আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধোঁকা- গল্প (দ্বিতীয়াংশ)



৩ প্ল্যানচ্যাটের কথায় শাহেদ কিছুটা গাইগুঁই করছিল। ক্ষীণ কন্ঠে দু একবার আপত্তিও করলো। কিন্তু নীরার আগ্রহের তোড়ে তা চাপা পড়ে গেলো। অমাবস্যার রাতে চাঁদ না থাকলেও ধূলামুক্ত ঝকঝকে মেঘহীন আকাশে তারাগুলি প্রাণপণে আলো বিলিয়ে যাচ্ছে। খোলা আকাশের কাছাকাছি এসে, নীরার উপরও যেন কিছুটা তারল্য ভর করেছে।

ডিনারের সময় রুনি আর সাজ্জাদের কথার ফাঁকে কয়েকবার ফোঁড়ন কেটে কিছুটা রসিকতারও চেষ্টা করছিল। তবে তারা দুজন সময়টা বেশ উপভোগ করছিল। ব্যাপারটা কেন জানি শাহেদের ভাল লাগলো না। আজকে অনুকে তার খুব মনে পড়ছে। গা থেকে ছাত্রত্বের গন্ধ তখনও যায়নি।

চিরকাল ভীরু মনের শাহেদের অনুকে ফিরিয়ে দিতে খুব বেশী ভাবতে হয়নি। সে অনুকে বোঝানোর খুব চেষ্টা করছিলো, যাতে অ্যাবরশন করে ফেলে। কিন্তু অনুর এক কথা। তাদের ভালবাসার প্রথম চিহ্নকে হারিয়ে যেতে দিবে না। শাহেদ চলে গিয়েছিল তার মফস্বলের শহরে।

অনু আর কোন যোগাযোগ রাখেনি। পরে সে জানতে পারে, সাজ্জাদের সাথে অনুর বিয়ের কথা। পরিবারের সবার তীব্র আপত্তিকে উড়িয়ে দিয়ে সাজ্জাদ ঠিকই দাড়িয়েছিল তার ভালোবাসার পাশে। ৪ "শাহেদ ভাই, ভয় পাচ্ছো না তো?" -রুনির গলায় কি হালকা শ্লেষের সূর? "এই সব ছেলেমানুষীতে আবার ভয়?!!"- শাহেদ বিব্রতভাব কাটানোর চেষ্টা করলো হালকা হাসি দিয়ে। নীরাও হাসলো।

তবে তার গা কিন্তু একটু ছম ছম করছিল। যে রুমটায় তারা বসেছে, সেটা আসলে স্টোররুম। বাড়ির পেছন দিকটায়। কখনো অতিরিক্ত অতিথী থাকলে, এখানে ঠাঁই হয়। সারা বছর বন্ধ থাকেই বলেই হয়তো কেমন যেন একটা ভ্যাপসা গন্ধ।

একটি মাত্র দরজা, জানালা। রুনি সেটাও বন্ধ করে দিয়েছে। উইজ্যা বোর্ডকে ঘিরে বসেছে চারজনে। রুনি, শাহেদ আর সাজ্জাদের মাঝখানে। সে বিড়বিড় কিছু একটা পড়ছিল।

তার হাত দ্রুত নাড়াচাড়া করছে বোর্ডের উপর। মোমের আলোর প্রসারিত ছায়া পড়েছে কাঠের দেয়ালে। মৃদু নাড়াচাড়ার ভেতর দিয়ে ছায়াগুলি যেন মানুষগুলির অবয়বের বাইরেও কিছু একটা সংকেত দিচ্ছে। পাড়াগাঁয়ের এই সময়টা চারদিক প্রায় নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ তানে ভেসে আসছিল শার্দুলের আওয়াজ।

দুঃস্বপ্ন দেখলে নাকি কুকুরগুলি এভাবে কাঁদে। হঠাৎ কোথাও কাঁদতে শুরু করলো শকুনের শাবক। একেবারে মানব শিশুর কান্না! রুনির গা থেকে একটা খুব চেনা সৌরভ ভেসে আসছিলো। সাজ্জাদ কিছুটা আনমনা হয়ে পড়লো। বিয়ের পরপর তিনটা মাস খুব কষ্টে গেছে তাদের; সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো এই সম্পর্ক থেকে।

