আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অসামরিক পারমাণবিক চুক্তি এবং বিশ্বরাজনীতি

কোন কিছুরই কোন মানে নেই, এমনিতেই টাইম পাস ....

এই চুক্তির মধ্য দিয়ে 'ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন নেবে'- মনমোহন সিং, প্রধানমন্ত্রী, ভারত ... কতজন জানে যে, ১৯৪৭ সালে ভারতের সীমান্ত ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল? অথবা কেউ কি জানে, ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কুয়েতে 'টাকা'ই ছিল সেদেশের আইনস্বীকৃত মুদ্রা? সুতরাং, আমরা ইন্দোনেশিয়া বা মধ্য এশিয়া অথবা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের ক্ষেত্রে আমাদের ভূমিকাকে গুরুত্ব দেয়ার কথা যে বলি, তার কারণ এখানে আমাদের স্বার্থ আছে। এই গোটা অঞ্চলকে আমরা প্রভাবাধীন অঞ্চল মনে করি। - বিদেশমন্ত্রী যশোবন্ত সিনহা, টাইমস অব ইণ্ডিয়া, ১৩-০৪-০১ ভারতের মিডিয়া, বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানীরাও ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তিকে সমানে সমর্থন জানিয়ে যাবে, তাতে আর সন্দেহ কি? তেমনই সমর্থন দেখলাম মুক্তমনায় বিপ্লব পালের একটি প্রবন্ধে। তিনি সেখানে ঘোষণা করেছেন: "অসামিরক ভারত-আমেরিকা নিউক্লিয়ার চুক্তির অন্ধ বিরোধিতা একধরেনর রাজৈনিতক আত্মহত্যা"। ভারতের বামপন্থীরা এই চুক্তির বিরোধিতা করায় তিনি মহাখাপ্পা, জানাচ্ছেন- বামপন্থীদের বিশ্বাসযোগ্যতা ও বুদ্ধি শুণ্যের কিছু নীচে।

বিষয়টিতে তাই কিছু বলার তাগিদ বোধ করছি.... ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সিভিলিয়ান নিউক্লিয়ার ডিলকে আসলে ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে না দেখলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে না। যুক্তরাষ্ট্র কেন ভারতের সাথে উত্তরোত্তর সামরিক মিত্রতা বাড়াতে চায়, সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ কি, ভারত কেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এত ঘনিষ্ঠ হতে চায়- ভারতের স্বার্থ কি, এসমস্ত ভালো ভাবে বুঝা দরকার। মধ্যপ্রাচ্যে যেমন ইসরায়েল- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তেমনি ভারতের অবস্থান হতে যাচ্ছে কি-না এটা আজ বড় প্রশ্ন। তবে এশিয়ার এ অংশকে নিয়ন্ত্রণ, সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়ায় দ্রত আধিপত্যশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাওয়া চীন, মাওদের নেপাল- এমনকি তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ন্ত্রণ সবদিক থেকেই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বস্ত বন্ধু হোক- এটাই পেন্টাগন-হোয়াইট হাউস চেয়েছে। ২০০২ সালে "Indo-US Military Relations: Expectations and Perceptions" শিরোনামে পেন্টাগন কর্তৃক প্রকাশিত এক পেপারে আমরা সেরকম এক আশাবাদই দেখিঃ "The Indians will laud the relationship as a success if they obtain the technology that they want from the United States. We [the US military] will view the relationship as a success if we are able to build a constructive military cooperation programme that enables us to jointly operate with the Indians in the future." মান্থলি রিভিউ পত্রিকায় তাই এই চুক্তিকে এভাবেই দেখেছে: "This deal is a part of an ongoing project to absorb India into the U.S. imperial sphere of influence as a "strategic" junior partner". আর, Carnegie Endowment for International Peace এর নিউক্লিয়ার নন-পলিফারেশন প্রজেক্টের প্রধান Joseph Cirincione এর বিশ্লেষণ অনুযায়ী: "The crux of the announcement [of the initial U.S.-Indian nuclear negotiations] is what it tells us of the U.S. grand strategy, and that behind whatever else is going on here the U.S. is preparing for a grand conflict with China and constructing an anti-China coalition. . . . In that scenario, India is even more valuable as a nuclear power, rather than as a non-nuclear country" (The Christian Science Monitor, July 20, 2005). ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যৌথ মহড়া এখন ডালভাত হয়ে গেছে।

