আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণি আদমের ক্যাম্পাস: জাগ্রত ভাস্বরের ইতিহাস

সত্য প্রকাশে সংকোচহীন [img|http://ciu.somewherein.net/ciu/image/95718/small/?token_id=644de4e0109206fcefe6b5cb6dc9a98e জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খুনি ও ধর্ষক প্রতিরোধ দিবসের ইতিবৃত্ত, মৌলবাদি জামাত শিবির বিতাড়ন, শিক্ষক রাজনীতির কুটিল ওলি গলি, ছাত্র রাজনীতির বৈচিত্র্যতা, আন্দোলন আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্বতস্ফূর্ততায় জাহাঙ্গীরনগর, সবকিছুর সমন্বয়েই গণি আদমের ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসের ইতিহাস জানার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক সংকলন। নব্বইয়ের দশকের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা আছে। কিন্তু নব্বই পরবর্তী ছাত্ররাজনীতির ইতিহাস ঠিক এর উল্টো। বন্ধ হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণতন্ত্রচর্চার দ্বার।

বন্ধ রয়েছে ছাত্র সংসদ নির্বাচন। ছাত্ররাও রাজনীতিও গণতন্ত্রচর্চার পরিবর্তে লবিং চর্চায় ব্যস্ত। নিজেদের মধ্যে গ্রুপিং করছে। পাশাপাশি শিক্ষকরাও নিজের আধিপত্য কায়েমে গ্রুপিং এ লিপ্ত। ছাত্রশিক্ষক উভয়ের গ্রুপিং এখন একমঞ্চে।

শিক্ষক কেন্দ্রিক ছাত্রনেতাদের এই গ্রুপিং ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করার জন্যই সবচেয়ে বেশী দায়ী। ছাত্রনেতাদের সকল অপকর্মকে চাপিয়ে শিক্ষকরাই এদের প্রশ্রয় দিয়েছেন। কারণ নিজেদের স্বার্থরক্ষা। বর্তমানে সরকার সমর্থিত শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের মধ্যে গ্রুপিং-ই বিশ্ববিদ্যালয় অচল করার জন্য দায়ি। ‘গণি আদমের ক্যাম্পাস’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রচিত এক উপন্যাস।

লেখক রাশেদ মেহেদী প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তার লেখনীতে ফুটিয়ে তুলেছেন ক্যাম্পাসের অন্যায়, নির্যাতন, ধর্ষণ, খুন, প্রতিবাদ, আন্দোলন, প্রতিরোধের অদম্য ইতিহাস। ৯১-’৯৬ সালে বি এন পি’র আমলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন নিয়ে সরকার সমর্থিত শিক্ষকরা ছাত্রদল দিয়ে প্রতিপক্ষ শিক্ষকদের মারধর করান। এটি জঘন্য ঘটনার চরম ন্যাক্কারজনক একটি অধ্যায়। ক্ষমতার পট পরিবর্তনে ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ন্যাক্কারজনক আরো ঘটনা ঘটতে থাকে।

প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতাকর্মীদের নির্যাতন, ছাত্রীদের ওপর নিপীড়ন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, খুন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতিনিয়ত। ধর্ষণে সেঞ্চুরীর পর মিষ্টি বিতরন করেন ছাত্রলীগ নেতা। ক্ষমতার আধিপত্য বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিদের গ্রুপিং মারাত্মক বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। প্রশাসনে তথৈবচ অবস্থা বিরাজ করে। এদের পৃষ্ঠপোষকতায় কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায় ছাত্রলীগ।

আগেই ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয় ছাত্রদল। সুযোগকে কাজে লাগাতে চায় মৌলবাদী সংগঠন ছাত্রশিবির। মাথাচাড়া দেয় ক্যাম্পাসে। প্রতিরোধ করে শিক্ষার্থীরা। মুচলেকা দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হয় সংগঠনটি।

এরপর আর প্রকাশ্যে আসার সুযোগ পায়নি তারা। বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকান্ড। অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ক্যাম্পাসবাসী। ছাত্রীরা নিরাপদে চলতে প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হয়। ছাত্রলীগের খুন, ধর্ষণসহ নানা অপকর্মের খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হলে প্রতিরোধের ভাবনা জাগে শিক্ষার্থীদের।

শুরু হয় আন্দোলন। ছাত্র ইউনিয়ন-ছাত্রফ্রন্টসহ প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠন সমুহের নেতৃত্বে ‘সাধারণ ছাত্র ঐক্য’র ব্যানারে ১৯৯৮ সালে সংগঠিত হয় প্রথম ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন। এটিই ছিল সারাদেশে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংঘটিত সবচেয়ে বড় এবং জোরালো আন্দোলন। আন্দোলন চলাকালে ২৩ আগস্ট ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদকে শারিরীকভাবে লাঞ্চিত করে। ২৪ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট সদস্য আফরোজান নাহার রাশেদা ছাত্রলীগের হাতে লাঞ্চিত হন।

