আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মেয়ে শেকড় (১)



কলকাতা থেকে পুলিশ এসেছে শুনে বৃন্দাবনের দুপুরের ঘুম মুহূর্তেই ছুটে গেল। ছাপোষা প্রাইমারি স্কুলের টিচার বৃন্দবন চক্রবর্তী কারও সাতেপাঁচে থাকে না। স্থানীয় সব রাজনৈতিক দলের লোকজনই তাকে অত্যন্ত নির্বিরোধ এবং নিজের নিজের দলের লোকই মনে করে। কাজেই রাজনৈতিক শত্রুতাও তার সঙ্গে কারো নেই। পৈতৃক কিছু জমিজমা দেখাশোনা এবং নিয়মিত স্কুল করা--এর মধ্যেই তার দিনরাত্রি কখন শেষ হয়ে যায় সে নিজেই টের পায় না।

এহেন লোকের বাড়িতে কলকাতার পুলিশ কেন আসবে? শঙ্করী তার পেছনে দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বসার ঘরের বাইরের দরজার এপারেই দাঁড়িয়ে গেল। বৃন্দাবন পাঞ্জাবির বোতামঘর হাতড়াতে হাতড়াতে বসার ঘরে ঢুকেই কাঠ হয়ে গেল। বাইরের দিকের দরজা থেকে রাস্তা পর্যন্ত লোকে লোকারণ্য! দুজন লম্বাচওড়া কলকাতা পুলিশের সঙ্গে স্থানীয় থানার ওসি ভুবনেশ শিকদারকে দেখে বৃন্দাবন বুঝলো শিকদারই এদের এখানে নিয়ে এসেছে। ওদের ঠিক পেছনেই চুড়িদার পরিহিতা একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। মুখটা অবশ্য স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না।

--আপনিই তো বৃন্দাবন চক্রবর্তী? প্রশ্নটা করলো রগচটা ভুবনেশ শিকদারই। --আজ্ঞে হ্যাঁ সার! কিন্তু-- --বছর ছয়েক আগে আপনার মেয়েই তো হারিয়ে গিয়েছিল হাওড়া ইস্টিশন থেকে? মনে পড়ছে না? থানায় ডায়রি করেছিলেন--রেডিও-টিভিতে ঘোষণা--কাগজে বিজ্ঞাপন? --ঐ মেয়ে--মানে ও কি-- গলার স্বর অতলান্তে ডুবে গেল বৃন্দবনের। --হ্যাঁ, এই আপনার মেয়ে নন্দিনী। দেখুন চিনতে পারেন কিনা? বলে পাশে সরে গিয়ে নন্দিনীর হাত ধরে সামনে টেনে আনল কলকাতা পুলিশ। ওদিকে ভেতরের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিল না শঙ্করীর পক্ষেও।

আচমকাই দুহাত বাড়িয়ে একটা অদ্ভুত তীক্ষ্ণ চিৎকার করে নন্দিনীর দিকে ছুটে যাচ্ছিল সে। চমকে উঠে বৃন্দাবন শঙ্করীর একটা হাত টেনে ধরে থামিয়ে দিল। নন্দিনীর চোখে মুখে কোনো ভাবাবেগের চিহ্ন ছিল না। তার স্থির দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল নাযা দেখে তার মনের ভেতরের অবস্থাটার কিছু আঁচ পাওয়া যায়। --কিন্তু দারোগাবাবু, আমি বলছিলাম-- --এতদিন ও কোথায় ছিল, তাই তো? প্রায় হুঙ্কার দিয়ে উঠলো শিকদার।

--আমি বলছি শিকদারবাবু। এগিয়ে এলন কলকাতা পুলিশের একজন। বৃন্দাবনের সামনে এস বললেন-- --আপনার মেয়ে কলকাতার এক কুখ্যাত নিষিদ্ধপল্লীতে ছিল। একটা গুরুতর বিষয়ে তদন্তের প্রয়োজনে আমরা সে বাড়িটা রেইড করি। ও সেই বাড়িতেই অন্যান্য সকলের সঙ্গে ধরা পড়ে।

তারপর নানা জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারি বছর ছয়েক আগে ওকে কেউ ওখানে বিক্রি করে দিয়ে গিয়েছিল। তখন ওর বয়েস তের বছর ছিল বলেই আপনি পুলিশের কাছে জানিয়ে ছিলেন। অর্থাৎ আপনার মেয়ে নাবালিকা অবস্থা থেকেই ওই পাড়ায়--এনিওয়ে এগুলোয় সই করে দিন-- --কি এগুলো? বৃন্দাবনের গলা প্রায় শোনাই গেল না। --আপনার হারানো নাবালিকা মেয়ে আপনি ফিরে পেলেন। আমরা আপনার মেয়েকে আপনার হাতে তুলে দিলাম।

