আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বই মেলার জুলুম

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

বই মেলায় যাওয়া হয় নি একেবারেই এমনটা বলবো না। গত শনি বার ছেলেকে নিয়ে গিয়েছিলাম বই মেলায়। অনেক উৎসাহ নিয়ে যাওয়া এবং আশংকা নিয়ে বইমেলার ভেতরে ঘোরাঘুরি করাটাই নিয়তিনির্ধারিত হয়ে আছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মানুষ বই কিনে পড়ে না, এমন কি পাঠাভ্যাসের দিক থেকে বিবেচনা করলো হয়তো বিশ্বের প্রথম ৫০টি দেশের একটিতেও থাকবে না বাংলাদেশ। বাংলাদেশ পাঠ্যাভ্যাস বিবেচনা করলো হয়তো এখনও সৌদি আরব, কাতার, মোজাম্বিক কিংবা ঘানা এইসব দেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে, কিন্তু একুশে বইমেলায় গেলে এই সত্য বিশ্বাস করা কষ্টকর।

একুশে বইমেলায় মানুষের মাছি থকথকে ভীড় দেখে কেউ বলবে এই ফেব্রুয়ারী মাসকে বিবেচনায় রেখেই প্রকাশকেরা বই ছাপান, লেখকেরা সারা বছর অপেক্ষায় থাকেন বইমেলায় বই প্রকাশের জন্য এবং প্রকাশকদের কথা শুনলে মনে হবে শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারীতেই বাঙালী বই কিনে। কিন্তু বইমেলায় এত মানুষের ভীড়, এত কোলাহল, এবং একটা দোকানের সামনে দাঁড়ানো অধিকাংশ মানুষই বই কিনছে না। বই মেলা ভাঙবার সময় যারা বই মেলা থেকে ফিরে যাচ্ছে তাদের হাতের দিকে তাকালেও এই সত্যটা স্পষ্ট হয়, ৯০ শতাংশ মানুষ শুধুমাত্র একটা মেলায় না গেলে কেমন হয় ভাবনা থেকে মেলায় আসে। এইসব অভ্যাগতদের পা না মারিয়ে বইমেলা থেকে ফিরে আসা সম্ভব না মোটেও। দুলকি চালে হাঁটতে হাঁটতে যখন বাংলা একাডেমী চত্ত্বরে ঢুকবো ছেলেকে নিয়ে, তখনই পুলিশ বাগড়া দিয়ে বললো এদিক দিয়ে না প্রবেশ অন্য পথে।

সুতরাং পুলিশ নির্ধারিত প্রবেশ পথে প্রবেশ করলাম বই মেলায়। শিশু উপযোগী বই কিনবার ইচ্ছা ছিলো, ধারাপাত, শিশুশিক্ষার বাইরে যারা এখনও পড়তে শিখে নি কিংবা সদ্য পড়তে শিখেছে তাদের উপযোগী বই নেই তেমন। তবে আমার ছেলের এসবে সমস্যা নেই, যেকোনো বই, দশ বারোটা ছবি থাকলেই তার চলে। সেও কম্প্যুশিক্ষিত, তার অধিকাংশ ইন্ট্যারাকটিভ বইয়ের ভীড়ে নতুন যেকোনো সংযোজন তাকে আনন্দিত করে। হঠাৎ করেই ছেলের চিৎকার, ওরে বাবা, ওটা আবার কে? তাকিয়ে দেখলাম ভোম্বল দাসের একটা মুর্তি বানানো, সেটা টোনাটুনির স্টল।

সেখানে ভোম্বল দাস দেখে ছেলে উৎফুল্ল। তার টোনাটুনির অনেক কিছু কিনবার আগ্রহ আছে, যাওয়ার পথে কিনে দিবো, সান্তনা দিয়ে বই মেলায় ঢুকে গেলাম। ঘুরছি গোলক ধাঁধায়, টম এন্ড জেরী কিংবা কার্টুন ক্যারেকটারের উপরে নকল বইগুলোর ছাপা খারাপ, এবং আমি যেসবকে পছন্দসই বিবেচনা করি, দেখা গেলো আমার পছন্দের উপরে ছেলের আস্থা খুবই কম। সুতরাং সে যেসব পছন্দ করে সেসব আমার পছন্দ না হলেও পুনরায় সান্তনা দিতে হয়, সামনে থেকে ঘুরে আসি, যাওয়ার পথে কিনবো। শিশু একাডেমী, এখনও বাংলা ছড়ার বই পাওয়া যায় ১৬ টাকায়।

