আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি গদ্যঃ একটা কবিতায় উঁকি দিয়ে যাওয়া চোখেরা

আমার হাতদুটো পা হয়ে গেলে আর পা হাত; তাহলে কি তুমি করমদর্নের সজ্ঞাটা পালটে দিবে

কবি গদ্যঃ একটা কবিতায় উঁকি দিয়ে যাওয়া চোখেরা ------------------------------------------------------------------ শিশুর মতন কাজেরা আমার কাঁধে চড়ে আছে; নানান কাজের চাপে আমি রীতিমত অনেকটা কুঁজো হয়ে আছি ইদানিং। প্রবাসে আমি যতই ভালো অবস্থানে থাকিনা কেন কাজের ফল ভালো না আসলে এইখানে আমরা সবাই খড়কুটো। একটা মাত্র বাতাস আর উড়ে যায় সব কিছু। তাছারা নিজের ব্যক্তিগত কিছু সমস্যাতো আছেই। সে যাক; এতো কিছুর মাঝে একটা কবিতাই বরং বিক্ষিপ্ত মনে প্রশান্তির হাওয়া বয়ে দিতে পারে।

তাই বেশ কিছুদিন ধরে আমি একটা কবিতাই চাচ্ছিলাম। একটা কবিতা অবশ্যই আসা দরকার। ভেতর থেকে প্রচন্ড তাগিদ অনুভব করতে পারি আমি। অঞ্জন দত্তের "মেঘ জমেছে আমার আকাশে" এই গানটা আমাকে খুব ভাবায়। আসলেইতো বয়সতো বেড়েই যাচ্ছে পাগলা ঘোড়ার মত।

এখনো আমি অনেককিছু গুছিয়ে উঠতে পারিনি। বাচ্চাটা আমার অনেক ছোট ওর দিকে তাকালেই আমার আরো বেঁচে থাকার ইচ্ছা বেড়ে উঠে ঠিক ওর বেড়ে উঠার মতই। তাই ইদানিং সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ছুটে যাই ফুটবল খেলতে। ফুটবল মাঠে যেতে হলে আমাকে ছোটখাটো একটা পাহাড়ি বনের পথ দিয়েই যেতে হয়। সেদিনও যাচ্ছিলাম।

আমি কি অন্ধ ছিলাম পুরো সপ্তাহ জুড়ে? প্রশ্নটা আমি যেতে যেতে নিজেকেই করছিলাম। বাসন্তি রোদে বাতাসেরা দোল দিয়ে যাচ্ছে চেরি গাছের ডালে ডালে। এই ছোটখাটো বন যেন সাদা চাদরে মুরি দিয়ে আছে। আমি কি অন্ধ ছিলাম? আমি দ্যাখিনি কেন আগে? জ্বর যেমন আমাদের শরীর কাপিয়ে আসে; ঠিক তেমনি শরীর কাপিয়ে আমার মনে কবিতার জন্য একটা অনুভুতি জেগে উঠে। আমিতো এই সময়টাকেই খুঁজেছিলাম; আমি অন্ধ ছিলাম।

আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি পাগলা বাতাসের দোলায় চেরির পাপড়িরা উড়ে উড়ে পড়ছে আমার গায়ে- মাথায়। নির্জন পথটায় সাদা চেরির গালিচা। আমার হাঁটার গতি ক্রমশঃ কমে আসে---একটা লাইন এসে যায় "বাতাস এসে গেলেই চেরির ডাল কাঁপে এ কেমন শিহরনে?" নাহ! কেমন জানি নিরস লাগছে। স্থিরতা দরকার; বাক্যটার খুব কাছাকাছি বসে তাকে অনুভব করা দরকার। তার ভেতরের রস আমার পান করা দরকার।

আমি বাক্যটার খুব কাছে গিয়ে বসতে চাই। তার আশপাশ ভালো করে দেখতে থাকি। তার গন্ধ কেমন? অবশ্যই তার গন্ধ আছে নাহলে এই বনে আমাকে মাতাল করলো কে? আমি বাক্যটার খুব কাছে বসে ভাবি। পাপড়ির উড়াউড়ি দেখি। শূন্যতায় কি রকম উড়ছে তারা।

