আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বামরাজনীতির প্রবাদ পুরুষ জীবন্ত কিংবদন্তী প্রসূন কান্তি রায় ( বরুণ রায়)



হিমাদ্রি শেখর ভদ্র জন্ম কথা: বরুণ রায় জীবনের ১৪টি বসন্ত শ্রমজীবি মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে অতিবাহিত করেছেন। বরুণ রায়ের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িয়ে আছে সমাজতন্ত্র,সাম্যবাদ, মানব কল্যাণ আর বিপ্লব। সুদূর শৈশবে তিনি রাজনীতির অলিতে গলিতে পদচারণা করে মানব কল্যাণের সর্বোত্তম দীক্ষায়দীক্ষিত হয়েছেন। তাঁর বাবা কৃষক বন্ধু করুণা সিন্ধু রায়। বামরাজনীতির প্রবাদ পুরুষ জীবন্ত কিংবদন্তী প্রসূন কান্তি রায় কে বৃহত্তর সিলেট তথা সমগ্র ভাটিবাংলার মানুষ বরুণ রায় নামেই চেনেন।

তিনি বৃহত্তর সিলেটের একজন আদর্শ রাজনীতিবিদ এবং সকলের শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তি। শৈশব থেকে বাবার রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেখে দেখে তার জীবনের রাজনীতির প্রথম পাঠ শুরু হয়। কৈশরকালে তাঁর পিতার কাছ থেকেই রাজনৈতিক দীা লাভ করেন। সেময় তার পিতার নামে ভাটিবাংলার অলিতে গলিতে একটি স্লোগান প্রচলিত ছিল এটি হলো ‍কৃষক বন্ধু করুণা সিন্ধু পাড় হয়ে যায় মহাসিন্ধু । তিনিই প্রথম তৎকালীন আসাম পার্লামেন্টে শ্রীহট্ট প্রজাস্বত্ব আইন উথাপনকারী ব্যাক্তি।

বুর্জুয়া পেটিবুর্জুয়া রাজনীতির বিরোদ্ধে সমাজতান্ত্রিক পথ-পরিক্রমার একর্নিভীক সৈনিক। সমাজতন্ত্র ছিল তারঁ জীবন দর্শন ও দিনযাপনের একমাত্র পাথেয়। ১৯২২ সালের ১০ নভেম্বর বেহেলী নদীর তীরবর্তী সবুজ শ্যামলীমায় আচছাদিত বেহেলী গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে বরুণ রায়ের জন্ম। প্রসূন কান্তি রায় (বরুণ রায়) বাম রাজনীতির পুরোধা। ভাটি অঞ্চলের মানুষ তাকে বরুণ রায় বলে ডাকে।

রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া: কৈশরে তিনি ও তার সহপাঠীরা বড়দের দেখাদেখি কমিউনিস্ট পার্টির লাল রংয়ের ঝান্ডা হাতে নিয়ে দৌঁড়া-দৌঁড়ি করতেন। জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী গ্রামটি ছিল বাম রাজনীতির উর্বর ত্রে। বেহেলী গ্রামটি দেশের একপ্রান্তে থাকায় বাম রাজনীতিবিদরা আত্মগোপনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নিতেন। সেময় বৃটিশ বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে লালপাগড়ি বৃটিশ পুলিশের তাড়া খেয়ে বেহেলী গ্রামে তাদের বাড়িতে অনেক বাম রাজননৈতিক নেতা আত্মগোপন করে থাকতেন। তাঁর বাবা ছিলেন একজন সক্রিয় রাজনীতিবিদ একারণে তাদের বাড়িতে প্রায়স চেনাঅচেনা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের আনাগোনা ছিল।

১৯৩২ সালের ভারত উপমহাদেশের অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ বেহেলী গ্রামেও লাগে । গ্রামগঞ্জের অগণিত খেটে খাওয়া মানুষ সক্রিয়ভাবে অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৩২ সালে অসহযোগ আন্দোলনে অত্র অঞ্চলের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে তাঁর পিতা করুণা সিন্ধু রায় কে পুলিশ গ্রেফতার করে। একারণে তাঁর কয়েক বছর জেল খাটতে হয়। সুদূর শৈশব থেকে বরুণ রায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড দেখে অভ্যস্ত ছিলেন।

