আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভা স্ক র্য অহেতুক বিতর্ক

ইমরোজ

নিতান্তই বিরক্ত করতে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এই কড়া রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরে কিছু করার নাই দেখে ভাবলাম দেশের কতিপয় মুর্খ এবং ধর্মান্ধ লোকের উপকারে আসতে পারে এমন একটি লেখা লিখব। ই স লা ম ও ভা স্ক র্য ভাস্কর্য সম্পর্কে ইসলামের ধর্মীয় নির্দেশ কী এরকম প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। তার কারণ হলো, ভাস্কর্য কোন ধর্মীয় বিষয় নয়। যা ধর্মীয় বিষয় নয় তার মধ্যে ধর্ম খুজে বেড়ানোটাই মৌলবাদী।

ধর্মীয় রীতিনীতি দ্বারা আসলে সব যুগের মানুষকে সমান ভাবেও বিচার করা যায় না। ধর্ম শাস্ত্র এবং ধর্মীয় রীতিনীতি দ্বারা শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার ব্যাবহারই বিচার্য। বিমানে চরে হজ্ব যাত্রা করা জায়েজ নাকি না জায়েজ সেটার উত্তর কুর-আন হাদীসে পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশে দীর্ঘদিন বিতর্ক হয়েছে হজ্বে যাওয়ার জন্য ছবি তোলা জায়েজ হবে কী না। অথচ কালের বিবর্তনে এই ছবি তোলার ব্যাপারটিও ধর্মের মধ্যে অন্তর্গত হয়ে গেছে।

ধর্মীয় কাজ অর্থাৎ হজ্বে গমনাগমন সমস্তই এখন ছবির উপরে গতিশীল। তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন যুগের দাবীতে ধর্ম কতটা অসহায়! সারা পৃথিবীতে যখন ভাস্কর্য একটি শিল্প কর্ম। সারা পৃথিবীতে যখন মানুষের মনন ও সৃষ্টিশীলতার জন্য ভাস্কর্যকে স্থান দেওয়া হচ্ছে এমন একটি সময় ইসলামের সাথে ভাস্কর্যের বিতর্কটা অনেকটা হাস্যকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার কারণ ভাস্কর্য বানানোর পেছনে পূজা করার কোন দৃষ্টিকোণ নেই। শিল্পকর্ম হিসেবে ভাস্কর্য নির্মাণ এবং ধর্ম হিসেবে মূর্তিপূজা বা মূর্তির ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাস এক জিনিস নয়, এটা বিবেচনায় না নিয়ে আধুনিক সভ্যতা বোঝা সম্ভব নয়।

ইসলামের মূল বক্তব্য হচ্ছে একত্ববাদ। অর্থাৎ এক সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করা। কিন্তু প্রাচীন-কালে মানুষ ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী। তারা নিজেদের গোত্র নিয়ে আলাদা থাকতে পছন্দ করত। নিজের গোত্র এর একটি মূর্তি বানিয়ে তারা মনে করতো এই দেবতার থেকে শ্রেষ্ঠ দেবতা আর নাই।

এইভাবে মানুষে মানুষে রেশারেশি হত। বিদ্বেষ হত, কলহ বিবাদ লেগে থাকত। কিন্তু ইসলাম যখন একত্ববাদ কবুল করতে বলল তখন মানুষে মানুষে গোত্রভেদ থাকল না। বলা যায় ইসলাম একটা স্থায়ী বিশ্বাসের সূচনা করে। ইসলাম মানুষকে বিস্তর এক বিশ্বাসের ভেতর নিয়ে আসে।

তাদেরকে কলহ দ্বন্দ থেকে মুক্ত দেবার চেষ্টা করে। এখন যদি কোন গোত্র এক আল্লাহর সাথে তাদের কোন দেবতাকে শরীক করে নিজেদের ভাবমূর্তির উন্নতি করে? তাই ইসলামে সমস্ত রকমের শীরককে হারাম ঘোষণা করা হল। মহানবী (স.) এর জন্ম মক্কার কুরাইশ বংশে। সেই বংশের লোকেরা মক্কা শরীফে মূর্তি স্থাপন করেছিল ৩৬০টি। এই ৩৬০টি মূর্তি স্থাপন করা একদিনের ব্যাপার না।

অনেক বছর এতে ব্যয় হয়। নব্যুয়াত প্রাপ্তির পর মহানবী(স.) এই মূর্তিগুলো ভাঙ্গার কোন নির্দেশ দেননি। তবে সেগুলো সরিয়ে ফেলতে বলেন। কাবা শরীফের ভেতর থেকে সমস্ত মূর্তি সরানো হলো কিন্তু ভাঙ্গা হল না। ভাঙ্গা হয়েছিল পরবর্তীকালে।

আমরা যদি ইসলাম ধর্মের উত্তরাধিকারের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো, ইসলাম ধর্মের বরাত দিয়েই মুসলিম সমাজ কোরাইশ বংশকে নেতৃত্বের আসনে বসায়, যারা শুধু মূর্তি পূজারিই ছিল না, তারা শত শত বছর ধরে কাবা শরীফকে মূর্তি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবটা আসলে মূর্তি ভাঙ্গার বিপ্লব নয়। ইসলাম কখনও মূর্তি বানানো অথবা সাজানোকে নিষেধ করে নাই। তবে মূর্তি পূজাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তার কারণ হলো, মুর্তিপূজা মানুষকে একত্ববাদের সত্য থেকে বিচলিত করে।