তবে ভালবাসার সেই প্রহরগুলি আজো জ্বলজ্বল করে তার স্মৃতিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দুজন মানুষ ছিল মনে হয় তারা; অন্তত সে ছিল! হঠাৎ পড়ে গিয়ে অ্যাবরশনের পর থেকেই একটু একটু রঙ বদলাতে শুরু করে সবকিছু। অনু সন্দেহ করতে থাকে সাজ্জাদকে। তখন তারা থাকতো এই চা বাগানে। পরের একটা বছর খুব দুঃসময় গেছে।

অনুর প্রায় মাথা খারাপের মতো অবস্থা হয়ে যায়। সবাইকে সন্দেহ করতে থাকে তার দূর্ঘটনার জন্য। বার বার বলার পরও কাউন্সিলিং এর জন্য যেতে রাজী হয়নি। বরং সাজ্জাদই দুবার পরামর্শ নিয়ে এসেছে সাইক্রিয়াটিস্টের কাছ থেকে। তারপর সেই অভিশপ্ত রাত।

একটু চমকে গেলো সাজ্জাদ স্মৃতিটা মনে করে। সেদিনও ছিল অমাবস্যার রাত। সন্ধ্যার পর থেকেই খুব অস্থিরতা দেখাচ্ছিল অনু। বিকেলে কার সাথে যেন দীর্ঘ ফোনালাপ করছিল। সাজ্জাদের শরীরটা ঠিক ভাল ঠেকছিল না সেদিন।

কেমন যেন একটা ঘোর ঘোর লাগছিল। মাঝে মাঝে চোখে বিভ্রম হচ্ছিল। একবার মনে হলো শাহেদকে দেখলো বাগানের কোথাও। শাহেদ?! এখানে, এসময় ?! সে তো স্টেট্‌স এ থাকার কথা। পই পই করে খুঁজেও আর দেখলো না।

কেন যেনো খুব রাগ হচ্ছিল অকারণে। এর উপরে আবার অনুর অকারণ অস্থিরতা। রাতে তারা কেউ কিছু খেলোনা। কাজের লোকগুলিও ঝগড়ার অজানা আশংকায় বিদায় নিল দ্রুত। বাগানে পায়চারী করে ঘরে ঢুকার আগে আবার দেখলো শাহেদকে! এবার রুম থেকে বের হয়ে যেতে স্পস্ট দেখা গেলো।

চিৎকার করে ডাক দিল সে অনুকে। দিশেহারার মতো খুঁজছিলো তাকে। এরপর আর কিছু বলতে পারেনা সে। সকালে যখন অনুর মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেলো পাহাড়ের ঢালে, তখন সাজ্জাদকে প্রায় মূমুর্ষ অবস্থায় উদ্ধার করা হলো ঝোপে আটকে থাকা অবস্থায়। অনুর সুইসাইড এটেম্প্ট ঠেকাতে গিয়ে মরতে বসেছিল সাজ্জাদও।

নিজের চোখকে অবিশ্বাস না করলেও শাহেদকে দেখার ব্যাপারটা কাউকে জানায়নি সাজ্জাদ। ৫ ধূপের গন্ধে বর্তমানে ফিরে এলো সে। বেশ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে এবার ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলো রুনি। "আপনি কি এসেছেন? আপনি কি এসেছেন?" মোম থেকে ধোঁয়ার ক্ষীণ ধারা কুন্ডলি পাকিয়ে উঠছে। ধূপের গন্ধ কেমন যেন একটা মাদকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

হালকা হিমেল বাতাসের ছোঁয়ায় গা টা একটু শির শির করে উঠলো নীরার। আবার ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো রুনি- "আপনি কি এসেছেন? আপনি কি.............। " মাঝপথে কথা থেমে গেলো তার! হাত নড়তে শুরু করলো খুব দ্রুত। উইজা বোর্ডের ইয়েস লেখা বৃত্তে এসে থমকে গেলো আঙুল! সাজ্জাদ দেখলো মোমবাতির শিখাটা হঠাৎ করে অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপতে শুরু করলো! (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।