আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই ফাগুনের বুকের ভেতর আগুন আছে।

কতো কী করার আছে বাকি..................

অবশেষে চাঁদও উঠে আসে-লালচে মুখে-লজ্জা রাঙানো আভা তার শরীরে। সে লজ্জায় ঋতুবতী-আভরনে কোন এক অভিসারের গোপী। হাজার তারার আলোয় হাঁটা পথে যে ছায়ান্ধকার তাতে বিস্তৃত তার অভিসারের পথে, কুঞ্চিত ঢেউ খেলানো শাদা মেঘেরা বৃত্তকারে তাকে আড়ালই করে বুঝি-অভিসারের সমস্ত উত্তেজনায় কম্পিত সেই চাঁদ মহাকাশে ধীর অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকে তার আগমনের। মর্ত্যেও, বিশুষ্ক জমিনের আলে কি ছায়ঘন রাস্তায়-হঠাৎই দমকা বাতাস-আচানক-একটানা। ধুলি উড়িয়ে নিয়ে যায়-গাছের পাতায় শরশর শব্দ-যেন কি এক উত্তেজনা-তার জোয়ার সইতে না পেরে শুকনো পাতা গড়াগড়ি খায়-ধুলোঘন পথে কি জমিনে-বাতাসে তখন আবার আমের বোলের গন্ধ।

নাসারন্ধ্রের গর্ত দিয়ে একবারে বুকে-সেখনে কিভাবে যেন তৈরি হওয়া কোন এক গহ্বরে হুহু টানে ছুটে যায়। আজ নিশ্চিত তবে অভিসারের রাত-নিশ্চিত তবে আসছে সেই জন-সে বসন্ত। বসন্তের আগমন দেখতে গ্রামে গিয়েছিলাম। মাঘ সংক্রান্তির রাত্রিকে দেখে বারবারই রাধার কথা মনে হচ্ছিল-এমনই অভিসারীকা হয়েছিল সেই চাঁদ। মনে হয়েছিল কোন এক ঋতুবতী নারী সদ্য উঠে এল মহাকলের সমুদ্র থেকে-স্নান সেরে-তার শরীরে যৌবনের এত প্রকট প্রকাশে সে লজ্জাভারাবনত-আর সম্মুখ গোপন প্রেমের পথে উত্তেজনার শংকা।

তার আগে বিকেলে বেরিয়েছিলাম পথে। প্রকৃতি তার আয়োজন কেমন নিভৃতিতেই করে রাখে। কে দেখলো না দেখলো তাতে তার কিছুই আসে যায় না। শহুরে বসন্ত যেমন আসে ক্যালেন্ডারে কি পত্রিকার পাতায়। গ্রামে বসন্ত আসে প্রকৃতির সমরোহে।

সদ্য লাগানো কোথাও ইরি-কোথাও মিষ্টি আলু-মরিচ চারার বিস্তীর্ণ ভূমিদৃশ্যের পরেই দিগন্তে বৃক্ষ মঞ্জরির সঘন চিত্র-তাতে হঠাৎ আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আগুন হল পলাশ-যে আগুনের বুকে লুকিয়ে থাকে এক দাবানল-সেই আগুনরঙা পলাশ। গাছে গাছে ঝুলে থাকে-যেন অজস্র মুনিয়া বা মোরগের ঝুটি, কেমন বাক বাক করে আহ্বান জনাচ্ছে লড়াইয়ের। সে লড়াইও যেন ভীষণ-আগুন লাগা। কিংবা ছোট্ট চড়াই-ঝুলছে কিন্তু উড়ছে না।

উড়ছে তাদে রঙ। বাতাসে যেন তাদের রঙ হেসে বেড়ায়-হল্কা ছুটিয়ে দেয়-জ্বালিয়ে দিতে চায় আকাশময় এক দাবানল। দিনের শেষে-শেষ দিগন্তে সেই আগুনের একটুখানি আঁচ যখন লেগে থাকে আকাশের আঁচলে-তখনই, কেমন প্রকট হয়ে ওঠে পলাশের ভেতর লুকিয়ে থাকা সেই আগুন। শিমুল যেন এক একটি বিকশিত অঞ্জলি-তাতে আগুনের আভা আছে তেজ নেই। তাতে আহ্বান আছে-লড়াই নেই।

