আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই চোখে তাকিও না আমি লুটপাট হয়ে যাবো-

অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা

ট্রাফিক জ্যাম ম্যানেজমেন্ট প্রয়োজন ঢাকা শহরে, অলস টাকাকে সচল করবার জন্য প্রতিটা ব্যংকই গাড়ী কেনার ঋণ দিচ্ছে সহজ শর্তে, ঢাকা শহরের রাস্তা প্রাইভেট কারাচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছে। যেকোনো সময়েই অস্থির অপেক্ষা করতে হয় রাস্তায় নামলে। কাজ শেষ করে যখন জেলখানা থেকে বাইরে আসলাম ক্ষুধার্ত চোখে সবকিছুই খাদ্য। পরিচিত এলাকায় গিয়ে চা সিগারেট কয়েক দফা, এরপরে ফিরতি রাস্তায় বাসা, এমনটাই নিয়মিত রুটিন। সেই রুটিন মেনেই চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকি।

ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সুতরাং সেখানের বাহারী ছাত্র-ছাত্রীদের সব এলাকায় বসে আড্ডা দিতে দেখি। যারা সুন্দরী, তারা নিজের সৈন্দর্য্যসচেতন হয়ে উঠলে সব সময়ই দৃষ্টির প্রসাদ চায়। সব সময়ই তাদের দিকে দৃষ্টি পরুক এই দাবিটাকে আমি অগ্রাহ্য করতে চাই না। সুন্দরী দেখলেই আমি তাকিয়ে থাকি, অন্তত যতটুকু সময় তাকালে হ্যাংলামি প্রকাশ পায় না ঠিক ততটুকু সময় দৃষ্টি দিয়ে ছুঁয়ে দিতে সমস্যা নেই কোনো। লেকের পাশে নীল জামাআবৃত মেয়েটার সাথে কয়েক পলকের চোখাচোখি হয়ে যাওয়ার পরে বিষয়টা আনন্দজনক অনুভুতি হয়ে থাকলো না।

নিজেদের কথার ভেতরে মগ্ন থাকলেও একাডেমিক লেকচার নয় এটা। সুতরাং শ্রোতার দিকে তাকিয়ে, আশেপাশে তাকিয়ে কথা চলে, যতবার মেয়েটার দিকে চোখ পড়ে মেয়েটাও তাকিয়ে থাকে। আমি তেমন লাবন্যময় আকর্ষক নই বলেই বিব্রতবোধ করি মনে মনে। নিশ্চিত কোনো একটা ভজঘট পাকিয়ে বসে আছি। উর্ধাঙ্গে তেমন ভজঘট পাকাবার উপায় নেই, পড়েছি ফতুয়া।

সুতরাং যুগের রীতি মেনেই ছোটো ফতুয়ার নীচের কোনো জায়গায় সমস্যা? যদি তাই হয় তবে সেটা যাচাই করবার কোনো পরিস্থিতি এখানে নেই। ভাই এরপরে কি কোনো কাজ আছে? ক্ষিধা লাগছে, খাওয়াটাই কাজ। যদি খাওয়া পাই তাহলে বাসায় যাবো না। সুতরাং জোরপূর্বক একটা খাওয়ার দাওয়াত অর্জিত হয়ে যায়। ফখরুদ্দীনের নাম শুনেছি, তবে তার দোকানে গিয়ে খাওয়া হয় নি।

খেতে যখন হবেই তখন সস্তায় খেয়ে ফেলা ভালো। ফখরুদ্দীনের দোকান জিগাতলা মোড় থেকে সামান্য একটু আগালে, সাবেক ১৫ নম্বরের আশেপাশে কোথাও। ঠিক তার পাশেই কড়াই গোস্ত। খাওয়া খারাপ না, অন্তত একটা বিষয় নিশ্চিত এখানের বিরিয়ানীতে অহেতুক তেলাধিক্য নেই। ঝরঝরে কাচ্চি আর প্রচুর পানি শেষ করে কাজ খুঁজি।

