আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি যখন টিভি স্টার ছিলাম

সাব্বির ভাইয়ের জন্য আরো দশ লাখ টাকা দরকার। মানবতার দিকে তাকিয়ে আছি।

শুনতে অবাক লাগতে পারে, আমার কুটিকালের প্রিয় টিভি প্রোগ্রাম ছিল সাক্ষাৎকারমূলক অনুষ্ঠান। অতিথি কেম্নে ডাইন পায়ের উপরে বাম পা তুইলা বসে, কেম্নে গলা খাঁকারি দিয়া "না মানে", "আসলে" এইসব দিয়া প্রশ্নের উত্তর শুরু করে এইসব খুব মনুযুগ দিয়া দেখতাম। বুঝতাছি যে পুরা কৃত্রিম ভাব নিয়া প্রশ্নের উত্তর দিতাছে, তবে অনুষ্ঠান শেষ হয়া গেলে সেইটাও নকল করতাম।

দেখতে দেখতে এমনি অভিজ্ঞ হইলাম যে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার ঠিক কোন্দিকে আগাইব, বোঝা তেমন কঠিন হইতনা। টিভি প্রোগ্রাম খায়েশ তো অনেকেরই হয়, তয় আমার খায়েশ হইত জনসমক্ষে এমনে আইসা নানারকম ইতং বিতং প্রশ্নের উত্তর দেয়ার। হুমম, তাইলে তো বিখ্যাত হইতে হইব। ক্ষ্যাত খামারে ভরা মফস্বলে থাকি। প্রতিভা থাকলেও বিকাশের সুযোগ নাই (আহারে প্রতিভা, পপী, অঞ্জু ঘোষ ফেইল )।

তা ধরেন, ইহজীবনে তিনবার চেহারা মোবারক টিভি স্ক্রীনে দেখানোর সুযোগ হইছিল। ২০০২ বা ০৩ মনে লয়। পরানের বান্ধবী এনিলা ইমু-রে নিয়া গেছি সিলেট এমসি কলেজে, পহেলা বৈশাখে। আতকা দেখা সিলেট বন্ধুসভার রিয়াদ আউয়ালের সাথে। হে কইলো, রনি ভাই, চ্যানেল আইয়ের "ইওর চয়েস ওলে ওলে" অনুষ্ঠানের জকি, উনি ক্যম্রা নিয়া ক্যাম্পাসে ঘুরতাছেন।

আমাদের মত সুন্দর মুখের পর্দায় না দেখানোর নাকি কোন কারণই পাওয়া যাইতাছেনা। আমাগো বাসায় কোনকালেই স্যাটেলাইট চ্যানেল ছিলোনা (নাহ, ভুল বললাম। সাকুল্যে তিন্মাসের জন্য ছিলো কোন একবছর)। কোন অনুষ্ঠান এইটাও জানিনা। ওতকিছু ভাবার ইচ্ছাও নাই।

অফার পায়া মনে অইল চরম ব্যস্ত অভিনেত্রী হয়া যাইতাছি শিঘ্রী । উপশহরের এক বাসায় বিকাল নাগাদ শুটিং হইল। আমরা সারাদিন রইদে ঘুইরা বুয়ামার্কা চেহারা নিয়া কীসব ডায়লগ জানি দিলাম। মেকাপ টেকাপের কোন বালাই নাই। পরে বান্ধবীর বাসায় অনুষ্ঠান দেখছিলাম।

এতক্ষণ শুটিং কইরা যে এত অল্পসময় অনএয়ারে গেলো আর উপযুক্ত লাইটিং এর অভাবে আমরা মোটামুটি চান্নিপসর রাইতের যে সিন ফুটায়া তুল্লাম, তা আর না বলি । এরমাঝে একেকজনের মুখ্মণ্ডল খুঁইজা পাওয়া যাইতাছেনা। তখন থিকা বুঝলাম আসলে মেকাপ ছাড়া শুটিং করা সগীরা গুনাহ। এরপরে আরেকবার রনি ভাইর ওই প্রোগ্রামে ভালবাসা নিয়া কী জানি একটা রম্য বিতর্ক টাইপের আইটেমে ১০/১২ সেকেণ্ড চেহারা দেখানোর সুযোগ হইছিল। যদিও সেই প্রোগ্রাম দেখা হয়নাই।

