আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সামহোয়ারনামা ৪ এর বদলে সিঙ্গারের গল্প "আয়না"

http://joyodrath.blogspot.com/

১. এক কিসিমের জাল আছে যেইটা মিথুসেলার মত আগিলা, মাকড়সার জালের মতন নরম ও ছ্যাঁদা-ছ্যাঁদা -- কিন্তু শক্তিসামর্থে কমতি নাই। কোনো শয়তান যখন অতীতকালের পিছে বা বাতাসকলের চক্করে ঘুরতে ঘুরতে হয়রান হৈয়া পড়ে, তখন সে কোনো আয়নার ভিতর প্রবিষ্ট হৈয়া যায়। সেইখানে জাল বিছায়া সে মাকড়সার মতই বৈসা থাকে, মাছি ধরা পড়বেই। খোদা দুনিয়ার রমণীকূলে দিছেন অন্তঃসারশূন্যতা -- বিশেষত যেসব রমণী ধনী, সুন্দরী, বাচ্চাকাচ্চাহীন, যুবতী এবং যাদের খরচ করার মত সময় বিস্তর আছে, অথচ সঙ্গীসাথী নাই। ক্রাশনিক গ্রামে আমি সেইরকম এক রমণীর সাক্ষাৎ পাই।

ওর পিতা ছিল কাঠব্যবসায়ী, স্বামী ডানজিগে খেয়ার কাজ করত। আর ওর মায়ের কবরে কেবল ঘাস গজাইতে শুরু করছে। মেয়েটা থাকত পুরনো ধাঁচের একটা বাড়িতে -- ওককাঠের কাপবোর্ড, চামড়া-বাঁধান ক্যাশবাক্স আর সিল্ক দিয়ে মোড়ান নানান বইপত্রের মধ্যে। ওর চাকর ছিল দুইটা -- এর মধ্যে বুড়াটা কানে শুনত কম আর জোয়ানটা ঘুরত এক বেহালাবাদকের পিছে-পিছে । ক্রাশনিকের অন্য গৃহবধুরা জুতা পরত পুরুষের, মেশিনের চোঙ্গার মধ্যে গম ঢালত সপাসপ, পাখপালক ছাড়াইত হাঁসমুরগির, রান্ধত স্যুপ, পালত বাচ্চাকাচ্চা আর যাইত জানাজায়।

বলা বাহুল্য, সুন্দরী এবং শিক্ষিতা জিরেল -- যে বড় হৈছে ক্র্যাকো শহরে -- এইসব গ্রাম্য প্রতিবেশীর সাথে কথা বলার মত বিষয়ই পাইত না। তারচে সে পছন্দ করত জার্মান গানের বই, বৈসা-বৈসা কাপড়ের মধ্যে এমব্রয়ডারি করত মুসা ও জিপোরা, আহসুইরাস ও রাণী এসথার, কিংবা দাউদ ও বাথশেবার ছবি। স্বামী ওর জন্য যেসব সুন্দর সুন্দর পোশাক আনত, সেগুলো ক্লজেটেই ঝুলত, মুক্তা ও হীরার অলংকার বাক্সবন্দী হৈয়াই থাকত। কেউ কোনোদিন ওর সিল্কের অন্তর্বাস, লেস-লাগানো পেটিকোট বা লাল পরচুলা দেখে নাই -- এমন কি ওর স্বামীও না। দেখবেই বা কখন? দিনের বেলায় তো প্রশ্নই ওঠে না, আর রাত্রে তো অন্ধকার।