রাতে তাদের বাড়িতে বসে ঘরানার সভা করে পার্টির পরবর্তী কার্যক্রম গ্রহণ করা হতো। এসব তিনি ছোটবেলা থেকে দেখে দেখে অভ্যস্ত ছিলেন। তাই বাবা করুণা সিন্ধু রায়ের অনুপস্থিতিতে সংগঠন চালানোর ভার স্বাভাবিকবাবেই তাঁর উপর এসে পড়ে। ১৯৩২-৩৩ সালের প্রথমার্ধে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে চরকায় সুতা কাটার কাজ শুরু হয়েছে। তখনকার সময়ে অনেকের বাড়িতেই সুতাকাটার চরকা ছিল।

নিতান্ত অজপাড়া গ্রামের মানুষও ছিল রাজনীতি সচেতন। তারা তাদের ন্যায্য দাবী আদায়ের সংগ্রামে কখনো পিছপাঁ হতো না। প্রতিদিনই গ্রামে গ্রামে বৃটিশ বিরোধী স্লোগান দিয়ে মিছিল সহকারে গ্রামের মেঠোপথ প্রদণি করতো বৃটিশ রিরোধী আন্দোলনের নেতা কর্মীরা। বরুণ রায় কৃষক, শ্রমিক, মজুর, জেলে সহ নির্যতিত গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের বহুকাল সরকারের হুলিয় মাথায় নিয়ে আত্মগোপনে কাটিয়েছেন। সেই সাথে জেলে কাটিয়েছেন বছরের পর পর বছর।

রাজনীতির খেড়ো খাতা : ১৯৩৭ সালে বাংলার নির্যাতিত প্রজাদের জন্য জমিতে জোতস্বত্ব প্রতিষ্ঠা, নানকার প্রথা বিলোপ সাধন, সাধারণ মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ অনেক আন্দোলন সংগ্রাম বরুণ রায় খুব কাছ থেকে প্রত্য করেছিলেন। অনেকটা এ কারণে তিনি সমাজের অবহেলিত বঞ্চিত সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পিছপা হননি। । বরুণ বায় ছাত্র ফেডাড়েশনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে কমিউনিষ্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন এবং ১৯৪২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে ওই পার্টির পুর্নাঙ্গ সদস্যপদ লাভে সমর্থ হন। একই সালে স্বাধীনতা দিবস পালনের অপরাধে প্রথম জেলে যান বরুণ রায়।

১৯৫০ সালে কমিউনিষ্ট পার্টির জেলা প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে সিলেট গোবিন্দচরণ পার্কে বাংলা ভাষার সপে সভা করতে গিয়ে উর্দূ ওয়ালাদের দ্বারা প্রহৃত হন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের পরপরই তিনি পাকিস্থান সরকারের নির্দেশে গ্রেফতার হন এবং পাঁচ বছর কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়ে নিজ গ্রাম বেহেলীতে অন্তরীণ ছিলেন। সে সময় একটি পৃথক নির্বাচনী বিধিমালার আওতায় সুনামগনঞ্জের সাধারণ হিন্দু নির্বাচনী এলাকায় তাকে প্রার্থী করা হলেও মনোয়ন প্রাপ্তির কয়েকদিন পর আবারও তাকে কারাবন্দী করা হয়।

তিনি জেলে থাকাবস্থায় বিপুল ভোটের ব্যাবধানে জয়লাভ করেন। এক পর্যায়ে এম এল হিসেবে জেল তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। সারা দেশে ৯২ (ক) ধারা জারী করা হলে ১৯৫৪ সালে আবার তিনি কারাভোগ করেন। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তিনি টানা পাঁচ বছর কারাভোগ করেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় বরুণ রায় ১৯৬৬ সালে কমিউর্নিষ্ট পার্টির সিলেট জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সির্বাচিত হন।

১৯৬৮ -১৯৬৯ এর গণঅভ্যুন্তানে তিনি প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা সীমিত করে আতগোপনে থাকেন। একই সালের শেষ দিকে সিলেট জেলা কমিউনিষ্ট পাটির গোপন সম্মেলনে তিন দিনব্যাপী রাজনৈতিক আলোচনায় তিনি ঘন্টা পর পর জাতীয় ও আন্তজার্তিক পরিস্থিতির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে নেতাকর্মীদের করনীয় সর্ম্পকে উপদেশ দেন। আত্মগোপন থাকাকালে ১৯৬৮ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। একই সঙ্গে তিনি কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৬৫ সালে আয়ূব খাঁন সরকার তার উপর হুলিয়া জারী করে।

