আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লাশবাবু (৪)



মাস তিনেক কেটে গেলেও রাণীর অস্থিরতা কমেনি। সারাদিন একটা দুটো কথাও তারাপদ'র সঙ্গে হয় কি হয় না। একদিন তারাপদ নিজেই রাণীকে বললো-- --তোমার কি অসুখ করেছে? শরীরটা যে খুব রুগ্ন হয়ে পড়ছে-- --কিচ্ছু হয়নি আমার। --ওটা তো রাগের কথা। এত রাগ-ই বা কিসের কে জানে! আমি তো কোনো অযত্ন তোমার করিনি-- --হরিশের খবর তুমি জানো না? আচমকা এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে হকচকিয়ে গেল তারাপদ।

রাণীর দুটো চোখে আগুন জ্বলছে! --হরিশের সঙ্গে তোমার কি এখন দেখা হয় না? মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো তারাপদ। --তিনমাস ধরে হরিশের কোনো খোঁজ নেই। তুমি জানো না? --হ্যাঁ--তা মাস তিনেকই হবে বোধহয়। আমার সঙ্গেও তো দেখা হয় না আজকাল-- --অন্য কোথাও চলে গেছে কি না জানো? কিছু শুনেছো? --কই--তেমন তো কিছু শুনিনি! --বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে বলে কেউ কেউ বলছে--কিন্তু ওর বডি তো পাওয়া যায়নি! --হ্যাঁ, তাহলে তো বডি পাওয়া যেত-- তারাপদকেও খুব চিন্তিত দেখালো। --আট-দশজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।

একেবারে উবে গেল কি করে অতগুলো লোক? --যদি বাসে উঠেছিল তবে খালের জলে ভেসে যেতেও পারে। --মজা কোমর জলের খাল--এতগুলো লোক ভেসে যাবে কোথায়? এতদিনেও তার হদিশ পাওয়া যাবে না? --এসব নিয়ে পুলিশ ভাববে। আমি কি করে বলবো? একটু বিরক্ত হলো তারাপদ। --হরিশকে তুমি হিংসে করতে না? জ্বালা ধরতো না তোমার? --যে কোনো পুরুষমানুষেরই হিংসে হওয়ার কথা। তাতে কি? --তুমি ওকে জ্যান্তো পুঁতে দাওনি তো? --আমি লাশ নিয়ে কারবার করি রাণী।

একটা পিঁপড়ে মারতেও আমার খারাপ লাগে। না হলে কবেই তোমার চোখের সামনে হরিশ খুন হয়ে যেতো-- হঠাৎ মুখ ফস্কে কারবারের কথা বেরিয়ে গেল তারাপদ'র। --জানি। লাশ পচিয়ে কঙ্কালের বেচা-কেনা করো তুমি। ছি:! বলতে বলতে ফের নাকে আঁচল চাপা দিল রাণী।

তারাপদ প্রসঙ্গ পাল্টে বললো-- --বিয়ের দিন তুমি কি চাও প্রতিবছরই আমি জানতে চাই। তুমি কিচ্ছু চাও না। পরশু আমাদের বিয়ের দিন--এবারেও জানতে চাইছি, বলো কি চাও? --হরিশকে চাই। তার খোঁজ এনে দিতে পারো? রাণীর স্পষ্ট ইচ্ছে শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো তারাপদ। তারপর ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো-- --দেখি, কোনো খোঁজ পাই কিনা! আর কিছু চাও না? --না।

--তবু প্রতি বছরের মতো এবারেও আমি তোমাকে কিছু একটা দেব। যা পেলে তুমি খুব খুশি হবে। পরশু রাতে একবারটি আমার ঘরে এসো-- বিয়ের দিন সকাল থেকেই তারাপদ মহা ব্যাস্ত। ভালো ভালো বাজার করা থেকে নিজের পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারেও যথেষ্ট মনযোগ দিল। এক ফাঁকে শার্টের দুই পকেট ভরে ঝরা বকুল ফুল কুড়িয়ে এনে একটা প্লেটের ওপর রেখে জল ছিটিয়ে দিল।

বকুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লো ঘরে। রাণী বকুল ফুল বড্ড ভালোবাসে। ছোট বেলা দেখতে দেখতে অন্ধকারের দিকে ঢলে পড়লো। তারাপদ পাটভাঙ্গা ধূতি, ইস্ত্রি করা শার্ট গায়ে চড়িয়ে সারা শরীরে আতর ঘষে নিল। সারাদিন ধরে ঘরটাকেও গুছিয়েছে সুন্দর করে।

খাটে পেতেছে নতুন নকশাদার চাদর। রাণী বহুকাল এ ঘরে ঢোকেনি। আজ আসবে। বিবাহ বার্ষিকীতে ওর আর মন নেই। তবু তারাপদ'র মন বলছে রাণী আজ এঘরে একবার আসবেই।

বিয়ের আজ পনেরো বছর পূর্ণ হবে। পনেরো বছর! তারাপদ হিসেব করতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল। পনেরো বছর আগে তিরিশ বছর বয়সে সতেরো বছরের রাণীকে বিয়ে করেছিল। তাহলে রাণীর বয়স এখন বত্রিশ! অথচ রাণীর শরীর পনেরো বছর পরেও সতেরো থেকে কতটা বেড়েছে? তারাপদ'র শরীরে কিন্তু পনেরো বছরের ক্ষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চুলে পাক ধরেছে।

সামান্য হলেও গাল ভেঙ্গেছে। পরিশ্রমের ক্ষমতাও কমেছে। রাত গভীর হচ্ছে ক্রমশ:ই। ন'টা বেজে গেল। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলো তারাপদ।

রাণী কি শেষপর্যন্ত সত্যি আসবে না? একটু পরেই কিন্তু রাণী দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। চুলে বোধহয় রোজ তেলও দেয় না। চুল বাঁধে না কতদিন কে জানে! পিঠের ওপর এলো খোঁপা করে রেখেছে। চোখ দুটো ঢুকে গেছে গর্তে। তবু কী দ্যুতিময় দৃষ্টি! তারাপদ দু'পা এগিয়ে বললো-- --এসো, ভেতরে এসো।

রাণী ঘরে ঢুকে তারাপদ'র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো-- --হরিশের খোঁজ পেয়েছো? --এদিকে এসো-- বলে বহুকাল পরে রাণীর ডান হাতটা ধরে পূবের দেওয়ালের সামনে নিয়ে এলো। আড়াই ফুট চওড়া সাত ফুট লম্বা একটা ঝকঝকে কাঠের আলমাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তারাপদ বললো-- --তোমাকে আজ যা দেবো বলেছিলাম তা এর ভেতরে রয়েছে। চাবি দেওয়া নেই। তুমি পাল্লা খুললেই দেখতে পাবে। আলমাড়িটা তোমার।

--কিন্তু হরিশের খবরটা তো-- --ওসব কথা এখন থাক না রাণী। পরে হবে। আগে এই আলমাড়িটা তুমি নাও-- একটু ইতস্তত: করে দু'হাতে আলমাড়ির পাল্লা দুটো একটানে খুলে ফেললো রাণী। সঙ্গে সঙ্গেই গলা দিয়ে একটা চাপা জান্তব শক্দ বেড়িয়ে এলো বিকটভাবে। পাথরের মতো নিশ্চল রাণী বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো ঝকঝকে প্রমাণ সাইজের কঙ্কালটার দিকে।

যার গলায় ঝুলছে চকচকে সোনার চেনটাও! কয়েক সেকেণ্ড পরেই রাণীর দুটো হাত আলমাড়ির পাল্লা থেকে আলগা হয়ে গেল। পেছন দিকে লুটিয়ে পড়ার আগেই পরম যত্নে রাণীকে দু'হাতে মধ্যে তুলে নিল তারাপদ। অনেকক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে জাপ্টে রাখার পর শুইয়ে দিল বিছানায়। মাথার বালিশটা সরিয়ে দিয়ে নিজের কোলের ওপর রাণীর মাথাটা তুলে নিয়ে সারা বিছানায় বকুল ফুল ছড়িয়ে দিল তারাপদ! (এই গল্পটি নিয়ে যদি কারুর টেলিফিল্ম বানাবার ইচ্ছে হয় তাহলে এই ই-মেলে যোগাযোগ করতে হবে :

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.