আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গলা ছেড়ে বলতে চাই

পাখি এক্সপ্রেস

আগামী নির্বাচনে কোন সরকার ক্ষমতায় আসবে, কয়টি জোট মহাজোট হবে, সরকার গঠনের রূপ কি হবে? এমনতর ভাবনায় নেই মোটেও। সন্তুষ্টি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়ে। আমি বা আমার মতো নাগরিক অভাব, ক্ষুধা, বাসস্থান, শিক্ষা অথবা চিকিৎসা নিয়ে সংকটকে নিয়তি মেনে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়ি মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে। আমার তিনবেলা খাবার কিনতে টাকার দরকার, বাসস্থানসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদা পূরণেও টাকার দরকার। অথচ আমি নির্লজ্জভাবেই দরিদ্র।

তবুও কিছু একটা আঁকড়ে ধরে এ দেশের নাগরিকত্ব উপভোগ করার অভিপ্রায় আমারও থাকতে পারে। আমার এ অভিপ্রায় মোটেও অনৈতিক বা অবৈধ নয়। উপরন্তু আমি কথা বলতে গেলে মোটা অংকের টাকা ব্যয় হওয়ার শংকাও নেই। তবুও আমি বলতে পারি না। এটি আমার কাছে বিস্ময় ঠেকে বরাবরই।

একজন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের যে কোন বিষয়ে অথবা আমার যে কোন অধিকার আদায়ে বা বিঘœকালে চাহিদানুসারে মতামত প্রদানের অধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু পারলাম আর কই। কয়েক শতাব্দীব্যাপী লড়ে যাওয়ার ঐতিহ্য আজ ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যবহৃত হলেও আমার স্বাধীনতার পূর্ণতা আজও দেখিনি। আমার মতো নাগরিকের স্বাধীনভাবে চলা অথবা স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার ৭১ পূর্ব সময়ে বিদেশী মোড়লদের হাতে ছিলো। আর ৭১ পরবর্তী সময়ে দেশীয় মোড়লদের হাতে।

পরিবর্তন এতটুকুই। কোন দেশের মানুষ ফিস ফিস করে বেশি কথা বলে? এমন প্রশ্নের উপর বিশ্বে কোন জরিপ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। তবে যদি হয় তাহলে জরিপের ফলাফলে বাংলাদেশের নাম নিশ্চিন্তেই অগ্রভাগে থাকবে। এখানে কথা বলার মাঝে সবচে’ বেশি ভয় কাজ করে। সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার এবং বিরোধীদলই মূলত দেশের মা বাপ।

তাদের কৃতকর্মের ওপর দেশের উন্নয়ন নির্ভর করে। এ নির্ভরতায় নাগরিকগণ নিশ্চিন্ত হতে চায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ নিশ্চিন্ত হওয়ার নিশ্চয়তা কতটুকু আছে? যতটুকুই থাকুক না কেন, আমি নিশ্চিন্ত হতে চাই কারণ এটা আমার নাগরিক অধিকার। নিশ্চিন্ত হওয়ার আগে আমি দেখতে পাই, সরকার নামক বটবৃক্ষের ডালপালায় বসে থাকা সরকারি কর্মকর্তা এবং পাশাপাশি সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের শোষন, অনৈতিক, অবৈধ অথবা রাষ্ট্রের পক্ষে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তগুলো। আমি তার প্রতিবাদ করতে চাই।

কারো কাছে একটু মনের দু:খ প্রকাশ করতে চাই। কিন্তু কতটুকুই বা করতে পারি। করতে গিয়ে ডানে বাঁয়ে তাকিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলতে হয় প্রতিবাদের শব্দগুলো বা দু:খের উক্তিগুলো। বিরোধী দলের বিষয়েও একই পরিস্থিতি। এর বাইরে মহল্লার বড়ভাই, গ্রাম্য মোড়ল অথবা ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গ আছেনই।