আপনার সই তারই প্রমাণ হয়ে থাকবে। --কিন্তু আমি...মানে আমার সংসার...প্রতিবেশী আত্মীয়-স্বজন... বলতে বলতে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল বৃন্দবন। --ওসব আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমাদের দয়া করে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিন। নিন সই করুন প্লিজ! --ওকে আমি কোথায় রাখবো? দিশেহারা বৃন্দাবন যেন নিজের কাছেই জানতে চাইলো।

--বাড়িতে রাখবেন। পড়াশোনা করাবেন। দিন অনেক পাল্টে গেছে মশাই! ও তো নিজের ইচ্ছেয় কুপথে যায়নি। ওর দোষ কোথায়? নরক থেকে উদ্ধার করে এনে দিলাম--ওকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শেখান। মানুষ অনেক প্রগতিশীল হয়েছে।

সবাই ব্যাপারটা বুঝবে। নো প্রবলেম! কলকাতা পুলিশের কথাগুলো পঞ্চবটির ঋষির মতো শোনালো বৃন্দাবনের কানে। ভেতরে ভেতরে একটা যুক্তি তর্কের লড়াইও শুরু হচ্ছে ধীরে ধীরে। সত্যিই তো ওর কি দোষ! হতভাগী কি তাহলে আত্মহত্যা করবে? শিউড়ে উঠলো বৃন্দাবন। কিন্তু জানলার ওপারের চাকবাঁধা মানুষের চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে জমে যাচ্ছিল বৃন্দাবন।

বাস্তবের অন্যদিকটার কথা ভাবতে গেলে এই মুহূর্তে বৃন্দাবনের মস্তিষ্কে পক্ষাঘাতের অসাড়তা ছাড়া অন্য কোনো অনুভূতি নেই। --কই, সই করুন! এগিয়ে এল ভুবনেশ শিকদার। ফ্যাল ফ্যাল করে কাগজগুলোর দিকে কয়েকমুহূর্ত চেয়ে থাকার পর ঘাড় ঘুরিয়ে ভেতরের দরজার ফ্রেমে প্রস্তরীভূত শঙ্করীর দিকেও একবার তাকালো বৃন্দাবন। ঐ কাগজগুলোয় সই করলেই কি নন্দিনীকে তার ছ'বছর আগের ঘর-জীবন বৃন্দাবন ফিরিয়ে দিতে পারবে? শঙ্করী কি একটুও ভরসা দেবে না জীবনের এই চরম সঙ্কটের মুহূর্তে? শঙ্করী নির্বাক হয়ে আছে কেন? --আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে বৃন্দাবনবাবু--প্লিজ! কাঁপা হাতে শেষ পর্যন্ত বৃন্দাবনকে সই করতেই হলো। কাগজগুলো ফাইলে গুছিয়ে কলকাতা পুলিশের দুজন ভিড় ঠেলে দরজার বাইরে বেরিয়ে গেল।

ভুবন শিকদারও যাচ্ছিল। হঠাৎ দ্রুত বৃন্দাবনের খুব কাছে এগিয়ে এসে নিচু গলায় জানতে চাইল-- --মেয়েকে ফিরে পাওয়ার জন্য পনের হাজার টাকার পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন না? নিশ্চয়ই টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখা আছে? কাল সন্ধ্যায় চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়িতে একবার চলে আসুন। আমরা সবাই তাসপাশা খেলি--জল-টল খাই। অপজিশনের লোকজনও আসে। টাকাটা নিয়ে আসবেন।

এখানকার পাব্লিক টু-শব্দটি করবে না। কোনো ভয় নেই আমরা তো আছি--! বলে দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল ভুবনেশ দারোগা। ঘর ফাঁকা হয়ে গেল। বাইরের চাকবাঁধা ভিড়টাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। রাস্তা থেকেই গুচ্ছে গুচ্ছে সেই ভিড় ছড়িয়ে পড়লো চায়ের দোকানে-মোড়ে-বাসস্ট্যাণ্ডে-বাজারে।

এই ছোট্ট শহরের জনজীবনে এমন অভিনব আলোচ্য বিষয় আর কখনো আসেনি। শূন্য ঘরের একপ্রান্তে নন্দিনী অন্যপ্রান্তে দরজার ফ্রেমে লটকে থাকা শঙ্করী--মাঝখানে নির্বাক বৃন্দাবন। নন্দিনী শূন্যদৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে বাইরের দরজার দিকে। নন্দিনীর দিকে তাকাতেও ভয় পাচ্ছে শঙ্করী। --আমার এখন কিছু একটা করা উচিত।

কি করতে পারি আমি! বাইরের দরজাটা আগে বন্ধ করা দরকার। --মনে মনেই কথাগুলো উচ্চারণ করতে করতে বৃন্দবন দরজা বন্ধ করে দিল। (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.