গতবছরের শেষের দিকে ভারতের চেন্নাই পোর্টে পারমাণবিক যুদ্ধবিমান Nimitz এর অবতরণকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা হলেও আসলে তা নয়। কেননা তারপরেই আমরা বঙ্গোপসাগরে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ নৌ-মহড়াও দেখতে পাই। এসমস্ত ঘটনাকে মিলিয়ে দেখার আহবান জানাই। সেই সাথে আরেকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করবো, সেটা হচ্ছে- ভারত কিন্তু Non-Proliferation চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি (পাকিস্তান ও ইসরায়েলও করেনি)। ভারতের স্বার্থ কি? বড় মোড়লের সাথে থাকলে ছোট মোড়লদের শক্তি-সাহস সবসময়ই কিছুটা বৃদ্ধি পায় বৈকি।

ভারত আজ একটি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র। এশিয়ায়- বিশেষ করে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ায় এ মুহুর্তে তার প্রধানতম প্রতিদ্বন্দ্বী চীন, এই চীন আবার স্ট্রাটেজিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রেরও অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা ভারতকে এই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক প্রতিপত্তি বাড়াতে সহায়তা করবে বলেই ভারত মনে করে। সেই সাথে এটিও দেখার বিষয় যে, যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু এই ডিলটিতে তার নিজস্ব অবস্থান ঠিকই ধরে রেখেছে- মানে ভারতের সাথে যে মিত্রতা গড়ে তুলছে- সেটা যে দুই সম পর্যায়ের বন্ধুর মিত্রতা নয়- তা এই চুক্তির ধারাগুলোতেই পরিষ্কার। অর্থাৎ এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতকে সাথে নিয়ে অন্যদের মোকাবেলাও যেমন তার জন্য সহজ হলো- তেমনি এই চুক্তি ভারতকেও নিয়ন্ত্রণের পথ খুলে দিল।

তার মানে আসলে যুক্তরাষ্ট্র এর মধ্য দিয়ে এক ঢিলে বেশ কয়টি পাখি মারলো। চুক্তির বিভিন্ন ধারায় আছে: নিউক্লিয়ার জ্বালানি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই কিনতে পারবে ভারত, কোন কারণে যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানী সরবরাহে ব্যর্থ হলে অন্য দেশ (ইউকে, রাশিয়া ও ফ্রান্স) থেকে কেনার জন্য বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে; এমনকি যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোন সময়ে জ্বালানী সরবরাহ বন্ধ করতে এবং আগের সরবরাহকৃত জ্বালানী ফিরিয়ে নিতে পারবে। এই অংশটুকুই ভারতের উপর যুক্তরাষ্ট্রের খবরদারি চালানোর নিশ্চয়তা দেয়। মান্থলি রিভিউ এভাবে বিষয়টিকে তুলে ধরেছে: "Let us be clear then as to what this agreement entails: the U.S. openly gains the power to threaten to deny ongoing fuel supplies (and even the forcible removal of supplies previously given) in order to control future Indian policy. Is this a remote speculation? We must recall that in the 1970s the U.S. unilaterally cut off all fuel supply to Tarapur, in material violation of the previous "123" agreement between the U.S. and India of 1963. " ......... "It is an unequal colonial treaty that openly subjects a potentially significant share of India's energy generating potential to future U.S. blackmail" ৩ আগস্ট, ২০০৭ এ "ভারত-যুক্তরাষ্ট্র নিউক্লিয়ার সমঝোতা" নামে সমঝোতা পত্র প্রকাশিত হয়। তখন থেকে ভারতীয় মিডিয়া এটিকে বেসামরিক নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি "বাণিজ্য", "সরবরাহ" বা "প্রবাহ" এসব হিসাবে দেখিয়ে এর পক্ষে জনমত প্রতিষ্ঠায় রত।