জিরেলের ছিল একটা চিলেকোঠা, সেইখানে ছিল একখান আয়না যেটা ছিল ততটুকুই নীল -- পানি বরফ হৈবার আগে যতটুকু নীল হৈয়া ওঠে। আয়নার মাঝবরাবর ফাটা ছিল একটা, আর তার চারপাশে যে সোনালি ফ্রেম ছিল তাতে সাপ, দরজার নব, গোলাপ এসবের বাহারি নকশাখোদাই ছিল। আয়নার সামনের মেঝেতে বিছানো ছিল ভালুকের চামড়া আর লাগোয়া পিছনেই ছিল একখান চেয়ার যার হাতল আইভরির আর গদী নরম মখমলের। নগ্নাবস্থায় সেই চেয়ারে বৈসা ভালুকের চামড়ায় পা রাইখা নিজেরে নিবিষ্টভাবে দেখার চাইতে আনন্দের আর কী হৈতে পারে? জিরেলের শরীরে তাকায়া থাকার মত ঐশ্বর্যও ছিল যথেষ্ট। ওর চামড়া ছিল সাটিনের মত শাদা, দুধজোড়া ছিল ফোলা ফোলা, চুল ছিল কাঁধ-ছাড়ানো আর পা দুইটা ছিল মাদী হরিণের পায়ের মত চিকন লম্বা।

আয়নার সামনে বৈসা ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নিজের রূপ উপভোগ করতে পারত। ছিটকিনি আর ভারি হুড়কো দিয়া আটকানো থাকত দরজা, আর সে ভাবত এই বুঝি খুইলা যাইতেছে দরজা, ঘরে ঢুকতেছে কোনো রাজকুমার, শিকারী বা কোনো কবি। কারণ যা কিছু গোপন তার প্রকাশ্য হওয়া লাগবে, প্রতিটা গহীন ভাবনার ব্যক্ত হওয়া দরকার, প্রতিটা প্রেমেই আছে প্রতারণার আকাক্সক্ষা, যা কিছু পবিত্র তারই মর্যাদাহানি হওয়া প্রয়োজন। দুনিয়া ও পরকালের চক্করে যেকোনো সুন্দর শুরুর-ই খারাপ ধরনের সমাপ্তি হৈয়া যাইতে পারে। যখনি আমি এই স্বাদের কথা জানলাম, ঠিক করলাম এই রমণীটারেই ফুসলাইতে হবে।

দরকার খালি একটু ধৈর্য। এক গরমের দিনে, আয়নার সামনে বৈসা সে ওর বাম স্তনের বোঁটা দেখতেছিল, তখনি আয়নার ওপর ওর চোখ আটকায়া গেল। হ্যাঁ, আমিই ছিলাম সেইখানে -- আলকাৎরার মত কাল, বেলচার মত লম্বা, গাধার মত কান, ভেড়ার মত শিং, ব্যাঙের মত মুখ আর ছাগলের মত দাড়ি। আমার চোখ বলতে খালি দুইটা মনি। এত আশ্চর্য হৈছিল যে, ভয় পাওয়ার কথাই ভুলে গেল।

কান্নার বদলে সে ভাইঙ্গা পড়ল বাঁধভাঙা হাসির চ্ছটায়। “ও আল্লা, কী বিশ্রী দেখতে তুমি!” বলল সে। “ও আল্লা, কী সুন্দর দেখতে তুমি!” জবাব দিলাম আমি। আমার প্রশংসায় ওকে খুশি মনে হৈল। “কে তুমি গো?” জিগাইল সে।

“ভয় পাইও না” বললাম, “আমি একটা পিচ্চি শয়তান, বড়সড় শক্তিশালী শয়তান আমি না। আমার আঙুলে নোউখ নাই, মুখে দাঁত নাই, আমার হাত গুড়ের মত, আর শিং মোমের মত। আমার যত শক্তি আমার জবানে। পেশাগত দিক থিকা আমি একটা ভোদাই, আসছি তোমারে আনন্দ দিতে কারণ তুমি একলা। ” “আগে ছিলা কৈ?” “তোমার শোবার ঘরের স্টোভের পিছনে, যেইখানে ঝিঁঝি ডাক পাড়ে আর ইন্দুরে হল্লা করে।

সেইখানে একটা শুকায়া যাওয়া ফুলতোড়া আর উইলোর মরা ডালের মাঝখানে ছিলাম গো। ” “কী করতা সেখানে তুমি?” “দেখতাম তোমারে। ” “কবে থিকা?” “তোমার বাসর রাইত থিকা। ” “খাওয়া দাওয়া?” “তোমার শরীরের সুবাস, চুলের জ্বিলা, চোখের আলো আর মুখের বিষাদ। ” “শালা তেলবাজ” সে চিৎকার করল, “কে তুমি? কী কর এখানে? কৈ ত্থিকা আসছ? যাইবা কৈ?” গল্প বানাইলাম একটা।

