আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি ও গীতিকার ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান আর নেই

কবিতা ও যোগাযোগ

আমার শিক্ষকের কিছু স্মৃতি তপন বাগচী পঞ্চাশ দশকের অন্যতম প্রধান কবি মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপনা করেছেন। পঞ্চাশ দশকের কবি ও গীতিকার হিসেবে তিনি যথেষ্ট জনপ্রিয়। ১৯৫৬ সাল থেকেই তিনি গান লিখতে শুরু করেন। ষাটের দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের গান রচনার ক্ষেত্রে অনেকটা একক কৃতিত্ব ছিল তাঁর। গবেষণা ও প্রবন্ধসাহিত্যে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়।

তার লেখা প্রথম গান ‌ভালবেসে তবু যেন সবটুকু ভাল লাগে না'-এর সুরকার ছিলেন শিল্পী আনোয়ারউদ্দীন খান। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি। ‌আমার দেশের মাটির গন্ধে ভরে আছে সারা মন' (সুরকার আবদুল আহাদ), আব্দুল জব্বারের গাওয়া ‌তুমি কী দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়' (সুরকার সত্য সাহা), 'হলুদ বাটো মেন্দি বাটো, বাটো ফুলের মউ' (সুরকার আলী হোসেন) প্রভৃতি অসংখ্য জনপ্রিয় গানের সৃষ্টা তিনি। 'বিতায় আর কি লিখব?/যখন বুকের রক্তে লিখেছি/একটি নাম/বাংলাদেশ' মের কবিতায় পাঠ্যপুস্তকে রয়েছে। শিক্ষক হিসেবও তিনি জনপ্রিয়।

প্রায় অর্ধশত ছাত্র-ছাত্রী তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেছেন। ড. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, ড. করুণাময় গোস্বামী, ড. সফিউদ্দিন আহমেদ, ড. সাঈদ-উর রহমান, ড. মোহাম্মদ গাউস মিয়া, ড. খোন্দকার রিয়াজুল হক, ড. মোমেন চৌধুরী, ড. জয়া সেনগুপ্তা, ড. সুকুমার বিশ্বাস, ড. বেগম আকতার কামাল, ড. সিদ্দিকা মাহমুদা, ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ, ড. ভীষ্মদেব চৌধুরী, ড. সৈয়দ আজিজুল হক, ড. বিমল গুহ, ড. সৈকত আসগর, ড. ফাতেমা কাওসার, ড. মাহবুবা সিদ্দিকা, ড. সেলিমা খালেক, ড. মোহাম্মদ হাননান, ড. হাবিব রহমান, ড. আজিজুল হাকিম, ড. সন্দীপক মল্লিক প্রমুখ গবেষক তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করেছেন। বাংলাদেশে তিনিই সবচেয়ে সফল তত্ত্ববধায়ক। সংখ্যাবিচারে তো বটেই, গুণবিচারেও তাঁর অধীনে পরিচালিত গবেষণার সংখ্যা বেশি। তাঁর ছাত্র কেবল বাংলা বিভাগেই নয়, গ্রন্থগারবিজ্ঞান কিংবা গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগেও রয়েছে।

একটু ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা বলতেই হয়। আমি গবেষণার জন্য যখন প্রস্তুতি গ্রহণ করি, তখন জানতে পারি যে, আমার বিভাগে অর্থাৎ গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পিএইচডি গবেষণার পথ খুবই জটিল। জটিল এই কারণে যে, পিএইচডি গবেষকের যোগ্যতা হিসেবে এমফিল কিংবা ডিগ্রি পর্যায়ে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়, কিন্তু এই দুটির সুযোগ এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের নেই। এত পুরনো বিভাগ, অথচ এমফিল কোর্স খোলা হয়নি! আর দেশের কোনো কলেজে এই বিভাগটি পড়ানো হয় না। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছাড়া সাংবাদিকতা বিভাগে গবেষণা করার সুযোগ নেই।

আমি বিকল্প সুযোগ খুঁজতে থাকি। অবশেষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রফেসর ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরীর শরণাপন্ন হই। তিনি বাংলা একাডেমী ও নজরুল ইন্সটিটিউট থেকে প্রকাশিত আমার গবেষণাগ্রন্থ দেখে আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক হতে সম্মত হন। তবে সাংবাদিকতার ছাত্র হয়ে বাংলা বিভাগে গবেষণার ক্ষেত্রে কোনও আইনগত সমস্যা না থাকলেও আগের কোনো নজির নেই বলে স্যার কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। তাই তিনি দ্জুন বিশিষ্ট গবেষকের কাছ থেকে আমার গবেষণাকর্ম সম্পর্কে প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে বললেন।

আমি সাংবাদিকতা ও বাংলা বিভাগের দুই চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কবি ড. বিমল গুহ আমাকে নিয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চেয়ারম্যান ডক্টর মোহাম্মদ মনিরুজ্জমানের কাছে। এই প্রথম তাঁর সামনে যাওয়া। তিনি বিমলদার কাছে শুনে এবং আমার নাম শুনেই প্রত্যয়নপ্রত লিখে দেন। আমি একসঙ্গে গাঁথা আবেদনপত্র ও প্রস্তাবনাপত্র স্যারকে দেখাই।