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে দিরাই শাল্লা এলাকায় আত্মগোপন থেকে সুরঞ্জিত সেনের কে কুড়েঁঘর মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ভারতে চলে যান ও মুক্তি যোদ্বাদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। একই সালের ১৭ ডিসেম্বর স্বাদেশে ফিরে দেশ পুর্নগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৩ সালে সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দদ্বীর মধ্যে তিনি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদেও শাসন আমলে তিনি সংসদ নির্বাচিত হন।

১৯৮৭ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনের জন্য তিনি কারাবরন করেন। বিভিন্ন সময় তিনি ১৪ বছর কারাবাস ছিলেন। বাকুঢ়া থেকে বাংলাদেশ : তাঁর পুর্বপুরুসেরা ভারতের রাঢ় প্রদেশের বাকুড়া থেকে সম্ভবত দশ শতকের দিকে সুনামগঞ্জের ভাটি এলাকায় এসে বসতী স্থাপন করেন। তখনকার সময় সিলেটের বৃহত্তম অংশ ছিল জলমগ্ন এক ভুখন্ড। তার পুর্ব পুরুষ শোভারাত দত্ত দূর্গম পথ অতিক্রম করে এখনে এসে পৌছেঁন।

পরবর্তীতে তাদের তেরতম পুরুষ ১৬৪৯ খ্রীস্টাব্দে দিল্লীর সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে জলমগ্ন স্থান সহ একটি সনদ গ্রহণ করেন। মানুষের চিরচেনা বরুণ রায় বরুণ রায় আপন আলোয় উদ্ভাসিত একজন রাজনীতিবিদ। যার নামের পাশে যুক্ত রয়েছে মানবতাবাদ,ত্যাগ,বিপব ও মানবকল্যাণ। জন্ম ১৯২২ সালের ১০ নভেম্বর অবিভক্ত পাকভারত উপমহাদেশের বিহার রাজ্যের পাটনায়। করুণা সিন্ধু বাবার ইচছা অনুসারে স্থানান্তরিত হয়ে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার বেহেলী গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।

শৈশব থেকে রাজনৈতিক পরিমন্ডলে বেড়ে ওঠার জন্য তার মধ্যে কম বয়েসেই রাজনীতি ঢুকে পড়ে। কৈশোর অবস্থায় তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বরুণ রায়ের শৈশব কেটেছে রাজনৈতিক পরিমন্ডলের ভেতর। তার বাবা করুণা সিন্ধু রায় ছিলেন সক্রিয় রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব। তিনি কলকাতা কলেজে পড়াশোনা করার সময় সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

সেই থেকে রাজনৈতিক জীবনের পথচলা। ১৯৩৭ সালে প্রজাদেও জোতস্বত্ব প্রতিষ্ঠা,নানকার প্রজাবিলোপ,খাজনার ভিত্তিতে প্রজাদের জোত স্থায়ীকরণসহ সাধারণ মানুষের জীবনঘনিষ্ঠ অনেক আন্দোলন সংগ্রাম তিনি খুব কাছে থেকে প্রত্য কনেছিলেন। সে জন্য তিনি অতি সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধীকার আদায়ের সংগ্রামে পিছপা হননি। সাম্রজ্যবাদ,সামন্তবাদ.বুর্জোয়া,পেটি বুর্জোয়া,সা¤প্রদায়িকতা,মহাজনীপ্রথা,আরজমিদারদের,অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্বে সংগ্রাম করার দৃপ্ত শপথ নেন তিনি। এ জন্য তিনি মানব সেবায় অন্যতম উদাহরণ সৃষ্টি করেন হবিগঞ্জজেলার বাণিয়াচংয়ে ম্যালেরিয়া আক্রান্তদের সেবা শুশ্রষা করতে গিয়ে নিজে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন ১৯৯০ সালে বার্ধ্যক্যজনিত কারণে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

১৯৭৫ সালে বরুণ রায় ময়মনসিংহ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা শীলা রায়কে বিয়ে করেন। তার এক মাত্র ছেলে সাগর রায় বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। তিনি বর্তমানে সুনামগঞ্জ শহরের হাছন নগর এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাঁর অবসর সময় কাটে সংবাদপত্র পড়ে ও টেলিভিশনের খবর দেখে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।