বললাম, আমার বাপ ছিল স্বর্ণকার আর মা ছিল একটা মাদী ছাগল। তারা মিলিত হৈছিল এক গুদামের ভিতর বাতিল দড়ির স্তূপের ওপর, আমি ছিলাম তাদের জারজ সন্তান। কিছুদিনের জন্য উঠছিলাম মাউন্ট সিয়েরের শয়তানদের বস্তিতে, থাকতাম একটা খচ্চরের গুহায়। কিন্তু যখন জানাজানি হৈল যে, আমার বাপ একজন মানুষ -- খেদায়া দিল আমারে। তখন থিকা আমি ঘরছাড়া।

মাদী শয়তানগুলা আমারে এড়াইত কারণ, আমারে দেখলে নাকি ওদের আদমসন্তানের কথা মনে হৈত। আর মানবীরা আমারে দেইখ্যা ভাবত শয়তানের কথা। আমারে দেখলেই ঘেউ ঘেউ করত কুত্তাগুলান, মানুষের বাচ্চারা চেঁচাইত ভয়ে । কিন্তু কেন ভয় পাইত ওরা? আমি তো কারো ক্ষতি করি নাই। আমার একমাত্র শখ সুন্দরী নারী দেখা -- দেখা আর ওদের সাথে আলাপ সালাপ করা।

“আলাপ সালাপ করা ক্যান? সুন্দরী হৈলেই কি জ্ঞানী হৈয়া যায় নাকি?” “বেহেশতে জ্ঞানীরা সুন্দরীদের পায়ের নিচের পাওদানি। ” “আমার শিক্ষক তো অন্যকথা কয়। ” “তোমার শিক্ষক হালায় কি জানে? যারা বই লেখে তাদের বুদ্ধি ছারপোকার সমান। তারা একজন অন্যজনরে অনুকরণ করে। যখনি তুমি কিছু জানতে চাও, আমারে জিগাইও।

জ্ঞান কখনই পয়লা বেহেশতের নিচে নামে নাই। আর পয়লা বেহেশতের পর জ্ঞান বৈলা যা আছে তার সবই হৈল লালসা। তুমি কি এও জান না যে, ফেরেশতারা সব মাথামোটা? গেরাসিম ফেরেশতা বালুর মধ্যে খেলাধুলা করে পোলাপানের মত, চেরুবিমটা তো গোনাগুনতিই পারে না, আর আরালিমটা ফেলনা জিনিস চিবায় খালি। খোদা নিজে সময় কাটান হাঙ্গরের লেজ টাইন্যা টাইন্যা, আর জংলী ষাঁড়ে তার পা চাটে। তিনি কাতুকুতু দেন শেখিনারে যাতে সে প্রতিদিন অনেক অনেক ডিম পাড়তে পারে; এই ডিমগুলারেই তোমরা আকাশের তারা কও।

” “বুঝলাম তুমি আমার সাথে মশকরা করতেছ। ” “এইগুলা মশকরা হৈলে আমার নাকের ওপরে হাড্ডি গজাক। আমার মিছাকথার কোটা আমি অনেক আগেই শেষ কৈরা ফালাইছি। এখন সত্য বলা ছাড়া আমার বিকল্প নাই। ” “আচ্ছা, তুমি কি বাচ্চা পয়দা করতে পার?” “না গো আমার জান।

খচ্চরের মতই অক্ষম আমি। কিন্তু তাতে আমার কামনা দমে নাই। শুধুমাত্র বিবাহিতাদের সাথে শুই আমি, দুর্দান্ত অ্যাকশনই আমার পাপ, আমার প্রার্থনা হৈল খোদা-কুৎসা, বিদ্বেষ আমার রুটি, ক্রোধ আমার মদ, ফুটানি আমার হাড্ডিমজ্জায়। বকবকানি ছাড়া এই একটা জিনিসেই ওস্তাদ আমি। ” আমার কথায় হাসি পাইল ওর।