ঝোপের কাছে একটা কাগুজে চরকি পরে আছে; হয়তো কোন বাচ্চা ফেলে রেখে গেছে। বাচ্চাটা কি খুব ডানপিটে ধরনের? চেরির রঙ এতো সাদা হয় কেন? এদের তো গত হয়ে যাওয়া শীতের তুষারের মত লাগছে; তুষার যেমন পরে আর সমগ্র পথ সাদা হয়ে থাকে। আমার প্রথম বাক্যটা ক্রমশঃ প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে উঠে চৈত্রের দুপুরের বাতাসের শব্দে। "ডানপিটে চৈতী বাতাসের শিষে শ্বেতাঙ্গী চেরির ডাল কাঁপে দুপুরের শূন্যতায় সাদা চরকির উড়াউড়ি তুষার তুমি ফিরে এলে" নাহ! দুপুরের রংটা কেমন আলসে লাগছে। আমার তো আজ খেলতে যেতেই মন চাইছিলোনা।

এইখানে "অলস" ব্যাপারটা চলে এলে কেমন হয়? তুষারের দিনতো এটা না? সে তো চলে গিয়েছে উত্তর মেরুতে। যেখানে আজীবন শীত। সে এলো কেন? বাক্যটা পালটে যাচ্ছে আমার হাঁটার সাথে সাথে। "ডানপিটে চৈতী বাতাসের শিষে শ্বেতাঙ্গী চেরির ডাল কাঁপে আলসে দুপুরের শূন্যতায় সাদা চরকির উড়াউড়ি তুষার তুমিতো গিয়েছিলে উত্তরের গ্রামে আবার ফিরে এলে কেন" ততক্ষনে আমি বন পাড়ি দিয়ে চলে এসেছি মাঠে। আমার খেলায় আর মন বসেনা।

কবিতার নেশা আমাকে পেয়ে বসেছে। তবুও আমি খেলছি। আর আমার মনের মাঝে খেলা করে যাচ্ছে বাক্যগুলো; সেই বনের মাঝে পাওয়া বাক্যগুলো। তুষার চলে আসছে আবার তার আগে চলে আসে চেরি গাছ ফুল সাদা চরকি। এদের মধ্যে একে অপরের সাথে যোগসূত্র গুলো কি? বুনন টা কি ঠিক আছে? বেমানান না তো? অবশ্য তুষার কে বাদ দিয়ে দেয়া যেতে পারে; ওখানে অন্য কিছু চলে আসুক।

ভাবছি আর নিজের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমি তুষার কে বাদ দিতে পারলাম না। সে তো একটা কল্পনায় চলে এলো একটা সময় যেই সময়ে তার আসার কথা না। কিন্তু আমার কল্পনার অনেকটা জায়গা জুড়ে সে বার বার চলে আসছে। ঠিক আছে আসবি যখন তাহলে একটা (?) জিজ্ঞাসা চিহ্ন এঁকে দেই।

থাকুক না লাইনটা এভাবেই। আসুক না কবিতা। আমি ক্রমশঃ ভারমুক্ত হই। আমার পায়ে বল চলে আসে। আমি এগিয়ে চলি আর সন্ধ্যা নেমে আসে ক্রমশঃ।

সে রাতে আর কবিতাটা নিয়ে ভাবিনি। দাদরা (আমার ছেলে) ও পাশে থাকলে আমার আর কিছুই করতে ইচ্ছা জাগেনা। তবে বাক্য গুলো লিখে রাখা দরকার। আমার বউ কে বলি; একটা কাগজ আর কলম দিতে। আমি বাক্যগুলো লিখে ফেলি একটানে।

