আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“কচি এবং তার মায়ের গল্প”

When a man has put a limit what he will do, he puts a limit in what he can do

ছোট্ট ছেলেটি ছিল খুবই দুষ্টু, ডানপিটে ছেলে। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়াত। মানুষের গাছে ঢিল মেরে আম খেত, পেয়ারা খেত, সারাদিন তার ছোট্ট বন্ধুদের সাথে ঘুরাঘুরি করত এবং খেলত। স্কুল তার মোটেও ভাল লাগতনা। স্কুল ছিল তার কাছে খুবই বিরক্তিকর।

এক কথায় বলতে গেলে, তার স্বভাব-চরিত্র, আচরণ সব কিছুই যেন কাজী নজরুল ইসলাম এর মত। সে সকাল বেলা স্কুলে যাবার জন্য বাসা থেকে বের হত ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই সে স্কুলে যেতনা। স্কুল টাইমটা বাইরে বাইরে কাটিয়ে ছুটির সময় খুব ভয়ে ভয়ে বাসায় ফিরত। কারণ, মা যদি মার দেন। ছেলেটির নাম ছিল কচি।

পড়ত ক্লাস টু তে। তার এক বড় ভাই ছিল ক্লাস এইট এর ছাত্র এবং ছোট বোনটির বয়স মাত্র দু' বছর। বাবা চাকরি করতেন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে। বাবার চাকরির সুবাদেই তারা থাকত করাচিতে। কচির মা ছিলেন গৃহিণী।

একদিন...... দিনটি ছিল ১১ই রমজান। কচির বাবা হঠাৎ মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে ভর্তি করানো হল। পরে ডাক্তাররা টেস্ট করে দেখলেন এবং ধরা পড়ল পেপটিক আলসার। অপারেশন করা ছাড়া বাঁচানো যাবেনা।

তাই তার অপারেশনের তারিখ পড়ল। বাবার কি হয়েছে, কিভাবে অসুস্থ হলেন, মারাত্মক রোগ হয়েছে, এ সকল বিষয়ে বোঝার কোন ক্ষমতাই ছিলনা ছোট্ট কচির। বরং বলতে গেলে মনে মনে সে একটু খুশিই হল। কারণ মা এখন সকাল বেলা হাসপাতালে বাবার কাছে যান, আর ফিরেন সেই বিকেলে। তাকে আর কে খুঁজে পায়??? মা এর অনুপস্থিতিতে সে যেন এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক!!! বাইরে ঘুরোঘুরি করতে আর কোন বাঁধা নেই।

আগে তো শুধু এখন স্কুল টাইমে বাইরে কাটাত। এখন সারাদিন কাটাতে পারছে। কি মজা করেই না কাটাচ্ছে সে তার দিনগুলো। কিছুদিন পর........ এরপর…… দিনটি ছিল ১৯শে রমজান। কচির বাবা অসুস্থ হবার ঠিক ৮ দিন পরের কথা।

রোজার কারণে কচির মাকে সারাদিন অভুক্ত থাকতে হয় এবং হাসপাতালে বাবার সেবা-যত্ন করতে হয়। সেদিন বিকেল বেলা কচির মা হাস্পাতাল থেকে বাসায় ফিরছিলেন। কচির বাবার এক বন্ধু, কচির মা কে বললেন যে, কচির বাবার যে রোগ হয়েছে, তাতে তাঁকে বাঁচানো সম্ভব না। একথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লেন কচির মা। একে তো রোজা রেখেছেন, সারাদিন না খেয়ে আছেন, অন্যদিকে হাসপাতালে বাবার সেবা-যত্ন করা, এত পরিশ্রমের পর যখন কথাটি শুনলেন তখন যেন পা এর নিচ থেকে মাটি সরে গেল।

চারদিক অন্ধকার দেখতে লাগ্লেন তিনি। শুরু হল প্রচণ্ড মাথা-ব্যাথা। ঔষধের দোকান থেকে কিনে নিলেন মাথাব্যাথার ট্যাবলেট। বাসায় ফিরলেন আসরের একটু পরে। প্রচণ্ড মাথা-ব্যাথায় কাতর হয়ে খাটে শুয়ে পড়লেন।

ঐদিকে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে কচি ভুলেই গিয়েছিল যে সে আজ ভাত খেতে বাসায় যায়নি। আবার স্কুল তো ছুটি হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই। এখন যদি বাসায় যাই তাহলে তো মা মারবেন। কি যে করবে সে, ভেবে কুল পাচ্ছেনা। বুদ্ধি খুঁজতে লাগল, কিভাবে এই বিপদ হতে বাঁচা যায়।

কিন্তু কিছুতেই তার দুষ্টু মাথা থেকে কোন বুদ্ধি বের হচ্ছেনা। অন্য সময় দুষ্ট বুদ্ধিতে মাথা গিজ গিজ করে, আর এখন সব হারিয়ে গেল?? এই বিপদের সময় তার সুসময়ের ছোট্টবন্ধুরাও তাকে কোন বুদ্ধি দিতে পারলনা। তবুও ভীরু ভীরু মন নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিল। বাসায় আসল ঠিকই, কিন্তু ভয়ে ভিতরে গেলনা। হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়।

বাড়ির সাথেই লাগানো একটি পেয়ারা গাছ ছিল। তাড়াতাড়ি করে বাড়ির পাশের পেয়ারা গাছ বেয়ে উঠল সে এবং মা এর রুমের জানালার পাশ দিয়ে উঁকি মারল। কিন্তু মা এর রুমের দিকে তাকিয়েই সে বিস্মিত হল। মা বিছানায় শুয়ে প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতরাচ্ছেন এবং পাশের বাড়ির খালারা তার মায়ের সেবা-শুশ্রুষা করার চেষ্টা করছেন। ওদিক দিয়ে মা এর অবস্থা খারাপ হতে আরো খারাপের দিকে যেতে লাগল।