বলল, “শয়তানের বেশ্যা হৈতে জন্ম দেয় নাই আমারে আমার মা। যাঃ ফুট, নাইলে ওঝা ডাকুম কিন্তু। ” “উত্তেজিত হৈবার কিছু নাই”, বললাম আমি, “যাইতেছি। কারো ওপর জোর করি না আমি”। তারপর মিলায়া গেলাম কুয়াশার মত।

২. পরের সাতদিন জিরেল ওর আয়নাঘরে যাওয়া থিকা বিরত রাখল নিজেরে। আয়নার ভিতর আমি হালকা হালকা ঘুমাইলাম। জাল ছড়ান হৈছে; ভিকটিম রেডি। ওর মারাত্মক কৌতুহলের কথা জানতাম আমি। তাই এখন আমার কাজ হৈল খালি হাই তোলা।

একজন খোদার বান্দারে এইরকম পটান কি উচিত আমার? উচিত কি নববধুরে তার পুরুষের সঙ্গ থিকা বঞ্চিত করা? সিনাগগের চিমনিতে আগুন দেয়া? সাবাথের মদকে ভিনেগার বানায়া দেয়া? কুমারীর জন্য বামনসোয়ামী উপহার দেয়া? বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ভেড়ার শিং ঢুকায়া দেয়া? তেলাওয়াতের সুরের মধ্যে অসুর ঢুকায়া দেয়া? পিচ্চি শয়তানের এরকম কাজকামের অভাব তো নাই, বিশেষত আতংকদিবসগুলাতে, যখন পানির মধ্যে মাছগুলাও ভয়ে কাঁপতে থাকে। এমনি এক দিন আমি বৈসা বৈসা মুন জুস আর টার্কি সীডস-এর খোয়াব দেখতেছিলাম -- তখনি ঢুকল সে। তাকাইল আমার দিকে, কিন্তু দেখতে পাইল না। আয়নার সামনেই বসল, আমি দেখা দিলাম না। “নিশ্চয় আমি আগডুম বাগডুম ভাবতেছি”, ফিসফিস করতেছিল জিরেল, “ঐটা অবশ্যই গাঁজাখুরি স্বপ্ন ছিল আমার।

” নাইটগাউন খুইল্যা উদাম হৈয়া দাঁড়াইল সে ঐখানে। জানতাম ওর স্বামী শহরে গেছে এবং গতরাত্রে স্ত্রীর সঙ্গে শুইছে, যদিও জিরেল এখনও গোসল কৈরা পুতপবিত্র হয় নাই। অথচ তালমুদ শরীফে আছে, কোনো স্ত্রীলোকের পবিত্র হৈতে দশখান শর্ত পূরণ করা লাগে, আর বেলেল্লা হৈতে যে কোন একটা শর্তের অপমানই যথেষ্ট। রয়েজি গ্লাইনের কন্যা জিরেল আসলে আমাকেই খুঁজতেছিল এবং ওকে বিষণ্ণ লাগতেছিল খুব। সে আমার, আমার, আমি ভাবলাম।

আজরাইল তার বল্লমসহ তৈরি, হিংসুটে এক পিচ্চি শয়তান দোযখের মধ্যে মেয়েটার জন্য কড়াই বসাইতেছে, আরেক পাপী হতভাগির জন্য খড়িকাঠ টুকাইতেছে। সব তৈয়ার -- বরফের চাঁই আর জীবন্ত কয়লা, ওর জিহ্বার জন্য আংটা, স্তনের জন্য প্লায়ার্স, ওর যকৃত খাওয়ার জন্য ইঁদুরের পাল, আর পাকস্থলিতে কামড় বসানোর জন্য কৃমি। কিন্তু আমার ছোট্ট শিকার এসবের কিছুই টের পাইল না। সে নিজের বাম স্তনে হাত বুলায়া নিল, তারপর ডান স্তনে। তলপেট দেখল, তারপর পায়ের পাতা।