মানুষ তার যে যে অধিকার শতভাগ ভোগ করতে চায় এবং সে ভোগে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পেতে চায় তার মধ্যে মত প্রকাশের স্বাধীনতা অন্যতম। বর্তমানে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি শুধু উন্নত রাষ্ট্রসমূহে নয় বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও আলোচিত। অবশ্য এ বিষয়টি মানুষের সৃষ্টির পর থেকেই সম্যক আলোচিত। পৃথিবীজুড়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নামক অধিকারটির জন্য মানুষ বরাবরই সোচ্ছার। জাতিসংঘ সনদের ফ্রিডম অব স্পীচ (freedom of speech), ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন (freedom of expression) ইস্যু অথবা টার্মগুলো এ ক্ষেত্রে ব্যাপক আলোচিত।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংবিধানে ফ্রিডম অব থট (freedom of thought) এবং ফ্রিডম অব কনসায়েন্স (freedom of conscience) নামের আলাদা দু’টো টার্মস আছে। বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখিত ফ্রিডম অব স্পীচ বলতে বোঝানো হয়েছে বাক প্রকাশের স্বাধীনতা মানে মৌখিক কথা বলার স্বাধীনতা, ফ্রিডম অব এক্সপ্রেশন বলতে বোঝানো হয়েছে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা। চিন্তার স্বাধীনতা বলতে ফ্রিডম অব থট বোঝানো হয়েছে এবং ফ্রিডম অব কনসায়েন্সকে বিবেকের স্বাধীনতা বোঝানো হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানের ব্যাখ্যা ধরে পাওয়া শব্দগুলোর বিশ্লেষনে বোঝা গেলো একটি মানুষের বাক, ভাব, চিন্তা এবং বিবেকের মাধ্যমেই তার মতের প্রকাশ ঘটে। সুতরাং মত প্রকাশের স্বাধীনতা স্বাভাবিকের চাইতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের মৌলিক বৈশিষ্টগুলোর দিকে তাকালে আমরা সন্তুষ্টচিত্তে দৃষ্টি ফেরাতে পারি না। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা মন্দা, শিক্ষার হার অত্যন্ত কম, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নাজুক, যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভঙ্গুর। তার উপর রয়েছে ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার এবং সর্বোপরি ধর্মীয় মৌলবাদের ভয়ানক বিস্তার। স্বাভাবিকভাবেই বিষয়গুলো আমাদের অপ্রিয়।

তবুও আমাদেরকে এ দেশেই বসবাস করতে হবে। বসবাস করতে চাই এবং তা নূন্যতম একটি অধিকারকে আঁকড়ে ধরে হলেও। আমি খাওয়ার কথা বলতে লজ্জিত, বাসস্থানের কথা বলতে সংকুচিত, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার কথা বলতে শংকিত। কারণ আমাকে দ্রারিদ্র্যতা চুষে খাচ্ছে জোঁকের মতো। তাই আমি নিরখচায় বেঁচে থাকার অবলম্বন হিসেবে আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকেই বেছে নিতে পারি।

যদিও অবস্থাদৃষ্টে আমাকে আশাহত হতে হয়। আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতা কখনো সরকারের হাতে, নয়তোবা বিরোধী দলের হাতে আবার কখনো সামরিক শাসক বা তার স্বরূপের হাতে। আমি পরাধীনতার কথা বলছি এই কারণেই যে, সরকারের সমালোচনা করলে স্থানীয়ভাবেই আমকে দু’চার ঘা খেতে হয়, সরকারের নিজের করে নেয়া প্রশাসনতো আছেই। বিরোধী দলের সমালোচনা করলেও তাই। আর সামরিক শাসকতো সমালোচনা করার আগেই মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়।

এ পরিবেশে আমাকে যদি শান্তিপ্রিয় নাগরিক হতে হয় তবে যাবতীয় নিগৃহতাকে মেনে নিয়ে নিজের মুখে নিজেই স্কচটেপ লাগাতে হয়। কারণ আমি জানি যে আমার দিকে তাক করে আছে অস্ত্র, মাদক, এসিড, ধর্ষন অথবা মানসিক এবং শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার কামানগুলো। আমার সরকার ৫টি মৌলিক চাহিদার দায়ভার নিতে রাজি নয়। তবে সুশাসনের মতো তকমানির্ভর বিষয় কোন পথে ধাবিত হবে। আমি সরকারের অক্ষমতা মেনে নিলাম।

