আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি যদি বড় হতাম!

একদিন আমি বসে ছিলাম ঘরে। বসে আছি তো আছিই, এমন সময় হঠাৎ আমার মাথায় অবাক করা এক ভাবনা এল। কী যে ভালো হতো, যদি পৃথিবীর সবকিছু উল্টো হতো! মানে, বাচ্চারাই হতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর বড়রা চলত বাচ্চাদের কথামতো! বাচ্চারা হতো বড় আর বড়রা হতো বাচ্চা। আহ! কী যে ভালো হতো তবে!
যদি এমন কিছু ঘটত, তাহলে মায়ের চেহারাটা যা হতো না! বাবাও যে খুব পছন্দ করত, তা-ও নয়। আর দাদি! আমাকে দেখে বোধ হয় সারা দিনই চিৎকার করতে থাকত! আমিও ওদের বুঝিয়ে দিতাম কত ধানে কত চাল!
যেমন মা হয়তো দুপুরের খাবার খেতে বসেছে, আমি তাকে বলতাম, ‘এটা আবার কী ফ্যাশন! রুটি নিচ্ছ না কেন? নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখেছ? একেবারে ডাইনি বুড়ির মতো লাগছে! এক্ষুনি খাওয়া শেষ করো! কিচ্ছু ফেলে যাওয়া চলবে না!’
মা মাথা নিচু করে খেতে থাকত।

আর আমি তখন বলে চলতাম, ‘এত সময় লাগছে কেন খেতে? খেতে বসে কী ভাবছ? পৃথিবীর সব সমস্যা কি তোমাকেই সমাধান করতে হবে? ঠিকমতো খাবার চিবোচ্ছ না কেন? নড়ছ কেন চেয়ারে বসে?’
আর ঠিক তখনই হয়তো বাবা আসত অফিস থেকে। এসে জামা-কাপড় ছাড়ার আগেই আমি চিৎকার করতাম, ‘হুম্, তিনি এলেন! সারা জীবনই তোমার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়! এক্ষুনি হাত ধোও। যেভাবে হাত ধোয়ার নিয়ম, সেভাবে ধোও। তুমি হাত ধোয়ার পর তোয়ালেটার যা চেহারা হয় না! সাবানের জন্য মায়া কোরো না। যতক্ষণ হাত পরিষ্কার না হচ্ছে, ধুতে থাকো! আঙুলগুলো দেখি? একি কাণ্ড! নখগুলো এত বড় কেন? নেইলকাটার কোথায়? চুপ করে বসো।

নখ কাটতে দাও। ’
বাবা খুব নিচু স্বরে মাকে বলত, ‘কেমন আছো?’
মা আরও নিচু স্বরে বলত, ‘আছি আরকি!’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বলতাম, ‘খাবার টেবিলে এত কথা কিসের? খাওয়ার সময় বোবা-কালা হয়ে থাকতে হয়, সে কথাও জানো না? বাবা, হাত থেকে খবরের কাগজটা নামিয়ে রাখো। উফ্!’
বাবা-মা চুপচাপ খেতে থাকত, ঠিক এ সময় দাদি এসে দাঁড়াত সামনে। তাকে দেখেই আমার মেজাজ হয়ে যেত তিরিক্ষি! ‘মা, বাবা, দেখো দেখো, দাদির দিকে তাকিয়ে দেখো! জামাটার অবস্থা করেছে কী! গাল দুটো দেখো লাল! হাতের লাঠি দিয়ে কি হকি খেলতে গিয়েছিলে, দাদি! এই নোংরা লাঠিটা এখানে কেন? আমার চোখের সামনে থেকে লাঠিটা সরাও!’
তারপর আমি তিনজনকেই বলতাম, ‘খাওয়া শেষ হলেই পড়ার টেবিলে যাবে। আমি একটু সিনেমা দেখতে যাব।


ব্যস! দাদি, মা আর বাবা বায়না ধরত, ‘আমরাও তোমার সঙ্গে যাব! আমরাও সিনেমা দেখব!’
আমি বলতাম, ‘বায়না ধরলেই হলো? কালই না একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠানে নিয়ে গেলাম? রোববার না সার্কাসে নিয়ে গেলাম? প্রতিদিন শুধু ঘুরে বেড়ালে চলবে? বাড়িতে বসে থাকো। আর ত্রিশ কোপেক নাও, আইসক্রিম কিনে খেয়ো, জ্বালিয়ো না!’
তখন দাদি এসে বলত, ‘শুধু আমাকে নিয়ে চলো। সব বাচ্চাই তো অন্তত একজন বড় মানুষকে বিনে পয়সায় নিয়ে যেতে পারে!’
আমি একটু হেসে বলতাম, ‘দাদি, সত্তর বছরের বেশি বয়সী মানুষদের এই সিনেমা দেখতে মানা। বাড়িতে বসে থাকো, আইসক্রিম খাও। ’
আমি ওদের সামনে দিয়েই বারবার হেঁটে বেড়াতাম।

জুতোর হিলে শব্দ তুলতাম। এমন ভাব করতাম, যেন দেখতেই পাচ্ছি না দাদি, মা আর বাবার চোখ পানিতে ভেসে যাচ্ছে। কাপড় পাল্টাতাম, অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকতাম আয়নার সামনে! গুনগুন করে গান করতাম, যেন বড়রা আরও বেশি কষ্ট পায়! শেষমেশ আমি দরজা খুলে বের হতাম আর যাওয়ার আগে ওদের বলতাম...
কিন্তু এরপর আর ভাবতে পারলাম না কী বলতাম, কারণ ঠিক তখনই মা এসে ঢুকল বাড়িতে, একেবারে সত্যিকারের মা! আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখনো বসে আছো? নিজের চেহারাটা আয়নায় দেখেছ? একেবারে ডাইনি বুড়ির মতো লাগছে!’।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।