আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অপূর্ব এক পরিবর্তন

অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি

এ বছরের শুরু দিকে ব্লগার স্ট্যানলি কুবরিক একটি ব্যর্থ প্রপোগান্ডা চালিয়েছিলেন। আমাদের মহান ছাগুরামকে কয়েকটি পর্ণ সাইটের মডারেটর হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। পর্ণ সাইটের মডারেটর আবার সামহোয়ারে 'ইসলাম' গ্রুপের কর্ণধার! এই ছিল তার বক্তব্য। ব্যাপারটা মজা করেই করা। তবে ছাগুরাম যথেষ্টই সিরিয়াসলি নিয়েছিলো।

ব্যান থাকায় অন্য নিকে এসে ডাটাসহ সে প্রমাণ করে দেয় সাইটগুলোর কর্ণধারা কারা, মালিকানা কাদের। এরই একটি যৌবনজ্বালা। কুবরিকের সেই পোস্টে উল্লেখিত বাকি সব সাইটই লালবাতি জ্বলে লাটে উঠেছে। কিন্তু যৌবনজ্বালা আলেক্সা র‌্যাঙ্কিংয়ে ওপরের দিকে থেকে ধরে রেখেছে এর উর্ধ্বগামিতা। সে ঘটনা নিয়ে ঠাট্টা ফাজলামীর ভার্চুয়াল আড্ডাতে এক কমরেড বললেন, 'আর যেই হোক ছাগুরামের পক্ষে যৌবনজ্বালার মডারেটর হওয়া অসম্ভব।

' কেনো নয়! তার প্রশ্ন- আপ্নে যৌবনজ্বালায় ঢুকছেন কখনো? আমার জবাব- অবশ্যই ঢুকছি। ইন্টারনেটে ঢুকে নাঙ্গাপাঙ্গা দেখে না এমন সাধু পুরুষ অবশ্যই বিরল। আমি সেই বিরল প্রজাতিতে পরি না। পরের কথা- গিয়া কি দেখছেন? বললাম- দেশ-বিদেশের মাইয়াগো ছবি, ভিডিও। কমরেড দেখি খেপচুরিয়াস- ধুরো মিয়া, যৌবনজ্বালায় কি খালি এইগুলি আছে নিকি! আর কিছু দেখেন নাই? বাংলাদেশ সেকশান, হটস্পট? আমি বিব্রত।

না বস, দেখি নাই। 'যান গিয়া দেইখ্যা আসেন, তারপর বুঝবেন কেনো পারবো না। ' ঢুকতে গিয়ে পারলাম না, উল্টো জানলাম আমার নিকটা নাকি অশ্লীল মনে হচ্ছে কর্তৃপক্ষের। তাই আমাকে নিক বদলাতে হবে। গেস্ট হিসেবেই ঢুকে দেখি উপরের দিকে বিজয়ের ৩৭তম বছর পালন করছে তারা।

বাংলাদেশ নামের সেকশানটায় ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধের নানা থ্রেড। সদস্যদের অনেকেরই সিগনেচারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই লেখা। এবং কোথাও বাংলাদেশ বিরোধী কোনো বার্তা নেই। নেই ছাগুদের ট্রেডমার্ক প্রচারণা। আমার জানা হয়ে যায় এরা কাদের প্রশ্রয় দেয় না।

সেই সঙ্গে জানি মন্তব্যে 'খেকজ' নামের হাসির উৎস। যৌবনজ্বালার আগে এই জিনিস আন্তর্জালে আমদানী করেনি কেউ । আমি আগ্রহী হই। আমার আপাতদৃষ্টিতে উদ্ভট এক পরিকল্পনার জন্ম তাৎক্ষণিক। 'দেশে ফোরাম চেনালো যারা' ব্যানার নিয়ে, পঞ্চাশ হাজারের বেশী সদস্যের পরিবার বলে দাবী করা এই জায়গাটা এক্সপ্লোর করতে হবে।

তার আগে আলাপ করি কয়েকজন ব্লগারের সঙ্গে। প্রত্যুতপন্নমতিত্ব, রাতমজুর, সুশান্তদের জিজ্ঞেস করি যৌবনজ্বালায় কাউকে চেনে কিনা, এডমিন লেভেলে। তারা চেনে না। শরণ নেই সেই কমরেডের। তিনি শুধুই সদস্য।

তবে পরিকল্পনা শুনে খুবই খুশী হলেন, দেখেন চেষ্টা কইরা। জন্মালো 'আশ্রম'। তখনও জানি না সমান্তরালে এক রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে যৌবনজ্বালা। রূপকার আমারই মতো এক পাগল। নিয়তির এক অদৃশ্য ইশারায় আমরা এক ঐতিহাসিক কীর্তিতে সঙ্গী হতে যাচ্ছি।