আমার এটা জানা ছিলো না, আমার ছেলে বেলায় শিশু একাডেমীর বইয়ের দাম ছিলো ৩ টাকা, ৪ টাকা, তবে শিশু একাডেমীর বইয়ের মূল প্রাণ আমার কাছে বফিকুন নবী, হাশেম খান আর কাইয়ুমের অলংকরণ। বাংলাদেশের শিল্প সংস্কৃতিতে কিংবা বৈশ্বিক বিবেচনায় তারা কত বড় মাপের শিল্পী আমি জানি না তবে আমার কাছে বাংলাদেশের সেরা আঁকিয়ে তারাই। শিশু একাডেমীর বই কিনলাম, আরও কিনবার ইচ্ছা ছিলো, হয়তো কিনবো শেষের দিকে, তবে একটা কথা বলে রাখি, অধিকাংশ ছড়ার বই যা তা। ছড়া হিসেবে যা লেখা হয়েছে সেগুলো যদি কাইয়ুম ,রফিকুন কিংবা হাশেম খানের ছবি দিয়ে অলংকৃত না হতো তবে নিঃসন্দেহে সেসব খুব উন্নত মানের টয়লেট টিস্যু হতে পারতো। পপ আপ সিরিজের বই এসেছে, প্রকাশকের নাম প্রগতি পাবলিশার্স।

ছয়টা বইয়ের এক সেট, দাম ২৭৫ টাকা, বাংলাদেশের প্রথম প্রয়াস হিসেবে অবশ্যই প্রশংসা করতে হয় এর মানের, পান্তা বুড়ির গল্প, মীনার গল্প, শিক্ষামূলক একটি পপ আপ, বাঘ আর শেয়ালের গল্প, মোটের উপরে খারাপ না , অন্তত বিনিয়োগ সম্পূর্ণ সফল, ছেলে আগ্রহ নিয়ে বই খুলে খেলছে। টোনাটুনি থেকে ছবি আঁকবার উপকরণ কিনে আনবার সময় ছেলের বায়না ছিলো ওর জন্য ধারাপাত কিনতে হবে, ওটা আপাতত ঝুলিয়ে রাখতে হবে, এইসব নানাবিধ মুলো ঝুলিয়ে ছেলের সাথে রাজনীতি করাটা উচিত না হলেও আপাতত এর বাইরে অন্য কোনো উপায় নেই। বাইরে বের হয়েই ছলের আব্দার, বাবা বল কিনবো। আমিও সমাল তালে জবাব দিলাম, যদি বল কিনো তাহলে তোমার বই ফেরত দিয়ে আসবো। বলের চেয়ে বইয়ের মূল্য এখনও ছেলের কাছে বেশী, সুতরাং ধমকে কাজ হলো।

বাঙালী দুই ঈদে আর পূজায় জামা জুতা কিনে, ফেব্রুয়ারীতে বই কিনে- বাঙালীর রসনার তৃপ্তি নিবৃত করার বাইরে অন্য কোনো কাজে তেমন অর্থ ব্যয় করে না। অবশ্য ইদানিং এই অপবাদ ঘুচে যাচ্ছে কিংবা গিয়েছে হয়তো। বাঙালী এখন পহেলা ফাল্গুনে হলুদ জামা কিংবা শাড়ী কিনে, ফাল্গুনের রং হলুদ। হলুদ শাড়ী লাল পাড় মাথায় গাঁদা কিংবা বেলী কিংবা লাল গোলাপ, কিন্তু হলুদের ছোঁয়া না থাকলে বসন্ত মলিন। সুতরাং বাঙালী প্রতিবেশীর সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে এখন প্রতি বসন্তে নতুন হলুদ জামা কিনে।

এটা শুধুমাত্রা অবস্থাপন্ন তথাকথিত শিক্ষিত সংস্কৃতিবান মানুষের চর্চার বিষয় নয় এখন। এমন কি পহেলা ফাল্গুন ভোরের বেলায় রাস্তায় শট শত মেয়েরা নেমেছে হলুদ শাড়ী পড়ে, তাদের সঙ্গতি হয়তো রং কিংবা বাংলার মেলা পর্যন্ত যায় না, কিন্তু ১৬০ থেকে ২২০ টাকার ছাপানো শাড়ী পড়ে যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তখনই এটা সার্বজনীনতা পেয়েছে। সংস্কৃতি চর্চায় প্রচারণার বিকল্প নেই মোটেও, তাই প্রতি বছরই এমন হলুদ শাড়ী পড়া মেয়েদের সংখ্যা বাড়ছে, ঈদ পূজার ধর্মীয় আবহের বাইরে সার্বজনীন বাঙালী উৎসব হয়ে যাচ্ছে পহেলা ফাল্গুন আর পহেলা বৈশাখ। একই সাথে ভ্যালেন্টাইন দিবস উদযাপনের হ্যাপা। সেদিন আবার সবাইকে লাল জামা পড়তে হয়, ভালোবাসার রং লাল? আমি জানি না আসলে।