যা ইসলামের মূল আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। আমাদের মওলানা আর আলেমদের আসলেই এইসব বিষয়ে ভাবা উচিৎ। আগপাছ না ভেবে একটা ফতোয়া জারি করা বোকামি করা ছাড়া আর কিছুই না। ভাবা উচিৎ আজ এইসব অন্ধবিশ্বাস আর মোহাবিষ্টতা তৈরীর ক্ষেত্রে একটা ভাস্কর্যের অবদান কতটুকুই হতে পারে। মুসলিম সমাজের বর্তমান অধঃপতনের কারণ নিজেদের মনন ও সৃষ্টিশীলতার অভাব।

মূর্তির প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ওঠার প্রবণতা মুসলিম সমাজ়ে নেই। ইসলাম ধর্মে মুর্তির বিরোধীতা করা হয়েছে কারণ তখনকার দিনে মানুষ মূর্তি বানিয়ে পূজা করত। তাদের মূর্তি বানানোর উদ্দেশ্যই ছিল উপসনা করা। কিন্তু সেই প্রেক্ষাপট তো আজকে নেই। আ মা র যা ব লা র দেখুন পৃথিবীর মানুষ আসলে অনেক দূর চলে গেছে।

আমেরিকা ইউরোপের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শৈল্পিক, বৈজ্ঞানিক মনন সমস্তই আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে। আর আমরা দিনকে দিন এমন এমন জিনিস নিয়ে উঠে পরে লাগছি যার কোন সামাজিক মূল্যই নাই। যার কোন ফল পাওয়া যাবে না। একটি মানব মূর্তি দেখলে আমার অনুভূতিটা কী হয়? আমি তখন সেই মূর্তিটার কথা চিন্তা করে একবার হলেও সে লোকটার কথা চিন্তা করি। একবার হলেও ভাবি তার পার্সোনালিটির কথা।

গুলশান দুইয়ের মোরে সেদিন একটা অদ্ভূত ব্যাপার ঘটলো। সেখানে একটা স্থাপনায় লেখা ছিল, "আমি দুর্বার আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমার...আমি অনিয়ম উশৃঙ্খল"। আমি জিনিসটা লক্ষ্য করে নজরুলের ব্যাক্তিত্ব আমাকে নাড়া দিল। নজরুলের সৃষ্টি আমাকে মুগ্ধ করল। সেই স্তম্ভ খানা নিয়ে বাসায় এসে বললাম, "যে কম্পানি এই স্তম্ভ বানিয়েছে তাদের রুচি আছে বলতে হয়, জ্যামে পড়ে এই কবিতাটা না পড়লে হয়তো সেদিন আমার আরও কষ্টে যেতে পারত"।

এইটাই হলো শিল্পের চরিত্র। শিল্প মানুষের ভেতরের ব্যাপার। মানুষের অনুভূতির ব্যাপার। এই জিনিসটা অনুভূতিহীন কঙ্কালের জন্য নয়। শিল্প সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আবস্ট্রাক্ট একটি সঙ্গা বহন করে।

তেমন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন হঠাৎ একটা স্কুলের মাঠে, অথবা একটা সরকারী অফিসের সামনে শহীদ মিনারের প্রতিকৃতি আমার চোখে পরে, প্রথমেই বাঙ্গালী হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে নয়। নিজেকে সব থেকে উচু স্থানে আসিন বলে ভাবী। ভাবি ভাষা শহীদদের কথা। এখন যদি ঐ স্তম্ভটা সেখানে না থাকতো তাহলে আমি কী সেই অনুভূতিটা পেতাম? আনাচে জানাচে নাম না জানা হাজার হাজার মানুষের মনে কী উকি মারত অহরহ স্তম্ভের প্রতিবিম্বে লুকিয়ে থাকা ভাষা শহীদদের রক্তাক্ত প্রাণ? থাকত না। লালনকে কে না চিনে।

কিন্তু একটি শিশু তো দেখে দেখেই শিখে। সে যদি লালনের বিশালাকার মূর্তিটি দেখত তাহলে, সে লালনের প্রতি আকৃষ্ট হত। লালনকে জানার চেষ্টা করত। লালন দেখতে কেমন ছিল সেটাও এক দেখাতেই বলতে পারত। কিন্তু আমরা তো শিখার এই পথটাই বন্ধ করে দিচ্ছি।

আর শিখবে কোত্থেকে? লেখাটির প্রথম অংশ "ইসলাম ও ভাস্কর্য" মওলানা হোসেন আলীর "ভাস্কর্য প্রসঙ্গে মুসলিম সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কী" শীর্ষক প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে, যা "যায়যায়দিন" পত্রিকায় ৩০ শে অক্টোবর ২০০৮-এ প্রকাশিত হয়

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।