তার পাপড়ির কোমলতায় মনে হয় শিমুল বোধহয় অভিসারীকা চাঁদের হাতের অদৃশ্য সেই ফুল-প্রেমের নৈবেদ্য। সেই গোপীর কামনাতেই ঝরে ঝরে পড়ে শিমুল-ধুলিতে গড়াগড়ি খায়-এতেই যেন তার স্বার্থকতা। ঝরে যাওয়া শিমুল গোটায় পুঞ্জিভূত যে আঁশ-তাতেই কি তৈরি হবে প্রেমিকার মুখলুকানোর চাদর। তাই কি শিমুল ঝরে পড়ায় এতো আনন্দ পায়-এতো স্বার্থক হয়ে ওঠে। আর আছে মান্দার।

রক্তবর্ণের মান্দার। কাঁটা কাঁটা গাছে যেন অসংখ্য রক্তবিন্দু ফুটে আছে। সেই কালচে রক্তে কোমল পেলবতা। এ বোধহয়-জীবনকেই ফুল করে ফুটিয়ে তোলা-কন্টকময় যে গাছ অনতিক্রম্য, তাতে ফুটে থাকা জীবন বিন্দু- এ তো মানুষেরই জীবনছবি কে ফুটিয়ে তোলে-ঝরে পড়া যার নিশ্চিত পরিণতি। ঝুলে থাকার সময়ে সবুজের মিশেলে খয়েরির ছোপ লাগিয়ে যাওয়া-ধূসর ধুলোয় এক বিন্দু রক্ত হয়ে ফুটে ওঠা-এইতো তার জীবন।

কি বিস্ময়- যে রক্ত ছলকে ওঠে বুকে-গল গল বয়ে যায় শরীরময়। সেই রক্তের পরিণতি যে ওই ধুলোমাখা অনন্তের পথেই যায়-সেই প্রকট সত্য মান্দার কেমন আবেগ-উচ্ছ্বাসের বসন্তেও মনে করিয়ে দেয়। বসন্তের আগমন পথে পাতা ঝরে-অজস্র-অগুণতি। যে পাতা একদিন সবুজ ছিলো-বাতাসের গায়ে বিলি কাটতো-সূর্যের আলোতে জীবন খুঁজতো। সেই পাতাই নতুনকে আগমন জানায়-নিজের মৃত্যু দিয়ে।

বৃক্ষশাখের মঞ্জরিতে উশখুশ করতে থাকা নতুন প্রাণের ধাক্কা এতো প্রবল-গোটা এক বছর গাছটিকে বাঁচিয়ে রেখেছিল যে পাতা-সে সেই ধাক্কায় ধুলোতেই তার শেষ পরিণতি বেছে নেয়। সেই ধূলোর পথে সে হলুদ-খয়েরি চিত্রকাব্য তৈরি করে। এ তার অনন্তের পথে যাত্রার বসন। সবুজ হয়ে আসা জলের পুকুরে ঝরে পড়া পাতার বিস্ত্রস্ত বিন্যাস-চিত্রল চিতা বাঘের নকশা আঁকে। তাতে কচিৎ ঘাই দেয়া মাছের দুলুনি-আবারো দমকা বাতাসে ঝরে ঝরে পরা শিরিষ পাতা-সাঁই করে নেমে আসা ধবল বক-ইরির জমিনে নতুন পানি পাওয়া ব্যাঙের সোহাগী ডাক-একটানা ঝিঁঝিঁ-বাওকুড়ানি কোকিলের ডাক।

শিমুল-মান্দার-সজনের শাদা ফুল- আর সেই আগুনজ্বলা পলাশ। কি এক মোহময়ি রহস্যের বসন্ত। জীবনের বাণ ডেকে যায়-মৃত্যুকে স্বাভাবিকতায় ফুটিয়ে তোলে। বসন্তকে আমন্ত্রণে প্রকৃতির কতো আয়োজন-ব্যকুলতা। শহরের টান এতো প্রবল-আমি কিছুতেই পারি না আরো কিছুক্ষণ প্রকৃতির সেই ব্যকুলতা উপভোগ করি।

আরো কিছুক্ষণ পলাশে লাগা আগুনের আঁচ নেই আঁজলা ভরে। কিন্তু সেই সাধ্য হল না। আসতে আসতে ভাবি-যে বসন্তের পলাশ দেখেনি-বসন্তের বুকের আগুন দেখেনি-সে কি আদৌ বসন্ত দেখেছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।