আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পোস্টার(গল্প)

বিকট
১(প্রারম্ভিকা) আমার এক নিকটসম্পর্কের বয়স্কা আত্নীয়া সম্প্রতি শক্ত অসুখে পরেছিলেন। নিঃসঙ্গতাকে সঙ্গী করে যিনি ধূসর দিন অতিবাহিত করেন এই শহরের কোন এক আয়েশী ফ্ল্যাটবাড়ীতে। অন্য সব নগর অভিজাতিনীদের মতই তার আছে একটা সুখময় সমৃদ্ধ অতীত। তবে অনেকের মতই তার জীবনটাও এখন বস্তুবাদিতার কর্কশ আচ্ছাদনে আবৃত। সুখ দুঃখের ব্যাপারগুলো নিয়ন্ত্রন করছে টেলিভিশন,সেলফোন অথবা ড্রয়িংরুমকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার অভিপ্রায়।

কাছের মানুষরা অনেক দূরে,অথবা প্রাযুক্তিক উৎকর্ষতার সেই জনপ্রিয় শ্লোগান"ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী" মানলে খুব বেশি দূরে নয়। কখনও অস্ট্রেলিয়া কখনও কানাডা থেকে তার খবরতো প্রতিনিয়তই নিচ্ছে ছেলে মেয়েরা,তাদের ছেলেমেয়েরা। শুধু বেচারী স্বামী ভদ্রলোক পারছেননা আরেকটু বেশি দূরে থাকার কারণে। ভদ্রমহিলার ধূসর জীবন আরও ধূসরিত হয় গহীন অন্ধকারে শুয়ে থাকা মানুষটির কথা মনে করলে। তারপরেও নিঃসঙ্গ নারী বেঁচে থাকে.... ২(উপলদ্ধি) আমি তার খোঁজ রাখিনি অনেকদিন।

কখনও মনেও আসেনি খোঁজ নেয়ার কথা। ছোটবেলায় তার স্নেহের স্নিগ্ধ পরশে সিক্ত হয়েছি বারবার। কিশোর বয়স পর্যন্ত তার বাসায় যাওয়া আমার জন্যে ছিল এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। কে জানে হয়তোবা প্রাচ্যদেশীয় ঐতিহ্যবাহী "নারীনীতি" অনুসারে এখনও সবার জন্যে মমতার সমুদ্র জমা করে রেখেছেন তার বুকে। সেই মমতার সমুদ্রে স্নান করা আর হয়ে ওঠেনা আমার ইদানিং।

প্রয়োজন মনে করিনা। আমার উক্ত নিঃসঙ্গ,প্রৌঢ়া নিকটাত্নীয়া সম্প্রতি শক্ত অসুখে পরেছিলেন। হাসপাতালে দেখতে যেতে পারিনি ঐ সময়টায় শহরের বাইরে থাকার কারনে। ফিরে এসে সব শুনে প্রয়োজন মনে করলাম তাকে একবার দেখতে যাবার। এতটুকু সময় করে নিতে পারব।

তার সাজানো শখের প্রাণহীন চৌকো বাড়ীতে হয়তোবা কিছুটা প্রাণের বিস্তার হবে,পারস্পরিক অতীত স্মৃতি বিনিময়ে হয়ত তিনি উৎফুল্ল হয়ে উঠবেন। না হলেও,তার নিঃসঙ্গতা,দূর্বিষহ রোগযন্ত্রনার কথা বলে হয়তোবা স্বস্তি অনুভব করবেন। ৩(নস্টালজিয়া) অনেকদিন আসা হয়নি শহরের এই অংশটায়। সেই খেলার মাঠটি আর নেই। ঝিলের ধারের বস্তি উধাও।

কিছুই কি নেই আর আগের মত? স্মৃতিকাতরতায় পেয়ে বসেছে আমাকে। অতীত অভিযাত্রায় নেমে আমি সবকিছু খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করি। একটি পরিচিত মুদী দোকান এখনও সেই অবস্থায় আছে দেখে ভাল লাগল। সেই সিনেমাহলটিও টিকে আছে কোনমতে। কি ছবি চলছে সেটাও খেয়াল করলাম।

নাহ,কোন উদ্ভট নামের অদ্ভুত ছবি নয়। ইদানীং শুনছি সুস্থ্য ছবির জোয়ার চলছে নাকি। ভালই!অসংখ্য নির্বাচনী পোস্টার চোখে পড়ল সর্বত্র। কি যেন সংস্থার সভাপতি পদে অমুক ভাই,তমুক ভাই....আমিও মনে মনে এক ভাইকে সমর্থন করা শুরু করলাম। সবকিছুই ভাল লাগে কখনও কখনও।

