আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ম্যাডোনা/হোর কমপ্লেক্স- নারীকে নিয়ে পুরুষের পুরোনো চিন্তাধারা আর তার কিছু সাইড-এফেক্ট

কখগ বেশিরভাগ ছেলেরা মেয়েদের মনের ব্যাপারে কমপ্লেইন করে যে তাদের বোঝা খুব মুশকিল বা দুরুহ আরো কত কি । অথচ সবথেকে বড় যে ব্যাপারটা ছেলেরা ভুল করে বসে তা হলো নিজের ব্যাপারে জানা, নিজের বিশ্বাসের ভিতগুলো কোথা থেকে আসছে তাকে কোনদিন প্রশ্ন না করতে পারা । এরকম অনেক বিশ্বাস আমরা বয়ে বেড়াই যা আমাদের মনের অজান্তেই আমাদেরকে আটকে রাখে। তবে এই চিন্তাধারা নিজের ভেতর আনতে আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে বেশ কঠিন পথ। আর যখন দেখি যে কম-বেশি আমাদের সমাজের প্রতিটা ছেলের বিশ্বাস কোন না কোন ভাবে মেয়েদের ব্যপারে এক ।

যতই সবার সাথে এসব নিয়ে কথা বলি – আমার বিশ্বাস এ ব্যপারে আরো মজবুত হতে থাকে । ম্যাডোনা/হোর কমপ্লেক্স এর সবথেকে বড় কারণ কিছু সামাজিক বিশ্বাস এবং কন্ডিশনিং । সামাজিক কন্ডিশনিং আসলে কি ? একদম ছোটবেলা থেকেই কিছু বিশ্বাস দিয়ে আমাদেরকে সামাজিক ভাবে ইনফ্লুয়েন্স করা হয় আর এটা হয় একটি সমাজের তাৎক্ষনিক প্রেক্ষাপটের প্রচলিত নিয়ম-কানুন থেকে । যদিও মানুষের শেখা মুলত অভিজ্ঞতা নির্ভর তবে সামাজিক বা পারিবারিক কন্ডিশনিং একটি অভিজ্ঞতাকে দেখবার ক্ষেত্রে আপনার পার্সপেক্টিভ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন করে আপনার মনের অজান্তেই । আর একই বস্তুকে শুধুমাত্র পারিবারিক অথবা সামাজিক কন্ডিশনিং এর কারণে দুজন লোক দেখতে পারে সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিতে ।

ম্যাডোনা/হোর কমপ্লেক্সের ব্যপারে জানাটা মেয়েদের ব্যপারে আমার সারা-জীবনের বিশ্বাসগুলোকে নতুন করে পরীক্ষা করে দেখতে ভাবায় আর প্রথমবার নিজেকে প্রশ্ন করতে প্রভাবিত করে । সাইকোএনালাইসিস এর জনক সিগমান্ড ফ্রয়েড প্রথম পুরুষ এমনকি নারীদের মাঝেও এই জটিলতাটুকু আবিস্কার করেন আর এর প্রধাণ কারণ মুলত এই পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া ট্রেডিশনাল দুটি রোল । সামাজিক যুক্তি অনুযায়ী শ্বাসত চরিত্রের এক নারী অথবা দুশ্চরিত্রের হোর। আর আমাদের মনের একদম গভীরে গেