আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাল পতাকার নতুন ডাকে



মৃণালকান্তি দাস । । রাঁচি লাল পতাকার নতুন ডাকে উদ্দীপনা আদিবাসী নেতাদের ভর দুপুরে রাঁচি অফিসে ফোনের আওয়াজ। ফোন তুললেন সি পি আই (এম) রাজ্য সম্পাদক জ্ঞানশঙ্কর মজুমদার। অস্ফুট স্বরে বললেন, স্টিফেনের ফোন।

মিনিট দশেকের কথা। ফোন রেখে বললেন, ‘তৃতীয় শক্তির প্রতি সংহতি জানালেন। স্টিফেন যা বললেন তাতে লোকসভা নির্বাচনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় জোটের সঙ্গে হাত মেলানোর পথ খোলা রাখলো ঝাড়খণ্ড বিকাশ মোর্চা (সেকুলার)’। কেন নির্বাচনের পরে কেন? উত্তরে জ্ঞানশঙ্কর মজুমদার বললেন, এ রাজ্যের ছোট ছোট দলগুলি অস্তিত্ব সংকটে রয়েছে। ভোটে জিতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে চাইছে।

তাই নির্বাচনের আগে কেউই সরাসরি জোট গঠনের সাহস দেখাতে পারছে না। স্টিফেনও নয়। সি পি আই (এম) রাজ্য দপ্তরে স্টিফেনের ফোন আসায় হতবাক হওয়ার কিছু নেই। শিবু সোরেনে ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ছেড়ে বেরিয়ে এসে নতুন দল গঠন করার পর সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেন। যদিও নির্বাচনে কোনো জোট গঠন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি।

কারণ, রাজমহল কেন্দ্রে সি পি আই (এম) প্রার্থী ঘোষনা করে দিয়েছে আগেই। এই কেন্দ্রে জ্যোতিন সোরেনের বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ড বিকাশ মোর্চা (সেকুলার) প্রার্থী দিলেও লড়াই হবে বন্ধুত্বপূর্ণ, বলেছেন স্টিফেন মারান্ডি। তবে দুমকা কেন্দ্রে কংগ্রেস এবং বিজেপি জোটকে পরাস্ত করতে স্টিফেনের দলকেই সমর্থন করবে সি পি আই (এম)। লোকসভা ভোটে ঝাড়খণ্ডের জোট রাজনীতিতে যে নয়া মোড় নিতে চলেছে একথা বোঝা যায় রাঁচির বাল্মিকী রোডের এই পার্টির রাজ্যদপ্তরে বসেই। ইতোমধ্যে সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কোলেবেরা কেন্দ্রের বিধায়ক, ঝাড়খণ্ড পার্টির এনোয়েস এক্কা।

সম্প্রতি তামারা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে শিবু সোরেনকে হারতে হয়েছিলো এই ঝাড়খণ্ড পার্টির কাছেই। এক্কার সাফ কথা, কেন্দ্রে অ-কংগ্রেসী, অ-বিজেপি সরকার চাই। তাই রাজমহল কেন্দ্রে ঝাড়খণ্ড পার্টি সরাসরি সি পি আই (এম) প্রার্থীকে সমর্থন করছে। খুটি লোকসভা কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী নোয়েল তিরকির বিরুদ্ধে ঝাড়খণ্ড পার্টির প্রার্থী অধ্যাপক নিশিকান্ত হোরো। ধাবুয়ার জে এন কলেজের এই অধ্যাপককে প্রকাশ্যেই সমর্থন করবে সি পি আই (এম)।

উচ্চশিক্ষিত আদিবাসী অধ্যাপক বলে শুধু নয়, সি পি আই (এম) চায় শিক্ষিত আদিবাসীরা সমাজের সামনের সারিতে এগিয়ে আসুক। বললেন জ্ঞানশঙ্কর মজুমদার। ভোটের রাজনীতি নয়, ঠিক একই কারণে ঝাড়খণ্ডের বৃহত্তম আদিবাসী ছাত্র সংগঠন আজসুর প্রার্থী চামরা লিন্ডাকে সি পি আই (এম) সমর্থন করছে। লোহারদাগা লোকসভা কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী রামেশ্বর ওঁড়াওয়ের বিরুদ্ধে গত লোকসভা নির্বাচনেও লড়াই করেছিলেন চামরা লিন্ডা। ফলাফলে তৃতীয় স্থানে ছিলো আজসু।

রাঁচিতে তাঁরা প্রার্থী দিলেও ধানবাদ, রাজমহল কেন্দ্রে সরাসরি বামপন্থীদের সঙ্গে প্রচারে নামবে বলে জানিয়ে দিয়েছে আজসুর নেতারা। তারাও তৃতীয় শক্তির দিকে তাকিয়ে। একই কথা বলছেন ঝাড়খণ্ড জনাধিকার পার্টির নেতা বন্ধু টিরকি। হাজারিবাগে তাঁর দল থাকবে বামপন্থীদের সঙ্গেই। এই কেন্দ্রে সি পি আইয়ের প্রার্থী ভুবনেশ্বর প্রসাদ মেহেতা।

রাজনাথ সিংয়ের বিরুদ্ধে রীতিমতো বিদ্রোহ ঘোষনা করে ২০০৫-এ বাবুলাল মারান্ডি সদলবলে বিজেপি ছেড়ে নতুন দল গড়েছেন। গত লোকসভা নির্বাচনে কোডারমা কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে সাংসদ হয়েছিলেন। বিজেপি ছাড়ার পর সাংসদ পদে ইস্তফা দিয়ে উপনির্বাচনে ফের কোডারমা কেন্দ্র থেকেই সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। বাবুলাল মারান্ডির দল ঝাড়খণ্ড বিকাশ পার্টি (প্রজাতান্ত্রিক) এখন চন্দ্রবাবু নাইডুর খুবই ঘনিষ্ঠ। তিনিও তৃতীয় শক্তির নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলছেন।

বিজেপি জমানায় বাবুলাল মারান্ডি যখন ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী তখন বেশ কিছু কাজও করেছিলেন। কিছু রাস্তা পাকা হয়েছিলো, মাওবাদীদের বিরুদ্ধে বেশকিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই মাওবাদীদের হিংসার অন্যতম লক্ষ্য তিনি। নিজের ছেলেও নৃশংসভাবে খুন হয়েছে মাওবাদীদের হাতে। তাঁর কর্মকান্ডের সঙ্গে একমত হতে পারছিলো না বিজেপি নেতৃত্ব।

তাই রাতারাতি বাবুলালকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে সেই জায়গায় আনা হয়েছিলো অর্জুন মুন্ডাকে। বাবুলাল মারান্ডিকে সরানোর পর থেকেই বিজেপি জোট ছেড়েছে ছোট ছোট আঞ্চলিক দলগুলি। বিজেপি ছেড়েছে মধু কোড়াও। নিজের দলের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে জেরবার নি:সঙ্গ বিজেপির পাশে এখনও পর্যন্ত রয়ে গেছে একমাত্র জেডি(ইউ)। আসন ভাগাভাগি নিয়ে তাদের মধ্যেও শুরু হয়েছে চাপান উতোর।

ঝাড়খণ্ডের ইউ পি এ জোটের অবস্থা তথৈবচ। এ রাজ্যের সবাই জানেন আসন ভাগাভাগি নিয়ে শিবু সোরেন একপ্রস্থ দরকষাকষি করবেন। তারপরে সেই চিরপরিচিত সিদ্ধান্তমতো সদলবলে কংগ্রেসের কাছে আত্মসমর্পণ। তবে বামপন্থীদের জোট নিয়ে বেশ আশাবাদী এরাজ্যের মানুষ। জ্ঞানশঙ্কর মজুমদারের কথা অন্তত তাই।

২০০৪-এ লোকসভা নির্বাচনে ঝাড়খণ্ডে প্রথম প্রার্থী দেয় সি পি আই (এম)। রাঁচি কেন্দ্রে ৪০হাজার ভোট পেয়েছিলেন সি পি আই (এম) প্রার্থী রাজেন্দ্র সিং মুন্ডা। সি পি আই (এম-এল) ৮হাজার। কংগ্রেস যেহেতু হাজারিবাগ আসনে সি পি আই প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলো, তাই রাঁচি কেন্দ্রে সি পি আই ছিলো কংগ্রেসের সঙ্গে। এবার অবশ্য রাজ্যের চার আসনে চার বামপন্থী দল একজোট হয়েছে।

রাঁচি কেন্দ্রে সি পি আই (এম), হাজারিবাগে সি পি আই, ধানবাদে মার্কসিস্ট কোঅর্ডিনেশান পার্টি আর কোডারমায় সি পি আই (এম-এল)। বামজোট প্রসঙ্গে জ্ঞানশঙ্কর মজুমদার বললেন, স্থানীয় সি পি আই (এম-এল) নেতারা দীর্ঘদিন ধরে এই জোট করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সি পি আই (এম-এল)’র রাঁচির জেলা সম্পাদক শশীকান্ত কিংবা গোড্ডার অরুণ সহায়রা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে সি পি আই (এম)-এর সঙ্গে। সি পি আই (এম) বলেছে, জোট হতে পারে, তবে নীতির ভিত্তিতে। সেই নীতির ভিত্তিতেই বামজোটের প্রক্রিয়া আরো শক্তিশালী, দীর্ঘায়িত হতে পারে।

যদিও ছাতরা কেন্দ্রে সি পি আই (এম-এল) যে প্রার্থীকে দাঁড় করিয়েছে সেই প্রার্থীকে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সি পি আই (এম)। জ্ঞানশঙ্কর মজুমদারের কথায়, কেশব যাদব ওরফে দীনকরজি শুধু স্থানীয় মাওবাদী নেতা বলেই পরিচিত নয়, তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক খুনের অভিযোগ রয়েছে। একসময় পুলিস তাকে ধরতে ২লক্ষ টাকা পুরষ্কার ঘোষনা করেছিলো। রাঁচি জেলে বন্দী অবস্থায় থাকা এক আসামীকে সি পি আই (এম-এল)’র প্রার্থী করা কখনই সমর্থন করবে না। আর ‘লেভি’র টাকায় মোটা হওয়া মাওবাদী নেতারা মূলস্রোতে ফিরে আসতে বিভিন্ন বুর্জোয়া দলগুলির টিকিটের পেছনে ছুটছে।

হতে পারে কৌশল। তবে তাদের মূলস্রোতে ফিরে আসার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানায় সি পি আই (এম)। কথা বলতে বলতেই একাধিক ফোন এসেছে তাঁর হাতের যন্ত্রটায়। সব কথা বোঝা না গেলেও, এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না—লাল পতাকার নতুন ডাক পৌঁছেছে ছোটনাগপুর, সাঁওতাল পরগনার আদিবাসীদের কাছে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।