বাকি ছিল মার্কিন কংগ্রেসে এটি পাশ হওয়ার। তাও এ বছরে সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সিনেটে এটি ৮৬-১৩ ভোটে পাশ হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, পক্ষে ভোট দিয়েছেন যেমন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ম্যাককেইন, রিচার্ড লুগার; তৎকালীন ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী (বর্তমানে প্রেসিডেন্ট) বারাক ওবামা, তার রানিং মেট জো বিডেন সকলেই পক্ষে ভোট প্রদান করেন। অবশেষে গত সেপ্টম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক চাপ ও ভারতীয় লবির তীব্র প্রচারণায়- Nuclear Supplier Group (NSG) ভারতকে বিশেষ "ছাড়" দিতে রাজী হয়, (১৯৭৪ সালে পারমাণবিক এক্সপ্লোশন ঘটানোর জন্য ভারতের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই NSG নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি-জ্বালানী সরবরাহ ও বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল)- এই ছাড়ের ফলে ভারত NSG দেশ সমূহের সাথে নিউক্লিয়ার বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে।

ভারতীয় বুর্জোয়া মিডিয়া বা বিপ্লব পালেরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের যুক্তিকেই সামনে আনছে; জানানো হচ্ছে যে, ভারতের ২২ টি নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন তার তার ক্যাপাসিটির ৪০% এ চলছে এবং এগুলো প্রকটভাবেই ইউরেনিয়াম সংকটে ভুগছে। এসব ঠিক আছে- ইউরেনিয়াম পেলে, নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কিছু বাড়বে ঠিকই- সাথে এটাও ঠিক যে- এই ইউরেনিয়াম ও নিউক্লিয়ার প্রযুক্তি ভারতের নিউক্লিয়ার পাওয়ারকে আরো শক্তিশালী করবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে- বর্তমানে যেখানে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন মোট উৎপাদনের ৩%, সেখানে চুক্তির পরে ২০২৫ সাল নাগাদ এই উৎপাদন দাঁড়াবে ৭%। এই সামান্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য যে বিশাল বিনিয়োগ- সেখান থেকে কি সাধারণ জনগণ কোন উপকার পাবে? আসলে- পরমাণু বিদ্যুতের অজুহাত আসলে কেবলই বুলি- মূলত এর মাধ্যমে ভারতের পরমাণু অস্ত্রের জ্বালানি পাওয়াটাই সহজসাধ্য হলো। কেননা ইউরেনিয়াম থেকে যেমন পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়- তেমনি তৈরি করা যায় পরমাণু বোমা।

বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন করার পর জ্বলে যাওয়া ইউরেনিয়ামের যে ছাই পাওয়া যায় তাকে রিপ্রসেসিং করলেই পাওয়া যায় প্লুটোনেয়াম- যেটিই পরমাণু বোমার মূল উপাদান। ১৯৭৪ সালে ও ১৯৯৮ সালে ভারত পরীক্ষামূলক পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রমাণ করেছে- তার কাছে এই রিপ্রসেসিং প্রযুক্তি আছে। সুতরাং- কোন সন্দেহ নেই, এই চুক্তির মাধ্যমে পরমাণু শক্তি হিসাবে ভারতের হাতকে শক্তিশালীই করা হলো। এই বিষয়টি বিপ্লব পালেরা না বুঝলে (বা বুঝতে না চাইলে) কি হবে, এশিয়ার অন্য দেশসমূহ ঠিকই বুঝতে পারছে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এই সামরিক ঘনিষ্ঠতা এশিয়ায় সামরিক প্রতিদ্দবন্দ্বিতাকেই বৃদ্ধি করবে এবং এশিয়াকে অস্থিতিশীল করে তুলবে।

চীন প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে এসেছে। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বরে যখন ডিলটি NSG এর সামনে এলো- তখন চীন এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। এক পর্যায়ে ভারত-চীন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যায়, কিন্তু এ মুহুর্তে অতিমাত্রায় ভারত বিরোধিতা ভারতকে আরো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ করতে পারে এ বিবেচনায় শেষ অবধি চীন পিছু হটে। তার মানে এই নয় যে, সে থেমে আছে। মিয়ানমারের সাম্প্রতিক সাফ্রোন-বিপ্লব ও বিশ্বরাজনীতি লেখাটিতে চীনের কিছু উদ্যোগের কথা লিখেছি (যারা পড়েননি আশা করি পড়বেন)।