তিনি আবেদনপত্রের যে স্থানে কো-তত্ত্বাবধায়কের ঘর আছে, সেখানে স্বাক্ষর করে দিয়ে বললেন, তোমার স্যারকে বলো, আমিও সঙ্গে রইলাম। ' এটি আমার জন্য যে কত বড় প্রাপ্তি, তা লিখে বোঝানো যাবে না। আবুল আহসান চৌধুরী স্যারও খুব খুশি হলেন, তাঁর শিক্ষক তাঁর স্বেচ্ছায় কো-তত্ত্বাবধায়কের হতে রাজি হওয়ার উদারতা প্রদর্শন করায়। আমার থিসিসের খসড়া যখন তৈরি করেছি, স্যার তখন হাসপাতালে। তখন তাঁর কথা বলাও সম্ভবপর নয়।

তিনি আমাকে তাঁর সুস্থতা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি কাগজে লিখে জানালেন যে, আমি যেন তাঁর ছাত্র ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষকে দেখিয়ে আনি। বিশ্বজিৎ ঘোষ আমার থিসিস পরীক্ষা করে দেন। মূল তত্ত্বাবাবধায়ক তো আগেই দেখে দিয়েছেন। তখন দউজনের মতামত তাঁকে জানারে তিনিও অনুমোদন করেন।

অনেক তত্ত্বাবধায়কের কথা জানি, যাঁরা দিনের পরে দিন কোনো কারণ ছাড়াই, ছাত্রদের ফিরিয়ে দেন। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থতা সত্ত্বেও মনিরুজ্জামান স্যার আমাকে একটি দিনও হয়রানি করেননি। এরকম উদারতার পরিচয় খুব অধ্যাপকদের মধ্যেই রয়েছে। তাঁর উল্লেখ্যযাগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, 'দুর্লভ দিন' 'শঙ্কিত আলোকে', 'বিপন্ন বিষাদ', 'প্রতনু প্রত্যাশা', 'ধীর প্রবাহ', 'ভাষাময় প্রজাপতি' ইত্যাদি। 'আধুনিক কবিতার ছন্দ' গ্রন্থটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

। এই বইটি নিয়ে 'মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ছন্দোচিন্তা' নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম দৈনিক 'বাংলার বাণী' পত্রিকায়। তখনও স্যারের সঙ্গে পরিচয় হয়নি। তাঁর 'স্মতি যে অচঞ্চলা' নামের স্মৃতিকথাটি নিয়েও আমি একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। শিশু একাডেমী থেকে প্রকাশিত তাঁর ছড়াগ্রন্থ 'ইচ্ছে' নামের ছড়াগ্রন্থটি নিয়ে আমার আলোচনটি পড়ে তিনি বেশ খুশি হয়েছিলেন।

বলেছিলেন, 'আমার কবিতা, গান, প্রবন্ধ নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, কিন্তু ছড়া নিয়ে তুমিই প্রথম আলোচনা করলে। ' ভেবছিলাম তাঁর কবিতা নিয়ে লিখব, তা আর হয়ে উঠেনি। তবে আমি নিশ্চিত যে তাঁর কবিতার উপর অনেক আলোচনা হবে। এবং তাঁর প্রতিটি এলাকা যেমন কবিতা, প্রবন্ধ ও গান নিয়ে পৃথক পিএইচডি ডিগ্রিও অর্জিত হবে। আমার পরিকল্পনা ছিল, তাঁর অধীনে যে ক'জন পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছি, তাঁদের সকলের স্মৃতিমূলক রচনা নিয়ে একটি সংকলনগ্রন্থ তাঁর জন্মদিনে উপহার দেব।

এব্যাপারে ড. বিমল গুহ ও ড. আলী হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে পরামর্শও করেছি। কিন্তু সেই সুযোগও আমার পেলাম না। তাঁর প্রিয় ছাত্র ড. মোহাম্মদ হাননান তাঁর উপর রচিত প্রবন্ধ ও আলোচনা নিয়ে একটি সংবর্ধনগ্রন্থ প্রণয়ণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। আমার লেখটি পৌঁছে দিয়েছিলাম আগামী প্রকাশনীর দপ্তরে। সেই গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও মূল্যায়নের একটি উপায় হতে পারে।

জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৫ আগস্ট যশোরে। তার পিতার নাম শাহাদৎ আলী, মায়ের নাম রাহেলা বেগম। ১৯৫৮ ও '৫৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১ম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন। ১৯৫৭-৫৮ সালে তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। ১৯৬২ সালে প্রভাষক হিসাবে বাংলা বিভাগে যোগ দেন।

১৯৬৯ সালে 'লা কাব্যে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক' শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৯-৭০ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা করেন। সাহিত্যের জন্য তিনি বাংলা একাডমী পুরস্কার ও একুশে পদক-সহ দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ পদক লাভ করেছেন। তাঁর চেয়েও বেশি লাভ করেছে ছাত্র ও পাঠকের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

তিনি চলে গেছেন। তাঁর প্রিয়তম পুত্রকন্যা, প্রিয়তমা স্ত্রী রাশিদা জামান ও অজস্র ছাত্র ও গুণগ্রাহীর কাছে আর তিনি ফিরে আসবেন। তাঁর প্রতি সৃষ্টিশীল মানুষের অনুপস্থিতি এই সমাজ দীর্ঘদিন অনুভব করবে। তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে-- গানে, কবিতায়, প্রবন্ধে। তাঁর স্মৃতি ও কর্ম অমর হোক।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।