আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাঁচ পয়সার দাম নাই

বলবার আছে অনেককিছুই। কাউকেই বলিনি। আজ বলবো বলে খুলে নিয়ে বসেছি স্মৃতির ঝাঁপি।

ভুমিকার বদলে... ছুটির এক দুপুর বেলা। খেয়েদেয়ে ঘুমাবো বলে শুয়েছি।

কিন্তু ঘুম আর আসে না। আসে না তো আসেই না। হঠাৎ মঞ্জু ভাইয়ের মুখখানি ভেসে আসে মনে। কোনো কারণ ছাড়াই। আমাদের স্কুল মাঠের একপাশে মঞ্জু ভাইয়ের চায়ের দোকান ছিল।

ছোটবেলা থেকেই দোকানটি দেখে আসছি আমরা। এখনো ঢাকা থেকে বাড়ি গেলে দেখি মঞ্জু ভাই আপন মনে চা বানিয়ে যাচ্ছে। দোকানটি ঠিক আগের মতো আছে। কোনো পরিবর্তন নেই। না মঞ্জু ভাইয়ের জীবনে, না দোকানের চেহারা সুরতে।

এ রকম হাজারো মঞ্জু ভাই আছে আমাদের চারপাশে। কত সরকার যায় আসে, মঞ্জু ভাইদের জীবনে কিছু যায় আসে না। এক অদ্ভুত আধাঁরে কেটে যায় তাদের জীবন। বয়স কত হলো? -- পঁচিশ। স্মৃতিতে যে কয় বছরের কথা মনে পড়ে আর কি মানে যখন থেকে জ্ঞান হয়েছে- মঞ্জু ভাইয়ের চায়ের দোকানটা তেমনই দেখি এসেছি।

একসময় মঞ্জু ভাইয়ের দোকানের সামনে পায়ে হাঁটা রাস্তাটাই ছিল। গায়ের লোক সে পথ ভেঙ্গে তার দোকানে এসে চা খেত। আর রাজা উজির মারতো। এখনতো পাকা রাস্তা হয়েছে। হর্ন বাজিয়ে গাড়ি চলে।

টুং টাং ঘন্টা বাজিয়ে চলে যায় ব্যস্ত ভ্যান, রিক্সা। তখন আমাদের বয়স কত? প্রাইমারি স্কুলে পড়ি আমরা। মাঠের একপাশে আমাদের স্কুল। আর এক দৌড়ে মাঠ পেরুলেই মঞ্জু ভাইয়ের চায়ের দোকান। তবে বেলা বিস্কুটের লোভে এক দৌড়ে মাঠ পেরুলেই মঞ্জু ভাইয়ের চায়ের দোকানে আসা আমাদের বারণ।

কারণ চায়ের দোকানে মুরুব্বিদের আড্ডা। কখন কে যে ডেকে বাপের নাম জিজ্ঞেস করে বসে। সাথে পড়াশোনার খোঁজখবর। পড়াশোনায় তো লবডঙ্কা! তাই ও পথ মাড়াই না আমরা। বরং দুপুরে বৃষ্টি নামলে পরে আমরা তিন নম্বর বল নিয়ে মাঠে নেমে যাই।

বৃষ্টিতে ভিজি আর ফুটবল খেলি। খেলতে খেলতে আমরা বড় হই। বাটাল আর গুল্লি নিয়ে বক মারতে যাই ধানী বিলে। হুরাসাগরের পাড়ে। আর পটাপট ক্লাস ডিঙিয়ে উঁচু ক্লাসে উঠি।

তখন আমাদের বয়স বেড়ে যায়। আমরা লাটিম, মার্বেল, ডাংগুলি ছেড়ে সিনেমা দেখতে শিখি থানা সদরের সিনেমা হলে গিয়ে। সালমান শাহ তখন হালের ক্রেজ। আমরা তার স্টাইলে চুল কাটতে বাজারে জীবনদার সেলুনে যাই। জীবন দা তার নিপুণ হাতে কেচিঁর কিমির মিচির শব্দ তুলে আমাদের চুলের স্টাইল করে দেন।

সেই স্টাইল নিয়ে আমরা মঞ্জু ভাইয়ের চায়ের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে আসি। প্রাইমারি স্কুলে দেখা আমাদের মঞ্জু ভাই অবিকল সে ভাবেই আমাদের এক ঝটকায় দেখে নেন চুলের স্টাইলসুদ্ধ। তারপর আবার কাজে মনোনিবেশ করেন। আর তার ভেতর কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করি না। মঞ্জু ভাই তেমনই থেকে যান।