ওদিকে ভারত-প্রতিবেশী পাকিস্তান শুরু থেকে এই চুক্তির বিরোধিতা করে এসেছে। পাকিস্তান বারবার জানিয়েছে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এই নিউক্লিয়ার ডিল উপমহাদেশে শক্তির ভারসাম্য ক্ষুণ্ণ করবে এবং এটা এ অঞ্চলে সামরিক/অস্ত্র প্রতিযোগিতাকেই তীব্র করবে। অবশেষে যখন এই চুক্তিকে ঠেকানো গেলো না তখন পাকিস্তানের অন্য সুর দেখা গেলোঃ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা জিলানী ঘোষণা করলেন, "Now Pakistan also has the right to demand a civilian nuclear agreement with America. We want there to be no discrimination. Pakistan will also strive for a nuclear deal and we think they will have to accommodate us." ইরানের Atomic Energy Organization এর উপপ্রধান Mohammad Seedi তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই double standards নিউক্লিয়ার পলিফারেশন কার্যক্রমকেই (NPT) ভণ্ডুল করবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ে নতুন করে সংকট তৈরী করবে। এই ইরানের প্রতি পারমাণবিক কার্যক্রমের অভিযোগ তুলে ক্রমাগত হুমকি দিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্র; আর সেই যুক্তরাষ্ট্র অনায়াসে যখন ভারতের সাথে এহেন নিউক্লিয়ার এগ্রিমেন্ট করে- তখন দুনিয়াব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মোড়লিপনার বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়। আর তাই বিপ্লব পালেরা যাই বলুক না কেন- দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মানুষদের জন্য ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এই সিভিলিয়ান নিউক্লিয়ার এগ্রিমেন্টের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অবশ্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।

দুই : প্রশ্নোত্তর পর্ব ১। আপনি বলেছেন যে, "নিউক্লিয়ার জ্বালানি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই কিনতে পারবে ভারত, কোন কারণে যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানী সরবরাহে ব্যর্থ হলে অন্য দেশ (ইউকে, রাশিয়া ও ফ্রান্স) থেকে কেনার জন্য বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে; এমনকি যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোন সময়ে জ্বালানী সরবরাহ বন্ধ করতে এবং আগের সরবরাহকৃত জ্বালানী ফিরিয়ে নিতে পারবে। " প্রথমে আপনি এর সূত্র দিন। চুক্তি অনুসারে ভারতও জ্বালানী কেনা বন্ধ করতে পারে বা আমেরিকাও পাঠানো বন্ধ করতে পারে - এক বছরের নোটিশে - এ ছাড়া চুক্তির আর কিছু এই বক্তব্যের সাথে মেলে না। এই এগ্রিমেন্টের ১৪ নং আর্টিকেল (TERMINATION AND CESSATION OF COOPERATION) এর ১ নং ধারায় আছে "Either Party shall have the right to terminate this Agreement prior to its expiration on one year's written notice to the other Party". অর্থাৎ "চুক্তি অনুসারে ভারতও জ্বালানী কেনা বন্ধ করতে পারে বা আমেরিকাও পাঠানো বন্ধ করতে পারে"।

কিন্তু বুঝতে হবে, ভারতের জ্বালানী-প্রযুক্তি কেনা বন্ধ করা আর যুক্তরাষ্ট্রের বিক্রয় বন্ধ করা এক বিষয় নয়; যেহেতু জ্বালানী কিনছে ভারত- সুতরাং ভারতই জ্বালানীর জন্য নির্ভরশীল। যাহোক- এগ্রিমেন্ট টার্মিনেশের জন্য দেয়া নোটিশের মেয়াদকাল যেহেতু একবছর- সেহেতু এক বছর পরে টার্মিনেশের এখতিয়ার উভয়ের হাতেই রাখা হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই একবছর শেষ হওয়ার আগেই যদি যন্ত্রপাতি ফিরিয়ে নেয়ার অধিকার দেয়া হয়, তবে এক বছর নোটিশের কি কোন মূল্য থাকে? আমি জানিয়েছিলাম: "এমনকি যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোন সময়ে জ্বালানী সরবরাহ বন্ধ করতে এবং আগের সরবরাহকৃত জ্বালানী ফিরিয়ে নিতে পারবে"। এটার সূত্র আপনারা এগ্রিমেন্টটির একই (১৪ নং) আর্টিকেলের ৪ নং ধারাটি দেখতে পারেনঃ Following the cessation of cooperation under this Agreement, either Party shall have the right to require the return by the other Party of any nuclear material, equipment, non-nuclear material or components transferred under this Agreement and any special fissionable material produced through their use. A notice by a Party that is invoking the right of return shall be delivered to the other Party on or before the date of termination of this Agreement. -------- এখানে on or before অংশটুকু দেখুন। একবছরের নোটিশ অনুযায়ী এগ্রিমেন্টের মেয়াদ শেষে অথবা তার আগেই এরকম 'রিটার্ণ' এর অধিকার দেয়া হয়েছে।