যাই হোক গত কাল ফাল্গুনের প্রথম দিবসে বই মেলায় গিয়ে খুব একটা ক্ষতি হয় নি, অনেকের সাথে দেখা হলো। চা আর পানির জন্য হাহাকার বাদ দিলে মোটের উপরে সময়টা খারাপ কাটে নি। বই মেলায় লিটলম্যাগ চত্ত্বরে গিয়ে দেখলাম সিটিসেল জুমের দোকান, তবে আমি জানি না, সিটিসেল জুমের কয়টা প্রকাশনা আছে? কিংবা বিডিনিউজ২৪.কমের স্টল কেনো লিটলম্যাগ চত্ত্বরে। মিডিয়া সেন্টার আছে, সেখানে কেনো নয়? সেখানেই দেখলাম আহসান হাবিবকে, হুমায়ুন আহমেদ, জাফার ইকবালের পরিবারের অবহেলিত এবং সম্ভবত সব চেয়ে দুর্বল সেন্স অফ হিউমারের অধিকারী সদস্য। তার নিয়মিত প্রকাশনা উন্মাদের স্টলে বসে আছে মুখ শুকনো করে, আমি স্কুলে থাকতে নিয়মিত উন্মাদ পড়তাম, এরপরে আমার রুচি বদলে গিয়েছে, উন্মাদের মান আমার চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ে নি, বরং শিশিরের রাজনৈতিক কার্টুন কিংবা রনবীর স্যাটায়ার আমার এখন উপভোগ্য মনে হয়, উন্মাদ ঠিক সেইরকম একটা অবস্থানে নেই বলেই আমার কাছে উপভোগ্য নয়।

জানি না উন্মাদ বাজারে কেমন চলে, তবে বই মেলায় আহসান হাবিব বিকল্প আয়ের সংস্থান হিসেবে পারিবারিক ব্যবসা খুলে বতে পারে। বই মেলায় জাফর ইকবাল আর হুমায়ুন আহমেদের অটোগ্রাহের বাজারদর ভালো, আহসান হাবিব বইমেলায় বুথ করে ভাইদের দিয়ে অটোগ্রাফের ব্যবসা করলো অন্তত সারা বছরের খোরাকি হয়ে যাবে তার। পঅটোগ্রাফ প্রতি ১ টাকা পেলেও প্রতি দিন অন্তত ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা উপার্জন হবে। যদি এটাও করতে ইচ্ছা না করে, বেহুদা উন্মাদের স্টলে মুখ গোমড়া করে বসে না থেকে বরং ভাইদের দেওয়া অটোগ্রাসের সংখ্যা গুনতে পারে, বইসা বইসা বাল খাউজানোর চেয়ে অটোগ্রাফ গোনা শোভন। আরিফ জেবতিক, আমি আর মুকুল গিয়ে দাঁড়ালাম বিদ্যাপ্রকাশের স্টলের সামনে।

বই মেলা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগে আগে। মানুষ শখ করে চিরিয়াখানার সামনে গিয়ে বাঁদরের খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, আমরাও একই রকম উৎসাহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, আগ্রহ নিয়েই দেখছি, মোহিত কামাল অটোগ্রাফ দিচ্ছে। এই রকম সস্তা একটা লেখক বাংলাদেশে পুরস্কৃত হয় এবং মানুষ আগ্রহ নিয়ে তার অটোগ্রাফ নিচ্ছে এটা দেখে আক্ষেপ করি না, বরং মনে হয় আদতে মোহিত কামালের মানের লেখকেরা যখন সর্বাধিক বিক্রিত লেখকের তালিকার উপরে থাকে, তখন বই মেলা থেকে বের হওয়ার সময় যেসব মানুষ বই না কিনে বের হয়, তাদের রুচিবোধ অবশ্যই উন্নত।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।