সে কি এখন বই পড়বে? নখে পালিশ লাগাবে? চুল আঁচড়াবে? স্বামীর আনা আতরের গন্ধ বাইর হচ্ছে ওর গা থিকা, ভুর ভুর গোলাপগন্ধ। স্বামী ওকে প্রবালের যে নেকলেসটা উপহার দিছিল, সেইটাই পরে আছে সে। কিন্তু সর্প না থাকলে হাওয়াবিবি কেমনে হয়? শয়তান না থাকলে খোদার মাহাত্ম্য কি? জিরেল ছিল কামনায় একেবারে কানায় কানায় পূর্ণ। বেশ্যার মত আতিপাতি কৈরা খুঁজতেছিল আমারে। কাঁপা-কাঁপা ঠোঁটে আবৃত্তি করল: হাওয়ার মতন বেগে গহীন পাতাল থেকে কালো বিড়াল তুমি নাগালে আসো, চুমি! সিংহ বিক্রমে মাছের বোবা প্রেমে স্তব্ধ দেশের দেশী নাও, তোমার ফুলরাশি! শেষ শব্দটা আউড়ানমাত্র দেখা দিলাম আমি।

আমারে দেখামাত্র ওর মুখ উজ্জ্বল হৈয়া উঠল। “ও। তুমি এখানে?” “চলে গেছিলাম”, বললাম, “কিন্তু ফিরা আসলাম। ” “কৈ ছিলা এই কয়দিন?” “ছিলাম, যেখানে কোনো স্থান নাই সেইখানে। ছিলাম আসমোদিউসের দুর্গের কাছে, যে জঙ্গলটায় সোনার পাখি থাকে তার কাছে একটা বেশ্যাদের প্রাসাদ আছে সেইখানে।

” “এত দূরে?” “আমার কথা একিন না হৈলে আসো আমার সাথে। পিঠে চাইপ্যা বস, শিং চাইপ্যা ধর, তোমারে লৈয়া পতপত ডানা ছড়াই আকাশে। দুইজনায় পাহাড়পর্বত ডিঙায়া উইড়া যামু সেইখানে। ” “কিন্তু আমার পরনে তো কিছুই নাই। ” “সেইখানে কেউ কাপড় পরে না।

” “আমার স্বামী জানবে না কোথায় গেছি আমি?” “যা জানার তাড়াতাড়িই জানবে সে। ” “লাগবে কতক্ষণ যাইতে?” “সেকেন্ডেরও কম। ” “ফিরব কখন?” “সেইখানে গেলে কেউই ফিরতে চায় না। ” “কি করব আমি সেইখানে?” “আসমোদিউসের কোলে বৈসা উনার দাড়ি দিয়া বেনী বানাইবা। আলমন্ড আর পোর্টার খাইবা।

সন্ধ্যা হৈলে উনার সামনে নাচবা। তোমার গোড়ালিতে ঘণ্টি বাঁধা থাকবে, আর সব শয়তান নাচবে তোমারে ঘিরা। ” “তারপর?” “আমার প্রভু খুশি হৈলে তুমি তারই হৈবা। আর না হৈলে উনার সাঙ্গপাঙ্গদের কেউ তোমার দায়িত্ব নিবে। ” “সকাল হৈলে?” “সেইখানে সকাল নাই।

” “তুমি কি থাকবা আমার সঙ্গে?” “তোমাকে নিতে পারলে আমার পুরস্কার জুটবে চূষার জন্য একখান হাড্ডি। ” “হায় রে অভাগা শয়তান, মায়া লাগতেছে তোর জন্য, কিন্তু আমি যাব না। আমার সোয়ামি আছে, পিতা আছে। সোনারূপা আছে, পোশাক আছে, ওল আছে। আমার জুতার হিল ক্রাশনিকে সবচে উঁচা।

” “ঠিক আছে। তাইলে বিদায়। ” “দাঁড়াও দাঁড়াও। এত তাড়াহুড়া ক্যান গো? কী করা লাগবে কও। ” “এইত লক্ষ্মী মেয়ের মত কথা।