বলতে পারেন, এই অধিকার উভয় পার্টির (দেশের) জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু সেক্ষেত্রে আবার বলতে হবে, নিউক্লিয়ার ম্যাটেরিয়াল- ইকুয়েপমেন্ট- টেকনোলজি এসব আসলে ভারতে সরবরাহ করবে যুক্তরাষ্ট্র; ভারত যুক্তরাষ্ট্রে করবে না। ফলে- এই অংশটুকু ভারতকে চাপে (ব্ল্যাকমেইল করার জন্য!!) রাখার জন্য যথেস্ট। এছাড়া আমি এটাও বলেছিলাম: "নিউক্লিয়ার জ্বালানি কেবল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই কিনতে পারবে ভারত, কোন কারণে যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানী সরবরাহে ব্যর্থ হলে অন্য দেশ (ইউকে, রাশিয়া ও ফ্রান্স) থেকে কেনার জন্য বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে"। এটির তথ্যসূত্রও আপনারা এগ্রিমেন্টেই পাবেন।

আর্টিকেল ৫ (TRANSFER OF NUCLEAR MATERIAL, NON-NUCLEAR MATERIAL, EQUIPMENT, COMPONENTS AND RELATED TECHNOLOGY) এর ৬ নং ধারার খ (৪) নং উপধারায় আছে: If despite these arrangements, a disruption of fuel supplies to India occurs, the United States and India would jointly convene a group of friendly supplier countries to include countries such as Russia, France and the United Kingdom to pursue such measures as would restore fuel supply to India. আপনাকে এই অংশটুকুর দিকে দৃষ্টি দিতে বলবো: a disruption of fuel supplies to India occurs। এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ভারতে একমাত্র জ্বালানী-সরবরাহকারী যুক্তরাষ্ট্র। ফলে, ভারতে এই disruption of fuel supplies একমাত্র যুক্তারষ্ট্রের কারণেই ঘটতে পারে। আর তখন কি করা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যৌথভাবে বন্ধুপ্রতিম সরবরাহকারী রাষ্ট্রসমূহের (রাশিয়া, ফ্রান্স, ইউকে) সাথে বৈঠক আয়োজন করবে! আশা করি, আমার বক্তব্যের তথ্যসূত্র পেয়েছেন।

২। চীনের অন্তত এই বিষয়ে আপত্তি জানানোর কিছু নেই, কারণ চীনের সাথে আমেরিকার একইরকম |সিভিল-নিউক্লিয়ার চুক্তি আছে। এ আলোচনার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো না। বিষয়টি কি এমন যে, "বাবা তুমি নিজে খাইতে পারো- অন্যে খাইতে চাইলে তাতে কেন বাগড়া দেও? নিজে খাইয়া-দাইয়া আরেকজনের খাওনে বাঁধা দেওন কি নৈতিক?" দেখুন, এখানে চীনের বাঁধা দেয়ার নৈতিক অধিকার আছে কি না সে নিয়ে আমি মোটেও আলোচনা করছি না। বাস্তবতা হচ্ছে- চীন এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে- করছে।

সেটা করছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়া বা এশিয়ায় তথা দুনিয়ায় ভূরাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জন ও বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, একে অপরের উপর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে। এই কামড়া-কামড়ি তুলে ধরাই তো উদ্দেশ্য ছিল। আর যে কারণে পোস্ট লিখেছি সেটি তো আগেও বলেছি, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের এই এগ্রিমেন্টকে অনেকে নিছক বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানোর জায়গা থেকে দেখাচ্ছেন। সেটা যে মস্ত ফাঁকি ও প্রতারণা- তা চীন ও অন্য দেশসমূহের কার্যক্রমেই পরিষ্কার। চীন নিজে যেহেতু এই চুক্তি আগে করেছে- ফলে সে জানে, এটা ভারতের সাথে হলে তার ফল কি হবে? আরেকটি বিষয়, চীনের সাথেকার চুক্তিটির সাথে মিলিয়ে দেখলে বুঝা যাবে যে, ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিটিতে ভারতকে জিম্মি বানানোর সুযোগ রয়েছে।

