত্রা, পৃ: ৪৮) কাব্য সৌন্দর্য নির্মাণে তারিকুল আহসান জীবনানন্দ দাশের প্রভাব বলয় ত্যাগ করতে পারেননি। যেমন, ক্স অসহ্য জোছনা জলে ভিজে যায় অনবরত ভুবন ক্স নিকানো উঠোন থেকে মাটি গোবরের গন্ধটা পাক খেতে খেতে নাক ছুঁয়ে যায় ক্স খড়কুটো মতো ভেসে যায় ঘরবাড়ি ক্স পৃথিবীর বয়স হয়েছে উবু হয়ে রূপসী বেশ্যার মতো বসে আছে রোহিলা খণ্ডে ক্স এখন খয়েরী রঙের দেয়ালে তার দেহ দেখতে পাচ্ছি ক্স রৌদ্র তার ডানা মেলবার আগেই নরম সকালে সতেজ গন্ধের ঘ্রাণ নিতে নিতে আমি যাত্রা করছি ‘যদিও জাতিস্মর নই’ কাব্যগ্রন্থের স্মরণীয় কতিপয় পঙক্তি নিম্নরূপ : ১. তবু সাইকোথেরাপিক কাউচে বসে যাবৎ জঞ্জাল ধীরে ধীরে সারানোর চেষ্টা করি বিষণœতায় অকালে পাকে চুলের মতো মোহন বোধ হুমড়ি খেয়ে পড়ে থাকে পায়ের কাছে [অনুবাদ, পৃ. ৭] ২. আমাদের গ্রামখানা গ্রাম নেই হয়ে গেছে তামাটে শহর ধুলো-বালি আস্তরণে বাতাসের ঘুম নেই শুয়ে আছে ছাদের ওপর কতসব ঝাঝালো বাণী নেমে আসে উচ্চনাদে কানের পর্দায় বাব বড় সেকেলে মানুষ বোঝেনা কোন গানে কিসের সুর [এই দুপুর এই অপরাহ্ণ, পৃ. ৯)] ৩. এখন দিনের আলোয় বেড়ালের ঘুম চোখ নিয়ে তাকাই আমার বয়সী বেড়ালেরা ব্যস্ততার ভান করে চোর পুলিশ খেলে অবিরাম শব্দ-চিৎকার-চেঁচামেচি আর বক্তৃতার নিনাদে মগজের বারোটা বাজে মাঝে মধ্যে ইথারে ব্যাকরণ চর্চা শুনি কারা যেন সন্ধ্যের খবরে দেশোদ্ধার করে তখন মাথা গরম ছোক্রার মতো আমি চলতে থাকি রাস্তায় মোড়ের ন্যাড়া কুকুরটা আমাকে পোস্টাপিসের মোড় পর্যন্ত দিয়ে যায় তারপর সামান্য মাঠ ফসলহীন ঘাসহীন আমার ভেতরটা শুধু ঘাস হতে চায় অথচ মাঠের আলে জমিনে কোনো ঘাস নেই [অন্য নির্বেদে, পৃ. ১০] ৪. তুমি চোখের পিচুটি মুছে নাও বাঁশবাগানের মাছরাঙার কাছে সবকিছু ভালো করে দেখ, দেখে নাও ক’টা ধানে বসেছে নীলাভ ফড়িং কামরাঙার গাছে কে বসে আছে কাকাতুয়া সেজে [বল্কল, পৃ. ২০] ৫. গতরাতে আমার কাছে একদল মশা নিরাপত্তা চেয়ে দরখাস্ত দিয়েছে। আরো মুখে মুখে বলেছে তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের যোগান দিতে হবে ... সব ময়লা পরিষ্কার করা যাবে না রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমানো চলবে না এবং তাদের গান এদেশের জাতীয় সঙ্গীত করতে হবে [নিরাপত্তা, পৃ. ২৯] ৬. আমার কাব্য বৃষ্টির বিন্দুতে সিন্ধু খুঁজে ঘুমিয়ে পড়তে চায় শুকনো ডাঙায় যন্ত্রণা থেকে বিবিক্ত হয়ে লেপের ভেতর গরম ওমের তালাশে ব্যস্ত হয়ে ওঠে [বৃষ্টি, পৃ. ৩৬] ৭. রক্তের সাথে অক্সিজেন যদি ঝগড়া করে তামাকের সাথে নিকোটিন মস্তিষ্কের সঙ্গে যদি অবিরাম যুদ্ধ করে শরীর আমরা থিতু হবো কোথায় [অস্তিত্ব, পৃ. ৩৯] ৮. থেমে যাবে হয়তো অবরুদ্ধ বাতাস থেমে যাবে হয়তো বিপদের সাইরেন জীবনের টিকটিক ঘড়ি চলবে আগের মতো তবু, বিষণœ প্রপন্ন রাত ডাক দেবে নাতো শেষ রথযাত্রার আগে [শেষ বিন্দু, পৃ. ৪১] ৯. বাঁশির সুরে জীবন যাদু মরণ বিষ অথই সুর জানি পরাণ মাঝি ডাক দিয়েছে গগন আলো রাত্রি কালো যেন পথের ধারে রাখাল ছেলে মুঠোয় তার সোনার দিন দেখি মাতিয়ে দেয় ভুবনটকে সাগর রসে সুরের তালে একা [বাঁশি, পৃ. ৪৭] মোস্তফা তারিকুল আহসানের ‘যদিও জাতিস্মর নই’ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ সুন্দর, আকর্ষণীয় এবং শিল্পিত বর্ণের সমাবেশে এঁকেছেন মকলেসুর রহমান অরুণ। অর্থাৎ গ্রন্থের প্রচ্ছদ-ই গ্রন্থটি একবার নেড়েচেড়ে দেখবার জন্যে পাঠককে উৎসুক করে তোলে। তবে গ্রন্থটি মুদ্রণ প্রমাদ যথেষ্ট দৃষ্টি কটু সূচীপত্রেই কবিতার শিরোনামে মুদ্রণ বিভ্রাট (নিকট আলো নিটক অন্ধকার) এই নামটিই গ্রন্থের অভ্যন্তরে ‘নিকট আলো নিকট অন্ধকার’ লেখা হয়েছে।

৮ নং পৃষ্ঠায় পথের, ৩৩ নং পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লাইনের প্রথম শব্দটি ভুল বানান মুদ্রিত হয়েছে। আশা করি লেখক পরবর্তী সংস্করণে মুদ্রণ প্রমাদের ক্ষেত্রে আরো যত্নশীল হবেন। গ্রন্থ পরিচিতি : মোস্তফা তারিকুল আহসান, ‘যদিও জাতিস্মর নই’, ১ম প্র, বগুড়া : পুণ্ড্র প্রকাশন, ২০০৩ \ পৃষ্ঠা : ৬+৪৮, প্রচ্ছদ : মকলেসুর রহমান অরুণ, মূল্য : ৪০ টাকা

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।