মন দিয়া শোন, সবচে শাদা যে ময়দা তার কাঁই বানাও প্রথম। তাতে মিশাও মধু, ঋতুস্রাব, নষ্ট ডিম, শুয়োরের চর্বি, ষাঁড়ের অন্ডকোষের চর্বি এক চামচ, এক কাপ মদ। সাবাথের দিন কয়লার আগুনে এইটা সিদ্ধ কর। তারপর স্বামীরে লৈয়া বিছানায় যাও এবং এইটা খাইতে দাও। মিছা কথা বৈলা বৈলা জাগায়া রাখ তারে, তারপর খোদা-না-খাস্তা কথা বৈলা ঘুম পাড়াও।

যখন সে নাক ডাকতে শুরু করবে, তার অর্ধেক দাড়ি আর একটা কানের লতি কাইট্যা লও। লও যা সোনাদানা আছে, দেনমোহরের কাগজটা পুড়ায়া দাও, আর কাবিননামা ছিঁড়া ফালাও। সোনাদানা ফালায়া দাও কসাইটুলির জানলার নিচে, বাড়ি ছাড়ার আগে প্রার্থনার বই ডাস্টবিনে ফালায়া দাও, মেথুরা শরীফে থুথু ছিটাও, বিশেষত যেখানে যেখানে ‘শাদাই’ লেখা আছে সেই স্থানগুলায়। তারপর সোজা আস আমার কাছে। আমি তোমারে পিঠে নিয়া উড়ব ক্র্যাশনিক থিকা মরুভূমিতে।

আমরা উড়ব ব্যাঙের বিষ্ঠাভরা মাঠের ওপর দিয়া, নেকড়েভরা জংলার ওপর দিয়া, সমকামীদের আখড়া ডিঙায়া -- যেখানে সাপ হৈল পন্ডিত, হায়েনা হৈল শিল্পী, কাক হৈল মৌলভী, চোরে দেখাশুনা করে খয়রাতির টাকা। সেইখানে সকল অসুন্দর হৈল সুন্দর, বাঁকা হৈল সোজা, নির্যাতন হৈল আরামদায়ক, ব্যঙ্গ হৈল অতি উচ্চ প্রশংসা। তাড়াতাড়ি কর, সময় খুব কম। ” “ভয় লাগতেছে পিচ্চি শয়তান, আমার খুউব ভয় লাগতেছে। ” “আমাদের সাথে গেলে প্রথম প্রথম সবারই লাগে।

” আরো কিছু জিগাইবার ইচ্ছা ছিল জিরেলের, হয়ত আমার বক্তব্যের স্ববিরোধ ধরার জন্য, কিন্তু পালাইলাম আমি। সে ওর ঠোঁট চাইপ্যা ধরল আয়নার মধ্যে, কিন্তু আমার লেজের একটুখানি নাগাল পাইল খালি। ৩. ওর বাবা কাঁদল। স্বামী মাথার চুল ছিঁড়ল। চাকরবাকরেরা ওরে খুঁজল সেলারে আর বাড়ি-লাগোয়া উঠানে।

ওর শাশুড়ি বেলচা দিয়া চিমনীর ভিতরটা পর্যন্ত খুচায়া দেখল। গরুর গাড়ির গাড়িয়াল আর কসাইরা ওরে তন্ন তন্ন কৈরা খুঁজল জঙ্গলে। রাতে টর্চ জ্বলল এখানে ওখানে আর তালাশকারীদের গলা ইকো হয়: “জিরেল, কোথায় তুমি? জিরেল! জিরেল!” সন্দেহ হৈল যে, সে কনভেন্টে পালায়া গিয়া থাকতে পারে। কিন্তু প্রিস্ট মশায় ক্রুশ ধৈরা কসম কাটল, জিরেলরে সে দেখে নাই। খোঁজাখুঁজির জন্য পাঠানো হৈল এক হাতসাফাইকারীকে, তারপর পাঠানো হৈল এক জাদুকর মহিলাকে যে কারো আদলে অবিকল মোমের মূর্তি বানাইতে পারে, শেষে পাঠানো হৈল আরেকজনকে যে জাদুর আয়না দিয়া মৃত বা নিখোঁজ মানুষের সন্ধান করতে পারে।