দু-মাস গেলো ভাবচক্কর বুঝতে। সময়টাতে পারিবারিক এক বড় ঝামেলাতে পড়লাম। সুবাদেই সব ছেড়েছুড়ে বৈরাগী গৃহবাস। কোত্থাও যাই না। পিসির সামনে বসে থাকি।

এটুকু বুঝলাম এই ফোরাম সদস্যদের একটা বড় অংশই এর রেড লাইট এরিয়ার ভক্ত। সেখানে রসময় গুপ্তর চটি থেকে দেশী-বিদেশী মেয়েদের ছবি আর ভিডিও। আর দেশী মানে শুধু বাংলাদেশী না, ভারতীয়-পাকিস্তানী-এরাবিয়ান সব। উড়ে এসে এসব পাবলিককে নসীহত দিয়ে লাভ হবে না কোনো। মোটিভেট করতে হলে করতে হবে এদের একজন হয়েই।

নজর কাড়া হয়ে যায় আমার। সে সময় 'সাপ্তাহিক ২০০০'-এ একটি প্রতিবেদন বেরোয়। হলুদ সাংবাদিকতা কাকে বলে তার প্রমাণ পরতে পরতে, প্রতিটি ছত্রে। তুমুল প্রতিবাদ আসে সদস্যদের তরফে। সে সময় এক গেট টুগেদারে হাজির হই।

একই দিন পাবলিক লাইব্রেরিতেও একটা ব্লগার সমাবেশ ছিলো। সেটায় অংশ নেয়ার আগে আধঘণ্টার জন্য ঢু মারা। হাটুর বয়সী পোলাপান সব। তারাও আশ্রমকে দেখে ভ্যাবাচেকা! কিন্তু এর দরকার ছিলো। আমার আরো ডিপে যেতে হবে।

যাকে দেখতে সেখানে যাওয়া, সে নেই। আমার সব আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু অপূর্ব। বাঘমামা নামে মেম্বারদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়। এডমিনদের একজন। বাকি দু এডমিন ভুত মামা ও কুয়াশা মামা কানাডা প্রবাসী।

তবে তারা নামেই। প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক এই দুজন অপূর্বর হাতেই সব দায়িত্ব সঁপেছেন। সাইট নিয়ে যত হ্যাপা সামলান বাঘ মামাই। ভার্চুয়ালি ভীষণ কাঠখোট্টা এক ক্যারেক্টার। দুবার ইন্টারঅ্যাকশন হয়েছে এফবিআইতে- আকামের কারণে হলুদ পৈতা পড়িয়ে 'ক্যানো ব্যান করা হবে না' জিজ্ঞাসাবাদের আদালত।

কর্কশ, দূর্বিনীত কথাবার্তা। রমজানে এক ইফতার পার্টিতে সামনাসামনি দেখে আমি অবাক। এই একই লোক কম্পিউটারের সামনে মিস্টার হাইড হয়ে যায় কিভাবে! ততদিনে বাংলাদেশ সেকশানে আমার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক থ্রেডগুলো পড়তে শুরু করেছে। দাওয়াত দিয়ে, সিগনেচারে লিংক দিয়ে লোকজনকে পড়াচ্ছি। সেদিনের আলাপে জানলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবসেসড, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে অবসেসড আমি একাই নই।

অপূর্ব সেই লক্ষ্যে কাজ করছেন আরো দুবছর আগে থেকে। ২০০৫ সালে পুরো পর্ণ সাইট হিসেবে যৌবনজ্বালার আবির্ভাব। জমতে থাকে ফোরাম। এক বছর পর অপূর্ব এর সদস্য হন। আস্তে আস্তে জায়গা করে নেন ওপরের দিকে।

মালিকানা বদলে যায় যৌবনজ্বালার। অপূর্ব হয়ে যান এডমিনদের একজন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রয়োজন সমমনা সঙ্গীর। নজর দেন সেদিকে। একইসঙ্গে বদলে দিতে থাকেন খোল-নলচে।

এডাল্ট মানেই পর্ণো নয়- ভুত মামার সিগনাচারের কথাটাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য এগোতে থাকেন। সেই ইফতার পার্টিতেই আসে ঘোষণা- ডিসেম্বরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে যাচ্ছে যৌবনজ্বালা। ঘোষণা দিলেই হয় না। প্রয়োজন হয় বাস্তবায়নের। সেটব্যাকগুলোও দেখার আছে।