আমার মাতাজানের কল্যাণে আমরা চিরকালই তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বিটিভি দেইখা গেলাম। লাস্ট সুযোগ হইছিল ২০০৩ এর দিকে। নাট্যাভিনেতা খায়রুল ইসলাম পাখী-র উপস্থাপনায় "হিং টিং ছট" নামে একটা ফ্যামিলি কুইজ টাইপের অনুষ্ঠান হইত, সম্ভবত বিটিভিতে (৫ বছর আগের কথাও ঠিকমত মনে নাই, হায়রে দুঃখ )। প্রতিযোগীর একদল হত তারকা পরিবারের কেউ, আরেকদল দর্শক পরিবার। চিঠি লেখলে কর্তৃপক্ষ আমন্ত্রণ জানাইত।

বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নগুলান আগে ১০০ জনের উপর জরিপ চালিয়ে, তাগো উত্তরের সংখ্যগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে কয়েকটা উত্তর আগেই তৈরী কইরা রাখা হইত। প্রতিযোগীদের যে দল প্রথম উত্তরটা অনুমান করতে পারব হেরা সর্বাধিক নম্বর পাইব। এভাবে ক্রমানুযায়ী কয়েকটা উত্তর রাখা হইত। নম্বরের সমপরিমাণ প্রাইজমানি পাওন যাইত। একটা পর্বের পরে মোট নম্বরের ভিত্তিতে একদল বাদ যাইবো, আরেকদল একটা রাউন্ড পেরিয়ে ২৫০০০ টাকা পাইবো।

আমরা জামাতে বইসা সেই প্রোগ্রাম দেখতাম। তো একদিন খায়েশ হইল এইটার মাধ্যমে যদি পুরা ফ্যামিলি এক চান্সে লাইম্লাইটে আসা যায়। আম্মার রক্তচক্ষুরে উপেক্ষা কইরা চারবোনের দল বানায়া চিঠি লিখলাম। একদিন পাখী ভাই ফোন দিয়া কয়, শুটিং এ ঢাকা যাইতে। আমরা চাইর ইস্টার বডিগার্ড হিসাবে আব্বুরে নিয়া নাইটকোচে রওনা দিলাম সিলেট থিকা ঢাকা।

পরদিন দুপুরে শুটিং বেইলী রোডে। স্পটে আইসা দেখি ছেরাবেরা অবস্থা। আমগো লগে কোন তারকা দল থাকব সেইটা জিগাইলে প্রযোজক মিন্মিন কইরা কী জানি কয় খালি। পরে জানলাম যাগো আসার কথা হেরা আইবনা। কতবড় অপমান ।

আমরা কি খালের পানিতে ভাইসা আইছি? আমাগোরে বসায়া রাইখাই আরো তিন পর্বের শুটিং হয়া গেল। একটাতে ছিলেন অভিনেতা মীর সাব্বির পরিবার, একটাতে ডিজাইনার শাহরুখ শহীদ পরিবার আর আরেক্টাতে মডেল ইমি, আজরা এরা। ইউনিটের লোকজন মনে মনে বেজায় শরমিন্দা বুঝতাছি। আমাদের একটু পরপর কোক সাধে খালি। আর ডাইকা ডাইকা শুটিং দেখায়।

আমরা তো হাঁড়িমুখে চাইর বইন বইসা আছি। দুপুরের শুটিং হইল সন্ধ্যায়। তো, আমার সবসময়ি এক্টু মাতবরির অইব্বাস। আমি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বা পেশীবলে যেটাই হোক, দলনেতা সাইজা বসলাম । শুটিং শুরু হওয়ার আগে আব্বু দলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ব্যাপারে উনার ইচ্ছার কথা জানাইলেন।

তার মানে আমগো চাইর বইনের মইদ্দে কাউরে বাদ পড়তে হইব। আব্বুর কথা শুইনাই সব ছোট জুলির মুখে টর্নেডোর আভাস পাইলাম। সে বুঝতাছে সব ছোট হিসাবে তারে বাদ দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হইতারে। সে আমার কাছে ঘেঁইষা মিচমিচানি শুরু কইরা দিল। আমরা পার্লার পলিটিক্স শুরু কইরা দিলাম।