কিন্তু যখন আমি আমার শিকার হাতে পাইয়া যাই, তখন দুনিয়ার কারো সাধ্য থাকে না তাকে ফিরায়া নিবার। ডানা ছড়াইলাম ওকে পিঠে নিয়া। জিরেল আমারে অনেক প্রশ্ন করল, কিন্তু জবাব দিলাম না। সোডম-এ পৌঁছার পর লট শালার বৌ-এর কাছে থামলাম একপলক। তিনটা বলদে তখন ঐ বেটির নাক চুষতে ছিল।

লট শালা শুইছিল গুহায় ওর মাইয়াগুলার সাথে, বরাবরের মতই মাতাল। ছায়ার এই জগতে সবকিছুই পরিবর্তনশীল, কিন্তু আমাদের জগতে সময় একেবারে স্থির। এইখানে বাবা আদম এখনও ল্যাংটা, হাওয়াকে এখনও সাপে ফুসলাইতেছে। হাবিল মারতেছে কাবিলকে, রক্তচোষা নীলমাছি শুইতেছে হাতির সাথে, বেহেশত থিকা নামতেছে ঝর্ণাধারা, মিশর দেশে হাতে কাদা ঠেলতেছে ইহুদীরা, শরীর চুলকাইতেছে জব। যতক্ষণ সময় প্রবাহিত হয়, চুলকাইতেই থাকবে সে, কিন্তু আরাম পাইবে না সে কোনোদিন।

জিরেল কী যেন কথা কৈতে চাইছিল, কিন্তু পাখা ঝাপটায়া আমি লাপাত্তা হৈয়া গেলাম। আমার কাজ শেষ। গিয়া প্রাসাদের অনেক উঁচু কার্ণিশে বাদুড়ের মত ঝুলতে থাকলাম, চোখ খোলা কিন্তু দৃষ্টি নাই চোখে। দুনিয়া হৈল বাদামি আর বেহেশত হৈল হলুদ। বৃত্তাকারে দাঁড়ায়া শয়তানগুলা লেজ নাচাইতেছিল।

দুইটা কাছিম ছিল টাইট জড়াজড়ি অবস্থায়, একটা পুরুষ পাথর উপগত একটা নারীপাথরের ওপর। শাব্রিরি আর বারিরি উপস্থিত হৈল। শাব্রিরির জন্ম হৈছে একটা বর্গক্ষেত্রের আকার থিকা। তার মাথায় টুপি, হাতে বাঁকা তলোয়ার। তার পা-গুলা হাঁসের, কিন্তু ছাগলের মত দাড়ি আছে মুখে।

নাকের ওপরে জোড়া চশমা আছে তার, কথা বলে জর্মন উচ্চারণে। আর বারিরি একইসঙ্গে বানর, টিয়া, ইঁদুর এবং বাদুড়। শাব্রিরি আর বারিরি মাথা নোয়াইল একটু, তারপর শুরু করল বিদূষক স্টাইলে: আর্গিন মার্গিন সস্তায় বেছে নিন কিউট এক দোয়েল নাম তার জিরেল (তার) খোলা দরজা (তাই) প্রেমে খুব মজা! শাব্রিরি যখন জিরেলকে বাহু বাঁধনে ধরতে গেল, চেঁচাইল বারিরি, “ ওরে তোর শরীরে হাত দিতে দিবি না মাগি! মাথায় খুঁজলি-প্যাঁচড়া আছে ওর, পায়ের মধ্যে ঘা, মেয়েমানুষরে মজা দিবার ক্ষমতা নাই ওর। মুখে ফটফট, খাসি করা মোরগও ওর থেইকা ভাল। এরকম ওর বাপেও ছিল, দাদাও।