চলতে থাকে তুমুল আন্দোলন। র‌্যালি, মিছিল, বিক্ষোভ, অনশন, ঝাড়– মিছিল, মশাল মিছিলে বারবার প্রকম্পিত হতে থাকে ক্যাম্পাস। শাসকদের ভীত দূর্বল হয়ে পড়ে। অপকর্মে জড়িত ছাত্রলীগ কর্মীরা হতে থাকে ভীত। ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থাকে ক্যাম্পাস।

প্রতিরোধের দুর্দান্ত আগুনে প্রজ্জ্বলিত হয়ে অবশেষে ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য হয় খুনি ও ধর্ষকদের গ্রুপ। সূচিত হয় সফল এক আন্দোলন। গণি আদমের ক্যাম্পাস বইটিতে লেখকের ভাষায়, ‘ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে সাধারণ ছাত্রঐক্যের স্লোগান প্রতিধ্বনিত হয়েছিল সারাদেশে। সমাজের সচেতন মানুষ, সুশীল সমাজ, প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠন অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে সাধারণ ছাত্রঐক্যের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিল ধর্ষকদের ন্যূনতম হলেও শাস্তি দিতে।

১৯৯৯ সালের ২ আগস্ট প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মিছিল নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়াল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ধর্ষকদের। সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাতে লাঠি, কন্ঠে প্রতিবাদী স্লোগান, বুকে অদম্য সাহস। সেই মিছিল ঢুঁকে পড়লো ধর্ষকদের দখলে রাখা ছাত্রদের ৩টি হলে। মিছিলের তীব্র উত্তাপে অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ধর্ষকরা পালিয়ে গেলো। ক্যাম্পাস ধর্ষণমুক্ত হল।

’ ১৯৯৯ সালের ২ আগস্ট ক্যাম্পাস পায় ঝকঝকে সোনাঝরা একটি দিন। তখন থেকেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হয় ২ আগস্ট খুনি-ধর্ষক প্রতিরোধ দিবস। এর প্রেক্ষাপটে ক্যাম্পাসে খুন, ধর্ষণ, অন্যায়, নির্যাতন প্রতিরোধে সেবছরই সাধারণ শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের নিয়ে গঠিত হয় বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক জোট। সংগঠনটি এখন পর্যন্ত শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরের ঐতিহাসিক সেই আন্দোলনের সার্বিক প্রেক্ষাপট নিয়েই রচিত ‘গণি আদমের ক্যাম্পাস’ উপন্যাসটি।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধারাবাহিক সন্ত্রাস, খুনের নেপথ্যের জটিল রাজনীতি এবং অদৃশ্য পৃষ্ঠপোষকদের চেহারাও দেখা যাবে উপন্যাসের কিছু চরিত্রের চোখে চোখ রেখে। বইটির প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে ক্যাম্পাসের অদৃশ্য ও নেপথ্যের ভয়াল শক্তিগুলো। লেখক রাশেদ মেহেদী সেই সময়ের সাহসী সাংবাদিক ও ইতিহাসখ্যাত এ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক। বাস্তবতা থেকে উপকরণগুলো নিয়ে নিজস্ব দক্ষতায় মেলে ধরেছেন বইটির প্রতিটি পাতায়। সচেতন শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের পিপাসা শতভাগ মেটাবে বইটি নিসন্দেহে।

প্রতিবাদীর মনে জাগাবে শিহরণ। বুকে অদম্য সাহসিকতা সৃষ্টি করবে। বইটির আন্দোলনকারীদের ভূমিকা অন্যায়, অবিচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ আন্দোলন ও তীব্র প্রতিবাদ সৃষ্টিতে সহায়তা করবে। রাশেদ মেহেদীর ক্ষুরধার লেখনীর নান্দনিক প্রকাশ বইটি। বইটির প্রত্যক্ষ বাস্তবতা সংঘটিত হয়েছিল এখন থেকে একযুগ আগে।

ক্যাম্পাস শিক্ষার্থীদের চলমান প্রবাহ। প্রতিবছর নবীনদের পদাচরণা বাড়ে। বিদায় নেয় একটি বড় অংশ শিক্ষার্থী। কিন্তু ‘গণি আদমের ক্যাম্পাস’ এর ভাষায় ক্যাম্পাসের ‘নিয়ন্ত্রক’ শক্তিগুলো অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় ধরেই অবস্থান করে। এসব নাটের গুরুদের মুখোস উন্মোচনে সরাসরি শিক্ষকদের নাম ব্যবহার করা উচিত বলেই সচেতন পাঠকের দৃঢ় প্রত্যাশা।

অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে লেখক ঘটনার পরম্পরা উদ্ধৃত করেছেন- বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সরাসরি নামগুলোর সংযোজন বইটির সমৃদ্ধকরণে আরেকটু ভূমিকা রাখতো বলেই পাঠকের কাছে প্রতীয়মান হয়। বইটির ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রতিটি ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা ভালো মানুষীর আড়ালে লুকিয়ে থাকা কলুষিত চরিত্রগুলোর বিরুদ্ধে সময়োপযোগী আন্দোলন গড়ে তুলবে এটাই প্রত্যাশা।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।