এইসব মুহুর্তগুলো জীবন থেকে কিভাবে হারিয়ে গিয়েছিল!স্মৃতির দমকা বাতাস আর শ্রদ্ধার বৃষ্টিতে খুলে যায় হ্দয়ের বন্ধ দরজা,সিক্ত হয় মন..... ৪(অনুভুতির জটিল আবর্তন) "তোমরা তো আমাকে ভুলেই গিয়েছ। "-তার কন্ঠে অভিমানের বাস্প। "নিজের ছেলেমেয়েরাই মনে রাখেনা!"-আদ্র্রতা ভরা কন্ঠ তার। এরপরের পর্যায়ে আমি আশা করছিলাম তার অসুস্থ্যতার পূর্ণ,পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ,কিন্তু তার পরিবর্তে তাকে তার সুদুর পাশ্চাত্যে বসবাসকারী নাতী-নাতনীদের ঘুষঘুষে জ্বর অথবা সর্দি নিয়ে চিন্তিত মনে হল,পূর্ববর্তী সুখময় স্মৃতি রোমন্থন পর্ব যখন আসল,তখন অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার সম্বন্ধে কত ছোটখাট তথ্যই না তিনি মনে রেখেছেন! "তোমার সেই খেলনাটা সেবার ভেঙে গিয়েছিল দেখে কত্ত কেঁদেছিলে!" আমি ভুলেই গিয়েছিলাম সেই খেলনাটার কথা। "ঈদে সেলামি নেয়ার জন্যে কত জোরাজুরিই না করতে!তোমাকে সবচে বেশি না দিয়ে পারা যেতনা"।

এভাবে স্মৃতির সমুদ্রের অতল থেকে তিনি তুলে আনলেন কত মনি-মুক্তা। আমি ক্রমশঃ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ছি। কত অনাদর,অবহেলা,উপেক্ষাকে কি অবলীলায় ক্ষমা করে দিয়ে বসে আছেন মহিয়সী এক মহিলা। ইনি যেন আমার আরেক মা,না শুধু আমার কেন,সবার মা,সব সময়ের মা। একজন চিরকালীন মায়ের প্রতিচ্ছবি।

আমার হঠাৎ আজ বিকেলে দেখা সেই সিনেমার পোস্টারটার কথা মনে পড়ল। অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে থাকা এক মায়ের করুণ মুখছবি ছিল সেখানে। তখন হাসি এসেছিল বাংলা সিনেমায় আবেগের আতিশায্য আর কান্নার জলোচ্ছাসের কথা ভেবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যতই মোটা দাগের হোক ছবিটা আমার দেখতে হবে!আজকে ফেরার সময় দেখব নাকি? যাই হোক,আজকে খুব বেশি সময় নেই। উঠতে হবে।

"খুব ভাল লাগল আপনার এখানে এসে "। বললাম আমি। "অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ল। আর আপনি যা ভাবছেন,তা কিন্তু না,আপনাকে আমরা মোটেই ভুলিনি। আসলে সময় পাইনাতো,তাই আসা হয়না......"আমার আবেগাপ্লুত ভাষণ বাধা পড়ল একটা মিষ্টি কন্ঠের ঝংকারে... ৫(বিবর্তন প্রক্রিয়া-১) "চা দিমু? জানতে এসেছে বাসার তরুনী গৃহপরিচারিকা।

"ওহ,ভূলেই গিয়েছি,তোমাকে কিছুই খেতে দেয়া হয়নি। গল্পে গল্পে কিভাবে যে সময় কেটে যায়!" ব্যাস্ত হয়ে উঠলেন তিনি আমার আপ্যায়নের জন্যে। "না না,ব্যস্ত হবেন না আপনি,কিছু দিতে হবেনা। আমার একটু তাড়া আছে" "তুমি একটু বস,আজান দিয়ে দিয়েছে,আমি নামাজটা পরে আসি। এই ফাঁকে তুমি অল্প কিছু খেয়ে নাও।

কিছু না খেয়ে গেলে কিন্তু আমি...."ইত্যাদি। কিন্তু আমার সময় ছিলনা। "ভাইয়া,বইসা যান না,কিছু না খায়া গেলে কেমন দেহায়!" মিষ্টি রিনরিনে কন্ঠ। আমার মনে হল আমার আসলে তেমন একটা ব্যস্ততা নেই। বসা যেতে পারে আরও কিছুক্ষণ।