তাকে শুনাই। সে হেসে বলে দেখবা কাল "এই কবিতার লাইনগুলো পরিবর্তন হয়ে যাবে। তুমি ঘুরাইয়া পেচাইয়া এইখানে যৌনতা নিয়ে আসবা আমি জানি"। তখনি আমার ভেতরে যৌনতা বিষয়টা এসে জানান দিয়ে যায় " এই কবিতায় আমাকেও একটু রেখ"। পরের দিন বেলা করে ঘুম থেকে উঠি।

ছুটির দিনে তাই হয়। সকালের নাস্তাটা দুপুরের খেয়ে ফেলি। আমাকে বের হতে হবে; একটা নির্জন জায়গায় বসতে হবে। কবিতাটা শেষ না করে আমি শান্তি পাচ্ছিনা। আমি খেয়ে বের হয়ে যাই; পাহাড়ের কাছের পার্কে দিকে।

আমি কাগজটা বের করে গতরাতে টুকে রাখা বাক্যগুলো আবার পরতে থাকি। আমার ভেতর যৌনতার সে দাবীটাও কিন্তু চলে যায়নি তখনো। আমি ভাবছি আর মনে মনে ঠিক করে রাখলাম যেই লাইনটা আসবে সেখানে যৌনতা ব্যাপারটা নিয়ে আসবোই তবে তা খুব সংক্ষেপে। আমি একটা সিগারেট ধরাই। পার্কের পাশেই একটা বাড়ি আছে।

তার সামনে খোলা একটা ঘাসের উঠোন। সেখানে কাপড় শুকানো তার। কিছু কাপড় ঝুলছে। আমি সেই কাপড় নিয়ে ভাবি। সেই কাপড়ের মাঝে দাগের কথা ভাবি।

এইখানে তো ঋতুস্রাবের চিহ্ন ও থাকতে পারে। আমি ঋতুস্রাব নিয়ে ভাবছিলাম। ঠিক ওসময় একজন মহিলা (মহিলা বললে সে রাগ করতে পারে) চলে এলো। তার হাতে সাদা একটা কিছু। সে দুপুরের রোদে তারে মেলে দিল; এবার বুঝা যাচ্ছে সেটা বিছানার চাদর।

আমি মহিলার মুখ দূর থেকে খুব ভালো ভাবে দেখতে পারছিনা। কিন্তু তার অগোছালো বেশভূষা আমাকে বুঝিয়ে দেয় তার রাতজাগার ক্লান্তি। আমি মনে হয় আমার পরের বাক্য পেয়ে গেছি। এবার আরেকটা সিগারেট ধরাই। "খোলা উঠোনের তারে ভেজা বিছানার চাদর মেলে দিয়ে যায় যে নারী" এরপর আর লাইন আসেনা।

আবার চিন্তা। নারী তোমার সামনেএসে আমার ঠিক বসা হইনি ভালোভাবে। তুমি কাছে চলে এসো। বাক্যটা খুব নিরস। যৌনতার টিউনটা ঠিক মত হচ্ছেনা।

"নারী" শব্দটা আমি অনেক জায়গায় ব্যবহার করেছি; সবুজ মেয়ে কথাটাও তাহলে অন্য কিছু দরকার। যাই আসুক তা যেন রস নিয়ে আবির্ভূত হয়। আমার কাছে এখন "ঋতুস্রাবের চিহ্ন" কথাটা ভালো লাগছেনা। কারন তার মধ্যে আমি যে ক্লান্তির আর অগোছালো ভাব দেখলাম সেখানে আমি অন্য কিছু এনে দাঁড় করাতে চাই। "ঋতুস্রাবের চিহ্ন" খারিজ করা হোক।

দিলাম খারিজ করে। কিন্তু বাক্যটা নিয়ে ভাবা দরকার। আমি আরেকটা সিগারেট ধরাই। নারী তুমি কাছে এসো। আমার একটা সম্পূর্ণ বাক্য দরকার।

স্তন কাপিয়ে নিতম্ব দুলিয়ে ওভাবে ঘুরে চলে যেওনা। নারী চলে যাচ্ছে। তাকে ফেরানো দরকার। আমার একটা সম্পূর্ণ বাক্যের দরকার। আমার চোখে বাংলা ছবির চিরায়ত একটা চিত্রকল্প ভেসে উঠে।

নায়ক বাশী বাজাচ্ছে আর নায়িকা চলে আসছে। কিন্তু এইখানে নায়ক কে কি চরিত্র দেয়া যেতে পারে? আমার সুমনের "বাশুরিয়া বাজাও বাশী" গানটার কথা মনে পড়ে গেল। তাহলে নারী তুমি বরং গোপিনী হও। আমি পেয়ে গেছি আমার বাক্য। "খোলা উঠোনের তারে ভেজা বিছানার চাদর মেলে দিয়ে যায় ঘুমোঘুমো গোপিনী তবে কি এসেছিলো অভিমানী বাসুরিয়া?" বাক্যগুলো লিখার পর আমার মধ্যে কেমন জানি একটা অলস ভাব চলে আসলো।

পার্কের পাশেই লাগোয়া পাহাড়ি ঝোপ। সেই ঝোপে একটা গিরিবাজ কবুতর। খুব গম্ভীর সুরে ডেকে যাচ্ছে। আর আমার দুপুরের অলসতা বেড়েই যাচ্ছে ক্রমশঃ। কিন্তু কবিতাতো শেষ হলোনা? আবার এক যন্ত্রনা।

পরের বাক্যগুলো এভাবেই চলে আসে- "পাহাড়ি ঝোপে গিরিবাজের গুররু-গুররু ডাকে এ কেমন অনন্ত অলস দুপুর?" আমার চোখ বুজে আসছে। দুপুরের এই ঘুমটা ভাতঘুম। অথচ বেশকিছুদিন ধরে একটা অসম্পূর্ণ একটা কবিতার কিছু বাক্য বারবার ঘুরে ফিরে যাচ্ছে। আমার ঘুমের জড়তায় সেই কবিতার কিছু বাক্য এসে দাঁড়ায়। নষ্টালজিয়া।

শৈশব বেলায় মায়ের খুতির পয়সা চুরি করে বাজারের সাইকেল ভাড়া করে সাইকেল চালাতে শিখতে গিয়েছিলাম। পরে হাত পা ছিলে যায়। মা তখন ঠিক এমনি একটা দুপুরে একান্নবর্তী উঠোনে সবার সামনে আমাকে খুব পিটিয়েছিল। অনেকেই আমার ভবিষৎ ঠিক করে ফেলে; লজ্জায় আমার মাথা নুয়ে পরে অলস দুপুরের খা খা রোদ্দুরের উঠোনে। আমি একা হয়ে যাই ; আমার চোখের ফোটারা পরে তপ্ত দুপুরের উঠোনে আর ছেন ছেন করে শুকিয়ে হারিয়ে যায়।

আমি একা হয়ে যাই। বাবা তখন একটা সাইকেল কিনে দিল আমাকে। সে আমার সাইকেল এর ক্যারিয়ার ধরে রাখতো পেছন থেকে আর আমি সাইকেল চালাই। এভাবে শিখে ফেলি সাইকেল চালনা। তখন আর বাবা আমার পেছনে আর ধরে থাকেনা।

আমি শার্টের বোতাম খোলা দুপুরে সাইকেল নিয়ে ছুটে চলি। বড় হয়ে উঠি। বাবার পেছন পেছন আর ঘুরা হয়না। অনেক বড় হয়ে যাই;অনেক দূরে চলে আসি। এরপর বোধ করি শেষের বাক্যগুলো কবিতায় লিখা যেতে পারে- "আমার ভাতঘুমে একটা সাইকেল পাল্লা দেয় উড়ে চলা চিলের সাথে সাইকেলের ক্যারিয়ার ধরে যে হাত ছিল সে হারিয়ে যায় ক্রমশঃ দূর-------------------বহুদুর-----------------------অনেকদুর আমার আর সেই হাতের ফারাকে শুয়ে থাকে সাপের যাত্রার ছাপ"


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।