যেমনঃ চীন-যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির ২ নং আর্টিকেলের (SCOPE OF COOPERATION ) ১ নং ধারায় আছে: The parties shall cooperate in the use of nuclear energy for peaceful purposes in accordance with the provisions of this agreement. Each party shall implement this agreement in accordance with its respective applicable treaties, national laws, regulations and license requirements concerning the use of nuclear energy for peaceful purposes. The parties recognize, with respect to the observance of this agreement, the principle of international law that provides that a party may not invoke the provisions of its internal law as justification for its failure to perform a treaty. আপনারা যদি এই ধারার সাথে ইন্দো-যুক্তরাষ্ট্র এগ্রিমেন্টের ২ নং আর্টিকেল (SCOPE OF COOPERATION) এর ১ নং ধারা মিলিয়ে দেখেন- তবে প্রথমেই যেটি দেখবেন সেটি হলো ভারতের সাথেকার চুক্তিটিতে "The parties recognize, with respect to the observance of this agreement, the principle of international law that provides that a party may not invoke the provisions of its internal law as justification for its failure to perform a treaty" অংশটুকু নেই। এই আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সংগতি থাকার বিষয়টি না থাকায় ভারতের উপর ছড়ি ঘোরানোর বড় ধরণের মওকা লাভ করলো যুক্তরাষ্ট্র। কেননা- national laws, regulations and license এসব নিজের সুবিধামত যেকোন সময় পাল্টিয়ে এগ্রিমেন্ট থেকে সরে আসার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের থাকলো (ভারতেরও আছে- কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না)। এবং যুক্তরাষ্ট্র এরকম কাজ আগেও করেছে। ফলে- এই চুক্তিটি অবশ্যই হয়েছে একতরফা, চীনের এগ্রিমেন্টকে তাই সেরকম একতরফা বলতে পারবেন না- এবং এ কারণেই এখন পর্যন্ত চীনকে যুক্তরাষ্ট্র তার অনুগত বানাতে পারেনি।

৩। আমার তো মনে হয় সবথেকে বড় দুমুখো নীতি হল NPT আর CTBT. উভয়েই কিছু দেশকে নিউক্লিয়ার পাওয়ার বলে স্বীকৃতি দিয়ে দেয় আর বাকিদের দেয় না। কি কারণে? কোনো কারণ নেই। যদি কোনো নীতি বানাতেই হয়, তাহলে আগে এই দুটো চুক্তি বাতিল করে গ্লোবাল নিউক্লিয়ার ডিস-আর্মামেন্ট এর সূচনা করা হোক। অস্ত্র-প্রতিযোগিতা বন্ধে এটাই একমাত্র পদক্ষেপ হতে পারে।

NPT আর CTBT যে অস্ত্র/সামরিক প্রতিযোগিতা বা যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে না, পারবে না সেটা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। যেমন করে সবাই জানে যে, জাতিসংঘের পক্ষে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। তারপরেও এগুলোকে সামনে আনা হয় একারণে যে, এগুলো দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী মোড়লদের দুই নম্বরী খুব সহজে সকলের সামনে তুলে ধরা যায়। ভূয়া পারমাণবিক অস্ত্র/জীবাণু অস্ত্রের অভিযোগ তুলে ইরাককে ধ্বংস করা হয়- ইরানকে ক্রমাগত যুদ্ধের হুমকি দেয়া হয়; আর উল্টোদিকে NPT ও CTBT তে স্বাক্ষর না করা- NPT ও CTBT এর শর্তবিরোধী পারমানবিক পরীক্ষণ চালানো ভারতের সাথে যে পারমাণবিক আদান-প্রদান চুক্তি করা হয়; তা বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের চুড়ান্তরকমের ভণ্ডামি- সেটিই আমাদের সামনে পরিষ্কার করে দেয়। আপনারা যে গ্লোবাল ডিস-আর্মামেন্ট এর কথা বললেন, সেটিও তো একরকমের ভণ্ডামি।