কিন্তু, মা বলে কথা, প্রচণ্ড কষ্টের মধ্যেও ভুলে যাননি যে তার আদরের দস্যু সন্তানন্টি আজ দুপুরে ভাত খেতে আসেনি। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, কচি এখন বাড়ির বাইরে কোথাও লুকিয়ে আছে এবং ঘরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে। পাশের বাড়ির খালাদের বললেন কচিকে ডেকে দেবার জন্য। খালারা কচিকে খুঁজতে খুঁজতে দেখলেন যে কচি পেয়ারা গাছের মগডালে উঠে মায়ের রুমের জানালা দিয়ে মা এর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে। খালারা কচিকে নামতে বললেন এবং নির্ভয় দিলেন যে মা তাকে মারবেন না।

গাছ থেকে নেমে আসার পর খালারা তাকে খেতে দিলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর এই ছোট্ট মানুষটি অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছিল, তার উপর মা এর পিটুনি খাবার ভয় তো আছেই। খালারা তাকে আদর করে পেট ভরে খাইয়ে দিলেন। সে বরং বুঝতে পারলনা আজ হঠাৎ তার সাথে এমন আচরণ কেন করা হচ্ছে?? ভাত খাওয়া শেষ হলে মা কচিকে ডাকলেন এবং বললেন, "আব্বু, আমার মাথায় খুব ব্যাথা, মাথাটা একটু টিপে দাওনা"। একথা শুনে কচি তার ছোট্ট হাত এর নরম আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে মা এর কপাল বুলিয়ে দিচ্ছিল।

মা পরম আদরে কচিকে বুকে টেনে নিয়ে কচির কপালে চুমো দিলেন। অন্যদিকে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলো আর মায়ের অবস্থা আরো খারাপ হচ্ছে। মাগরিবের আযান পড়ল। মা দু'-তিন কোষ কমলা খেলেন। এর বেশি আর কিছু খেতে পারলেন না।

কিছুক্ষণ পর কচি দেখল মা তার বড় ভাইকে ডেকে কি যেন সব কথা বলছেন, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। সে লক্ষ করল, তার মায়ের চোখ গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু; এবং তার ভাইও কাঁদছে!!! সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলনা তার মা এবং বড় ভাই কাঁদছে কেন??? বরং অবাক হল আজকে মা তাকে হঠাৎ করে এত আদর করলেন কেন??? মা এর অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে হাসপাতালে নেয়া হল। কিন্তু হাসপাতালে পৌঁছুবার আগেই তার মা মারা গেলেন। চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন পৃথিবী থেকে।

বিদায়ের আগে কচির কপালে দিয়ে গেলেন স্নেহমাখা এক চুমো। ডাক্তাররা বললেন, মা এর কপালের এক শিরা ছিড়ে গিয়েছে, যার কারণে তার মা মারা গিয়েছে। সে বুঝলনা মারা গেলে কি হয়??? বাবাকে প্রথমেই এই খবর দেয়া হলনা। কারণ, অসুস্থ অবস্থায় এ খবর শুনলে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বেন। ধীরে ধীরে বাবাকে জানানো হল।

যেদিন মাকে কবর দেয়া হবে সেদিন বাবা অসুস্থ শরীর নিয়ে হাস্পাতাল থেকে আসলেন। বাবাকে অনেকদিন পর দেখে খুশিতে লাফ দিয়ে বাবার কোলে উঠে পড়ল কচি। বাবা পরম আদরে সন্তানকে বুকে টেনে নিলেন। বাবার কোলে থেকে কচি লক্ষ করল মাটি কেটে গর্ত করে সেখানে মাকে রেখে দিচ্ছে সবাই। কচি আব্বুকে প্রশ্ন করল, "আব্বু, আম্মুকে ওরা এই গর্তে রেখে দিচ্ছে কেন???" ।

অবুঝ সন্তানের এই কথা শুনে বাবার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। এই প্রশ্নের জবাব কিভাবে দিবেন তিনি??? কচি কিছুই বুঝলনা। শুধু বাবার কোলে বসে বাবার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখল যে বাবা কাঁদছেন। গতকাল কচির মুখে যখন তার জীবনের এই নির্মম কাহিনী শুনছিলাম, তখন আমার মাথায় শুধু এই চিন্তাই ঘুরপাক খাচ্ছিল। মা এর মমতাহীন অবস্থায়, মা এর আদর-স্নেহবঞ্চিত এক সন্তান কিভাবে এতদূর আসতে পারে??? মা এর অভাব কি সে কোনদিনই অনুভব করেনি??? সে ঘটনার পর কচি ক্লাস 5 পর্যন্ত পাকিস্তানে ছিল।

তারপর দেশে আসার পর ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে SSC ও HSC এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারী পাশ করে আজ সে একজন পরিপূর্ণ ডাক্তার। মানবসেবায় উৎসর্গ করেছেন নিজ জীবন। এই ছোট্ট ছেলে "কচি" হলেন আমার ছোট খালু। নিজের মুখে নিজের জীবনের সবচাইতে দুঃখের কাহিনী, বেদনার কাহিনী শুনালেন আমাকে। অথচ তার চেহারা ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।

হয়তো মহাকালের স্রোতে, কালের নির্মম বাস্তবতায় তার হৃদয় হতে সে দুঃখ মুছে গিয়েছে। কিন্তু, এইরকম বাস্তব জীবনের নির্মম সত্য কাহিনী শোনার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এই প্রথম। তাই, হয়তো নিজের অজান্তেই আমার দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু..........

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।