মিনিট দুয়েক বিস্তর কানাকানির পর আব্বুরে সাফ জানায়া দেয়া হইল, শুটিং এর আধা ঘন্টা আগে কুশীলবের পরিবর্তন করার প্রশ্নই উঠেনা তো, শুটিং শুরু হইল। আমরা আটা ময়দা মাইখা, গালে নায়িকা দিতির মত আলগা তিল আঁইকা যুদ্ধংদেহী (নাকি যুদ্ধাংদেহী) ভংগিতে খাড়াইলাম ক্যাম্রার সামনে। বিপরীতে তারকা পরিবার না পায়া কইত্থাইক্কা ডাক্তার চার জন্রে হেরা খবর দিয়া আনছে। ভাইয়া, আপুগুলান বেশ ভালো ছিল। প্রথম প্রশ্ন আমারে কর্লো, আমি জরিপের প্রথম উত্তরের সাথে মিলায়া কিছু পয়েন্ট জিতা নিলাম।

প্রশ্নটা মনে পড়তাছেনা। এরপর বড়াপ্পি, তারে জিগাইলো জীবনে সফলতার জন্য কোন জিনিষটা সবচে দর্কার। জরিপের প্রথম উত্তর বুদ্ধি, বড়াপ্পির উত্তরের সাথে মিলা গেলো। কী মজা! ভাবতাছি ২৫০০০ টাকা দিয়া কী কী করন যায়! তৃতীয় প্রশ্নে খাইলাম ধরা। আমার পরের বোন পেরেক না বইলা উত্তর বললো 'লোহা'।

সিলেটে পেরেকরে লোহা বলে। যথারীতে অন্যদল সুযোগ পাইলো এবং পয়েন্ট জিতা নিলো। আমরা এই ভুলের কারণে হেরে বাসায় আইসা ১০০০ বার পেরেক লিখার শাস্তি দিছিলাম । সবছোট জুলিও উত্তর পাইরা গেলো। আমরা তো মহাখুশি! ডাক্তার আপু ভাইয়ারা গোহারা হারতাছে।

পঞ্চম প্রশ্ন আবার আইলো আমার দিকে। কোন ফল শুঁকে কিনতে হয়? আমি তো পুরা ধরা। জীবনেও কোনদিন ফল কিনি নাই। আব্বু আম্মুই কিনত। শুঁইকা কোনটা কিনতে হয়, খুঁইজা পাইতাছিনা।

কইলাম, লেবু। জরিপের কোনটার সাথে মিললোনা। পরের বোনেরা আবার একটা একটা কইরা কইলো, জরিপের একটার সাথে মিললো। আবার আইলো আমার উত্তরের পালা। আমি কোন ফল না পাইয়া কইলাম, কলা ।

এই পাপের শাস্তি আমার সারাজীবন বয়া বেড়াতে হইতাছে। আমারে কলা খাইতে দেখলেই আমার বাসার মানুষ কয়, কলা শুঁইকা কিনে, নারে? কেম্নে যে এমন মফিজ মার্কা উত্তর টা দিছিলাম। যাইহোক, আরো কয়েকটা প্রশ্নের পরে আমরা কিছু পয়েন্টে পিছায়া বাদ পইড়া গেলাম ২৫০০০ পাওয়ার রাউন্ড থিকা। ২২০০ টাকা নিয়া নাচতে নাচতে সেইদিন রাতেই আবার ব্যাক টু সিলেট। আব্বু তো মহা সুযোগ পাইছেন ।

আমাদের খালি চেতান, আমারে নিলে হারতে হইতোনা। সিলেট আইসা মোটামুটি আত্মীয় স্বজন সবাইরে মাইক ছাড়া ঘোষণা দিয়া দিলাম অনুষ্ঠান দেখার লাইগা, যদিও বিপুল উদ্দ্যমে হাইরা আসছি। আমাদের চারবোনের সম্মিলিত স্মৃতির মধ্যে অন্যতম সুখস্মৃতি ছিলো ওইটা। অভাগিনীর টিভি পোগ্রাম করার সাধ এখনো আছে । আছেন্নি এমুনের কোন সহৃদয় নির্মাতা ব্লগার?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।