এই কথার ধোয়া তুলেই তো NPT ও CTBT, PTBT, ABM----- ইত্যাদি নানাবিধ ভূমিকা নিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রই এসবে অগ্রগামী ভূমিকা নিয়েছে- যেনবা যুক্তরাষ্ট্র দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কত আন্তরিক- কত দরদী!! বুঝতে কারোরই কোন সমস্যা হয় না যে, ইতোমধ্যে নিউক্লিয়ার পাওয়ারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রের অন্যদের সাথে নিয়ে নতুন পারমাণবিক পরীক্ষণ না করলে, কিছু অস্ত্র ধ্বংস করলে বরং যুক্তরাষ্ট্রেরই অপ্রতিদ্বন্দ্বী থাকাটাই নিশ্চিত হয়। NPT এর প্রধান তিনটি শর্ত বা ধারা হচ্ছে: ১) nonproliferation, ২) disarmament, ৩) the right to peacefully use nuclear technology। বোঝাই যায় ৩ নং টি পুরোটাই ধাপ্পাবাজি। একই ভাবে চীন-যুক্তরাষ্ট্র বা ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্লিয়ার এগ্রিমেন্ট প্রভৃতিতে শান্তিপূর্ণ, শান্তি, সিভিলিয়ান প্রভৃতি শব্দগুলো ধাপ্পাবাজি ছাড়া কিছুই নয়। যাহোক যেটা বলছিলাম, এসমস্ত চুক্তি- disarmament সবই দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষের সাথে নিয়ত ব্যঙ্গ করেই যাচ্ছে (অনেকটা এমনঃ কোন এক গ্রামে এক মোড়লের গোটা পঞ্চাশেক যাঁতাকল ছিল- যেটির ভয় দেখিয়ে সে গ্রামের লোকের উপর ছড়ি ঘোরাতো।

তো আরো কিছু ছোট মোড়লের আবির্ভাব ঘটলো- এবং ছোট মোড়লদের কারো ২টা, কারো ৫ টা যাঁতাকল তৈরী করলো; এখন বড় মোড়ল বড় দরদ দেখিয়ে ঘোষণা করলো- আসুন সবাই মিলে চুক্তি করি- আর কোন নতুন যাঁতাকল তৈরী করা হবে না এবং সবাই নিজেদের অন্তত ৫ টি করে যাঁতাকল ধ্বংস করে ফেলি--- ইত্যাদি)। নোবেল জয়ী নাট্যকার হ্যারল্ড পিন্টার এর নোবেল বক্তৃতা থেকে তাই বলি: মার্কিন ঘোষিত নীতিরই এখন সর্বাঙ্গীন আধিপত্য। এই নাম আমি দিই-নি, তারাই দিয়েছে। 'সর্বাঙ্গীন আধিপত্য' মানে ভূমি, সমুদ্র, বাতাস, মহাশূণ্য এবং আর সব সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ। ১৩২ টি দেশে ৭০২টি সামরিক স্থাপনা আমেরিকার অধিকৃত।

আমেরিকার কাছে আছে ৮০০০ সক্রিয় এবং ক্ষেপনযোগ্য পারমাণবিক অস্ত্র। এর মধ্যে ২০০০টি আছে 'হেয়ার ট্রিগার এলার্ট' এ। বিপদসংকেতের ১৫ মিনিটের মধ্যেই নিক্ষেপ করা যাবে এদের। আরো উন্নত পারমাণবিক ব্যবস্থা তৈরি করছে তারা যা বঙ্কার বাস্টার্স হিসেবে পরিচিত। কার দিকে তাক করে আছে তারা? ওসামা বিন লাদেন? আপনি? আমি? জো ডকস? চীন? প্যারিস? কে জানে? আমরা জানি এই শিশুসুলভ পাগলামি- পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার এবং সংরক্ষণ হলো বর্তমান মার্কিন রাজনৈতিক দর্শনের কেন্দ্রে।

অস্ত্র ধ্বংস হোক, যুদ্ধ বন্ধ হোক- এটা সমস্ত শান্তিকামী মানুষেরই চাওয়া। কিভাবে হবে? অস্ত্রবাজদের দেখানো নিউক্লিয়ার ডিস-আর্মামেন্ট কর্মসূচীর মাধ্যমে? কোনদিনই সম্ভব নয়? একমাত্র উপায় ও পদক্ষেপ হচ্ছে: দুনিয়াব্যাপী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলা। প্রয়োজন আরেকটি যুদ্ধ, মুক্তিকামী মানুষের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধ। ["দিনমজুর" নিক থেকে পূর্বে প্রকাশিত। কিছুটা পরিবর্তিত।

]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।