তার চাইতে আয়, প্রেম করবি আমার সাথে, আমি মিথ্যারাজের নাতি। তাছাড়া আমার মেলা টাকাপয়সা আছে, ফ্যামিলিও ভাল। আমার দাদী ছিল নামা-র কন্যা ম্যাকলাথের সখী। আসমোদিউসের পা ধোয়াইয়া দিত আমার মা। আমার বাবা, চির দোযখনসীব হোক তার, বইত শয়তানের নস্যির বাক্স।

” এইভাবে শাব্রিরি আর বারিরি জিরেলের চুল ধৈরা টানাটানি করতে আরম্ভ করল, প্রতিবার টানের সাথে তারা জিরেলের গোছা গোছা চুল উপড়ায়া ফেলতে লাগল। তখনি জিরেল তার অবস্থাটা পুরাপুরি বুঝল এবং ‘ছাইড়া দেও ছাইড়া দেও’ বলে চিৎকার করতে লাগল। “কী নিয়া লোফালুফি চলতেছে?” কেটেভ মারিরি জিগায়। “ক্রাশনিকের একটা ছিনাল। ” “ভাল কিছু পাওয়া গেল না?” “নাহ।

ঐটাই ঐখানে ভাল। ” “আনল কে?” “একটা পিচ্চি শয়তান। ” “ঠিক আছে। আবার শুরু কর। ” “বাঁচাও বাঁচাও।

” জিরেল গোঙ্গাইতে থাকল। “ঝুলায়া দাও ঐটারে”, ক্রোধের পুত্র র‌্যাথ চেঁচাইল, “কাইন্দা কোনো লাভ নাই মাগী। এইখানে সময় লড়েচড়ে না। যা বলা হৈছে কর, তুই এখানে জোয়ানও না, বুড়িও না। ” জিরেল কান্নায় ভাইঙ্গা পড়ল।

ওর হিক্কা আর বিলাপের শব্দে লিলিথের ঘুম চটকায়া গেল। আসমোদিউসের দাড়ির ভিতর থিকা মুখ বাইর করল সে, ওর মাথার প্রতিটা চুল হৈতেছে একেকটা কিলবিল-করা সাপ। “মাগিটার সমস্যা কি?” জিগাইল লিলিথ, “চেঁচাইতেছে ক্যান?” “ওরা শুরু করছে ওর ওপর। ” “আরো একটু লবণ মিশায়া নিতে ক” “আর আগে চর্বি ছাড়ায়া নিতে ক” এই মশকরা চলল হাজার হাজার বছর ধৈরা, তারপরেও প্রেতচক্রের ক্লান্তি নাই। প্রতিটা শয়তান তার তার করণীয় সারল, প্রতিটা পিচ্চি শয়তান তার তার মত মজা নিল।

ওরা টানল, ছিঁড়ল, কামড়াইল আর চিমটাইল। পুরুষ শয়তানগুলা এত খারাপ না, মাদী শয়তানগুলা হৈতেছে ভয়ানক Ñ আদেশ দিল: খালি হাতে স্যুপ বানাবি! আঙুল ছাড়া বিনুনী করবি! পানি ছাড়া ধোয়ামোছা করবি! গরম বালুর মধ্যে মাছ ধরবি! না ভিজ্যা গোসল করবি! বাড়িতে থাকবি এবং রাস্তায় হাঁটবি! পাথর দিয়া মাখন তৈয়ার করবি! বোতল ভাঙ্গবি কিন্তু মদ ফেলতে পারবি না!! খোদা বৈলা কি কেউ আছেন? তিনি কি আসলেই দয়াশীল? জিরেল কি কোনোদিন মুক্তি পাবে? সৃষ্টির গোড়াতেই কি সাপের সাথে অশুভের যোগ ছিল? আমি কেমনে বলি? আমি তো ছোট্ট একটা শয়তানমাত্র। পিচ্চি শয়তানদের পদোন্নতি হয় না খুব একটা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম আসে যায়, এক জিরেলের পর আরেক জিরেল, অযুত অযুত প্রতিচ্ছবির উস্কানি, অযুত অযুত আয়নার ভিতর।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।