পেটের আগুণ নিভেছে, এখন জোসিলা একটা চা আর সাথে একটা সিগারেট হলে দিনটাই পরিপূর্ণ হয়ে যায়। বন্ধুকে ফোন দিলাম, ঠিক অত্র এলাকায় কোথায় ভালো মানের চা পাওয়া যাবে। সন্ধান মিললো, স্টারে, সেখানে যাওয়ার আগ্রহ নেই, বিকল্প হলো ফখরুদ্দীনের উল্টো পাশেই- দুই ভাই মিলে যাই সেই দোকানে, লাঞ্চ টাইমে সেখানে চা হয় না সম্ভবত। সুতরাং অর্ধেক পরিপূর্ণতার চেষ্টা। খাওয়া শেষ, সিগারেটও শেষ, এরপরে ধুমিয়ে আড্ডা দেওয়া ছাড়া কোনো কাজ অবশিষ্ট নেই।

আড্ডার সাম্ভাব্য জায়গা কোনটা হতে পারে? কাছেই ক্যাম্পাস, সেখানে গিয়েই আড্ডা পিটানো যাবে। একটা রিকশা চেপে ক্যাম্পাসে রওনার দেওয়ার পরেই মনটা উৎফুল্ল হয়ে গেলো। পরিচিত ট্রাফিকের ভীড় নেই, রাস্তা অনেকটা ফাঁকা, ঘড়িতে বাজে ৩টা ২৫। এই সময়টাতে এ দিকটা এমন ফাঁকা থাকে না, তবে আজকে দিনটা ভিন্ন রকম। নিউমার্কেট পার হওয়ার পরে বুঝলাম বিশ্ববিদ্যালয় অনেকটা নিঝুম।

ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাগুলোর ভেতরে আমার পছন্দ ক্যাম্পাস, পরিচ্ছন্ন রাস্তা, দু পাশে ঘন সবুজ গাছ। অনেক দিন পর বাতাসে গাছেদের গন্ধ পেয়ে মনটাই ভালো হয়ে গেলো। কোথাও ছাতিম ফুটেছে। ছাতিমের গন্ধ আমার ভালো লাগে। বরং বলা ভালো মাদকতাময় গন্ধ ছাতিম ফুলের।

রেইনট্রির মাথায় সব সময়ই ফুলের কেশর মেলাই থাকে, তবে অনেক রকম পাতার গন্ধ এক সাথে বাতাসে ভেসে আছে এমন দিন কমই আসে ক্যাম্পাসে। চমৎকার শান্ত ক্যাম্পাসে বসে আড্ডা দিয়ে যখন বাসার পথে রওনা দিলাম তখনও মনটা ফুরফুরে। টিএসসির সামনেও ছাতিমের গাঢ় গন্ধ। বাংলা একাডেমির সামনেও একই রকম গাঢ় ছাতিমের গন্ধ। এখানের ছাতিম গাছগুলো আমার চেনা, তবে শিশু একাডেমীর সামনের ছাতিমের গন্ধ শুঁকে শুঁকে খুঁজে দেখলাম সেখানের গেটের পাশেই একটা ছাতিম গাছ।

রিকশাওয়ালা ঢাকা শহর চেনে না, গতকালই এসেছে ঢাকায়, সুতরাং তাকে পথ চিনিয়ে বাসায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বও আমার। বেচারা বলেছে ঢাকা শহর চিনতে তার লাগবে ২০ দিন। আমি তার আত্মবিশ্বাস দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দেশটার হলো কি? প্রেসক্লাবের সামনে জ্যাম নেই, সেগুন বাগিচার সামনে জ্যাম নেই, জ্যাম নেই দুদকের সামনে, রাজমনির সামনে তেমন জ্যাম নেই। অন্তত আমার জন্য তো নয়ই।

আমার রিকশা সোজা সিগন্যাল পেরিয়ে চলে যাচ্ছে সামনে। কায়দা করে সিগারেট ধরাতে পারলে ভালো হতো। সেটা সম্ভব না। মূলত ট্রাফিকের পাকনামিতে একটা ভজঘট পাকিয়ে গেছে, চার পাশের গাড়ীই নেমে এসেছে রাস্তায়। সুতরাং অপরিহার্য জ্যাম লাগতে যাচ্ছে।

নতুন ঢাকা শহর হলেও আমার রিকশাওয়ালা নিশ্চিত ভাবেই ফর্মূলা ওয়ান ড্রাইভারের রক্ত নিয়েছে কোনো এক সময়। তার ভেতরেও একই রকম গতির নেশা। ভাঙাচোরা রাস্তায় যখন গর্তের উপর দিয়ে লাফিয়ে পার হয়ে রিকশা নিয়ে তখন আমি রিকশার সীটে বসে নানান কসরত করে নিজের ভারসাম্য ঠিক রাখি। এবারও সামনের অগ্রগামী মাইক্রোবাসটিকে হেলায় হাত দিয়ে ঠেলে অন্য দিকের রাস্তা দেখিয়ে রিকশার সামনের চাকা ঢুকিয়ে দিলো মাইক্রোবাসের সামনে। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মুখ বের করে কিছু গালি দিচ্ছিলো হয়তো, তবে এইসবকে পাত্তা দেয় না আমার ড্রাইভার।

কর্নফুলীর সামনের সার্কিট হাউজ রোড দিয়ে যাবো। সেখানে সব সময়ই সামান্য জটলা থাকে। এই জটলায় দেখলাম মেয়েটাকে। শাদা ফুলপ্রিন্ট জামা পড়ে আছে। উজ্জল বর্ণ, তীক্ষ্ণ ভ্রু, হাতে কালো একটা ব্যাগে কিছু একটা খুঁজছে।

আমার রিকশা ঠিক ৪ হাত দুরে আটকে আছে জ্যামে। মেয়েটা খুব বেশী লম্বা না, হয়তো ৫ ফুট ২ হবে, শীর্ণও নয় আবার পৃথুলাও নয়, সাদা ওড়নায় সাদা ফুল। রিকশা নড়লেই হারিয়ে যাবে মেয়েটা, হঠাৎ করেই মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো। বোধ হয় দৃষ্টিরও স্পর্শ্ব থাকে, আমার বুকটা ধরাস করে উঠলো। হৃদপিন্ডের ধুকপুক আর বিব্রত চেহারা নিয়ে আমি মুখ ফিরিয়ে ভাবতে থাকি এমন বুকের তরাস অনেক দিন অনুভব করি না, কৈশোরলগ্নে স্কুলগামী প্রেমিকাকে রাস্তায় দেখলে অন্তর্গত লজ্জায় মাটি খুঁড়ে লুকিয়ে পড়বার ইচ্ছা হতো।

ভরপেট পানি এরপরও তৃষ্ণায় খাঁখাঁ করতো বুকটা। আর অনিয়ন্ত্রিত হৃদস্পন্দনের ধাক্কা বুঝতে পারতাম ধমনীতে। কোনো মতে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, প্রথম ভালোলাগার অনেক অনুভবই আড়ালে পড়ে যায়। এমন স্থির হয়ে যাওয়া সময়, স্লো মোশান মুভির মতোই স্কুলের নীল পোশাক এগিয়ে আসতো, আমি চোখের কোনে নীল আভা দেখতাম আর প্রার্থনা করতাম এই বিহ্বল ভালোবাসার বোকামি যেনো কোনো ভাবেই চেহারায় ফুটে না উঠে। তবে পরিস্থিতি যেমনই হোক, বান্ধবীদের সাথে যেতে যেতে ঠিকই আড় চোখে একবার দেখে যেতো, আমি তখন হয়তো চোখ তুলে তাকিয়েছি সদ্য, আর ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় কলজে গলায় আটকে যেতো।

স্পষ্ট চোখ আমার ভালো লাগে, প্রশ্নবিহীন নিঃসংশয় স্পষ্ট চোখের প্রেমে পড়েছি অনেক দিন। আজকের তাকানোও তেমনই স্পষ্ট তাকানো, ভেতরে সংকোচ নেই। বরং একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের দিকে যেভাবে তাকায়, যেভাবে কিছু খুঁজে চোখের ভেতরে তেমনই গভীর তাকানো দেখে হৃদপিন্ড ধরাস করে উঠলো অনেক দিন পরে। আমি অবশিষ্ট রাস্তা সেই চোখে আবিষ্ট হয়েই ঘরে ফিরলাম। এইসব পথচলতি ভালোলাগার স্থায়িত্ব হয়তো ১ দিন।

এরপরে আর কোনো দিন দেখা হবে না তার সাথে, তবে হঠাৎ হঠাৎই সেই দৃষ্টির অসংকোচ তাকিয়ে থাকবার স্মৃতি নিয়ে মশগুল আছি। ভেতরে গান বাজছে এই চোখে তাকিও না আমি লুটপাট হয়ে যাবো।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।