সাইটের নামটার মধ্যেই কামজ একটা গন্ধ লুকিয়ে। মাঠে নামলে হয়তো উল্টো নিগৃহীত হতে হবে। ভোটের অধিকারের দাবিতে নামা পতিতাদের মতো। শুনে অপূর্ব হাসেন। এই লোক দাবা খেললে বাংলাদেশে আরেকটা গ্রান্ডমাস্টার বাড়তো।

সব কিছুই নিখুঁত, ছকবাঁধা। বলেন- অস্থির হইয়েন না মামা। দেখতে থাকেন। নভেম্বরের শেষ দিকে মৃত্যু হলো যৌবনজ্বালার। নতুন নাম যৌবনযাত্রা।

নাম না হয় বদলালো, কিন্তু ভিতরে তো সেই একই জিনিস। উহু, ভুল করছেন। যৌবনযাত্রায় যোগ হয়েছে ফ্যামিলি ফিল্টার। যে কেউ যৌবনযাত্রায় সদস্য হলে যে ফোরাম পাবে তার কোথাও কোনো রগরগে কিছুর ছিটেফোটাও নেই। এটা পরিবারের সবাইকে নিয়ে ব্যবহার করার ফোরাম।

তবে অপশন আছে। আপনি যদি এডাল্ট কনটেন্ট দেখতে চান তাহলে ইউজার প্যানেল দিয়ে রেড লাইট এরিয়ায় প্রবেশ করতে পারবেন। সেজন্য আপনার বয়স আঠারোর ওপর হতে হবে। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে যৌবনযাত্রা ঘোষণা দিয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মাঠে নামার। ব্যানার এসেছে- নির্লজ্জ বিজয়ের আনন্দ করতে আসিনি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইতে এসেছি।

আপাত লক্ষ্য সদস্যদের কাছ থেকে এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে সাক্ষর সংগ্রহের। এই অভিযাত্রায় সঙ্গী হওয়ার শপথনামা। সাড়া পড়ছে, পড়েছে। দেশ-বিদেশের সদস্যদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ঢাকার দায়িত্ব নিয়েছি আমি, যার মোটিভেশন নিয়ে সন্দেহ নেই কারো।

বেলজিয়াম থেকে ফোন আসে। মামা, একটা কথা কন খালি। আপনি কি মনে করেন, আসলেই কি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব? উত্তর দিই, না মামা। সম্ভব না। সেই জন্য বিশাল এক ভাঙ্গচুর দরকার।

আমরা বড়জোর তারা যুদ্ধাপরাধী না, এই বয়ানটা বন্ধ কইরা ইতিহাসে তাদের সত্যিকার জায়গাটা নির্ধারণ কইরা দিতারি। বর্তমান প্রজন্ম রাষ্ট্রীয় কারণেই এই ব্যাপারটা নিয়া বিভ্রান্তিতে আছে। ওই পাশ থেকে উত্তর আসে- ঠিকই কইছেন মামা। আমি ক্লাশ ফাইভে মুক্তিযুদ্ধের যেই ইতিহাস পড়ছি, ক্লাস এইটের বইয়ে তার উল্টাটা লেখা। কোনটা বিশ্বাস করি কন! কাল উচ্ছ্বসিত হয়ে আলাপ করছিলাম ঘনিষ্ঠ একজনের সঙ্গে।

এইসব স্বাক্ষর-টাক্ষর দিয়ে কিছুই হবে না। এইগুলান ব্যাকডেটেড ব্যাপার। যুক্তি দিয়ে বোঝালেন তিনি। তর্কে গেলাম না। আমার মনের কোণ আত্মবিশ্বাস- উদ্ধত যৌবন পারে না এমন কিছু নেই।

এই বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে মায়ের কোল ছেড়ে আসা একদল দেশপাগলা দামাল ছেলে। তাদের অসমাপ্ত কাজটা আরেকদল করতে পারবে না? আমাদের প্রজন্মে না হোক অন্য প্রজন্মে! বাঘ মামাকে ধরি- কি হইবো মিয়া এইসব সিগনাচার নিয়া? ইয়াহু মেসেঞ্জারের অক্ষরগুলো যেনো বলিষ্ঠ শব্দে অনুদিত হয়। আমি স্পষ্ট শুনি- আদালতে যামু মামা। আর কাউরে না পাই আমি একাই যামু। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না কইরা আমার শান্তি নাই।

সেখানে বলি না। এখানে বলি। টুপি খুইল্যা সালাম মামা। সঙ্গে আছি। এক্কেরে শেষ পর্যন্ত সঙ্গে আছি।

নিশ্চিত থাকেন, আপনে একা না, ইনশাল্লাহ এই মিছিল অনেক লম্বা হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।