৬( বিবর্তন প্রক্রিয়া-২) খালাম্মা নামাজ পড়বেন। আমি বসে থাকব। তরুণী গৃহপরিচারিকা নাস্তা দেবে। আমি অপেক্ষা করে বসে থাকব ড্রইংরুমে। একা।

খালাম্মা নামাজ পড়ছেন। মেয়েটি এখনও নাস্তা নিয়ে আসছেনা কেন? বেশ দেখতে মেয়েটি। সান্ধ্যকালিন প্রার্থনার সময়কাল বেশি হয়না। মেয়েটির তাড়াতাড়ি করা উচিত। আমি তো বসে না থেকে বাসাটা একটু ঘুরে দেখতে পারি,নাকি? সেটা কি খারাপ দেখাবে? আশ্চর্য!খারাপ দেখানর কি আছে! আমি তো বলতে গেলে এই বাড়ীরই ছেলে।

রান্নাঘরে টুংটাং আওয়াজ। শরীর ভরা শরীর নিয়ে গৌরবর্ণা তরুণী খাদ্য ও পানীয় প্রস্তুত করছে আমার জন্যে। আমি সন্তর্পনে রান্নাঘরের দরজার পাশে এসে দাঁড়ালাম। শরীর জুড়ে শরীর আমার,মন জুড়ে শরীর। আমি কি রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে জিগ্গেস করতে পারি টুকটাক,সাধারন কথাবার্তা? সেটা কি খারাপ দেখাবে? ধরা যাক,আমি ঢুকে গেলাম।

ঐ মুহূর্তে লোডশেডিং হল। নিকষ অন্ধকারে ভয় পেয়ে মেয়েটি আমাকে জড়িয়ে ধরল,আর আমি.... নাহ,নেহায়েৎ ছেলেমানুষি চিন্তা। খুঁট করে একটা শব্দ হল যেন? আমার বিরক্তিকর বয়স্কা আত্নীয়ার ধর্মীয় আরাধনা কি শেষ?নাহ,করিডর ধরে একটু এগিয়ে বেডরুমে উকি মেরে দেখলাম উনি এখনও প্রার্থনারত। পাশে একটা তসবি। উনি কি তসবি জপবেন?অবশ্যই এটা করা উচিৎ।

প্রৌঢ়ার উচিৎ অনেক সময় নিয়ে ধর্মীয় আচার পালন করা। কিন্তু আমার হাতে যে সময় নেই! আমি দ্রুত পায়ে রান্নাঘরের দিকে গিয়ে দেখি সেখানে সে নেই। ড্রইংরুমে ঢোকার সময় দেখলাম তাকে,নাস্তা পরিবেশনে ব্যস্ত। ইস!বসে থাকলেই পারতাম! চা দেবার সময় তার হাতটা ধরে ফেলতাম যদি খপ করে! নাহ,সেটা একটু বিপদজনক হয়ে যেতনা? কি এসে যায়! আমি কিচ্ছুর পরোয়া করিনা। আমি তরুণীর দিকে এগুচ্ছি।

তরুণী স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তরুণীরা চোখের ভাষা পড়তে পারে। সে রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়া একটা হাসি হাসল। তরুণীরা অগ্নুৎপাত ঘটাতে জানে। হঠাৎ সে তার মদির মুখভঙ্গি পাল্টে নারীদূর্লভ কঠোরতা এনে বলল, "খালাম্মা আসতাছে"।

তরূণীদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় প্রখর হয়। আমার হাতে সময় ছিলনা। আমি নাস্তা না খেয়েই চলে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রৌঢ়ার অনুরো্ধে আমাকে এক পেয়ালা চা পান করতে হল। চলে আসার সময় তিনি আমাকে বললেন,"আবার এস বাবা" আমি বললাম আসব।

চলে আসার সময় তরুণী আমাকে বলল,"আবার আইসেন ভাইজান"। আমার শরীর বলল যে সে আবার আসবে। ৭( পরিশিষ্ট) বাসা থেকে বেড়িয়ে বেশ কিছুদূর হাঁটতে হল যানবাহনের জন্যে। সিনেমা হলটির সামনে দাঁড়িয়ে দেখি ছবির পোস্টার পাল্টানো হয়েছে। সেখানে কোন অশ্রুসজল মায়ের মুখনেই।

সল্পবসনা,যৌনাবেদনময়ী নায়িকার উত্তেজক ছবি।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।