আর আমাদের বয়স বাড়ে। আর প্রতিদিন চা খেতে খেতে দক্ষিণ পাড়ার বাবু ব্যাপারির কপাল খুলে যায়। বাড়িতে টিনের ঘর উঠে গোটা তিনেক। দুপুর বেলা সূর্যমামা যখন তার টিনের চালে পড়ে তখন তার আলোর ঝটকায় আশপাশ ঝকমক করে উঠে। কিন্তু মঞ্জু ভাইয়ের চায়ের দোকান আধাঁর থেকে আধাঁরতর হয়।

চায়ের দোকানের কালি ঝুলি তার কপালের লিখন হয়ে যায়। অহর্নিশি সে কপালে ভর করে হতাশা, জীবনযাপনের ব্যর্থ কৌতুক। আর যৌতুকের অভাবে বিয়ে আটকে যায় তার বড় মেয়ের। মেয়েটির বিয়ের বয়স পেরিয়ে যেতে থাকে। আর হাই স্কুলে আসা যাওয়ার পথে আমরা তাকে আইবুড়ি বলে ডাকি।

মেয়েটা আঁচলের নিচে হতাশা লুকায়। হতাশা আমাদেরও ঘিরে ধরে। কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি প্রেম করে বসে বাংলার স্যারকে। সাইকেল চালিয়ে কলেজে গিয়ে আমরা যারা সুন্দরীটিকে এক ঝলক দেখে চাঙ্গা হয়ে উঠতাম তারা ব্যর্থতায় মুষড়ে পড়ি। বিকেলে কলেজ থেকে ফিরে মঞ্জু ভাইয়ের চায়ের দোকানে বসে আমরা সে প্রেমের ইতিবৃত্ত রচনা করে ফেলি।

তখন আমরা লাইলী মজনু, শিরি ফরহাদ, রোমিও জুলিয়েট সবাইকে এক নিমিষেই চিনে ফেলি। চিনে ফেলি বিবাহিত জীবনের গোপন অজস্র গল্প। আমরা হঠাৎ বড় হয়ে উঠি। কিন্তু আমাদের মঞ্জু ভাই ঠিক তেমনই থেকে যায়, যেমনটি স্কুলে পড়ার সময় দেখেছি। আর চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আমরা দিন বদলের স্বপ্ন দেখি।

আমাদের তখন রক্তে আগুন। আর চোখে দিন বদলের স্বপ্ন। স্বপ্ন আর আগুন মিলে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে যায়। মারা যায় আমাদের এক বন্ধু প্রতিপক্ষের হাতে। এরপর আমরা বহুকাল গ্রাম ছাড়া হই।

আমাদের চোখের সামনে থেকে হারিয়ে যায় সবুজ দিগন্ত। একরাশ ধুসর হতাশা ভর করে চোখের পাতায়। এরপর বর্ষা নামে। নদীর তোড় বাড়ে। পতনের শব্দ শুনি প্রতিদিন।

একদিন শুনি ওয়াপদা বাঁধের ওপারের গ্রামটির অর্ধেক ভেঙ্গে গেছে। পতন আসে আমাদের বিশ্বাসেও। আমরা নিয়তি মেনে নিয়ে পুঁজির দাসত্ব স্বীকার করি। পুঁজির দাসত্বের সাথে সাথে আমাদের কারো কারো ভাগ্য ফেরে। ঢাকা থেকে লেক্সাস গাড়ি চেপে আমরা কেউ কেউ বাড়ি ফিরি ঈদে, উৎসবে।

অভ্যাসমতো বিকেলে মাঠের পাশে অবিকল আগের চেহারার মঞ্জু ভাইয়ের চায়ের দোকানে যাই। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলি কর্পোরেট কালচার আর মেট্রো জীবনের ব্যস্ত গল্প। মঞ্জু ভাই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুনেন আর একলাফে বয়স বেড়ে বুড়ো হয়ে যান। ফলে চায়ের ইন্তেজামে একটু স্থবিরতা আসে। ঢাকা ফেরত ভাগ্য ফেরানো আমাদের কেউ মঞ্জুর দোকানে চায়ের সাথে কেন কফি পাওয়া যায় না তা নিয়ে আফসোস করে।

দু'চারটা কথা শুনিয়েও দেয়। আর মঞ্জু ভাই হয়তো মনে মনে ভাবে, চায়ের দোকানে কফি পেতে হলে দোকানদারের অবস্থার উন্নতি হতে হয়। আমি তো শালার দু'টাকার চায়ের দোকানদারই রয়ে গেলাম। কিন্তু মঞ্জু ভাই এ টুকুও বলতে পারে না। অথবা মঞ্জু ভাই হয়তো জানে একজন চায়ের দোকানদারের কথার পাঁচ পয়সার দাম নেই।

এজন্য মঞ্জু ভাইকে কখনো কিছু বলতে শুনিনি। হয়তো কোনো কালেও বলতে শুনবো না।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।