কিন্তু নাগরিক হিসেবে অন্তত একটি সাদৃশ্য অধিকার আদায়ের দাবি আমি করতেই পারি। আগেই বলেছি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি শুধু আলোচিতই নয়, বরং এ স্বাধীনতা আদায়ে পৃথিবীর মানুষেরা বরাবরই সোচ্চার। Universal Declaration of Human Rights এর আর্টিকেল ১৯ এ আছে- Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference and to seek, receive and impart information and ideas through any media and regardless of frontiers. একইভাবে International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR) এর আর্টিকেল ১৯ ও কথাবলার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। “the right to hold opinions without interference. Everyone shall have the right to freedom of expression.” ‘উইদাউট ইন্টারফেয়ারেন্স’ শটি কোন প্রকার বাধাবিপত্তি ছাড়াই মতপ্রকাশের অধিকারটি কার্য্যকর করার দ্বায়িত্ব স্বীকার করে নেয়। এই চুক্তিটি গৃহীত হয় ১৯৬৬ সালে কিন্তু কার্যকর হয় ১৯৭৬ সালের ২৩ মার্চ।

চুক্তির নিয়ম অনুযায়ী যে সকল দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে তারা এটি মানতে বাধ্য। উল্লেখ্য বাংলাদেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। (চীন অবশ্য স্বাক্ষর করেনি) বাংলাদেশের আইনের দিকে তাকালে দেখতে পারি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন হিসাবে স্বীকৃত সংবিধানে এই অধিকারটির কথা বলা আছে। আর্টিকেল ৩৯ এ বলা হয়েছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতা প্রসঙ্গে। আর্টিকেল ৩৯ এ বলা হয়েছে- “Freedom of thought and conscience is guaranteed” “চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইলো” এই অনুচ্ছেদটি সংবিধানের তুতীয় ভাগ মৌলিক অধিকার অংশে রযেছে।

উল্লেখ্য এই অনুচ্ছেদ ৩৯(১) এ কোন রকমের রেস্ট্রিকশনের (বাধানিষেধ) কথা বলা হয় নি। এবার আর্টিকেল ৩৯ (২) এর দিকে লক্ষ্য করি- Subject to any reasonable restrictions imposed by law in the interests of the security of the State, friendly relations with foreign relations with foreign states, public order, desency or morality, or in relation to contempt of court, defamation or incitement to an offence- (a) the right of every citizen to freedom of speech and expression ( b) freedom of press are guaranteed. “রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলতা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানী বা অপরাধ, সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে- (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো। আর্টিকেল ৩৯ (২) তে যে যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধের কথা বলা হয়েছে তা আরো ভালোভাবে বুঝতে হলে লক্ষ্য করতে হবে ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটস, ১৯৪৮ এর আর্টিকেল ২৯(২) এর দিকে- “In the exercise of his rights and freedoms, everyone shall be subject only to such limitations as are determined by law solely for the purpose of securing due recognition and respect for the rights and freedoms of others and of meeting the just requirements of morality, public order and the general welfare in a democratic society.” এই পর্যায়ে দৃঢ়ভাবে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের সংবিধানের মাধ্যমেই চিন্তা, বিবেক, বাক এবং ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র তার নাগরিকদের প্রতি এই অধিকারগুলো দিতে বাধ্য। এখন প্রশ্ন হলো, মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেন প্রয়োজনীয়? আমি মনে করি শাসকগোষ্ঠির জন্য জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করা না গেলে কোনভাবেই একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

যখনই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে যাবো তখনই উম্মুক্ত নাগরিক ভাবনার আওতায় আসতে হবে। আর তখনই প্রয়োজন নাগরিকদের ভাবনাসমূহ বা মতামত প্রকাশের জন্য ভীতিহীন একটি কাঠামো নির্মাণের, যে কাঠামোয় সংশ্লিষ্ট নাগরিক নির্ভয়ে তার মতামত প্রকাশ করতে পারবে। নাগরিকের সে ভাবনা আলোচনা কিংবা সমালোচনা নির্ভর হতে পারে। মিঠে হোক আর তেতোই হোক নাগরিকগণের ভাবনা, দাবি বা পরামর্শসমূহ গ্রহন করার মতো মানসিকতা সরকারের থাকতে হবে। কারণ সরকার প্রণীত সংবিধানই নাগরিক হিসেবে আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতার বৈধতা দেয় এবং সে সুবাধে সরকার আমার সে অধিকার নিশ্চিত করতে বাধ্য।

কৃতজ্ঞতা : একরামুল হক শামীম

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।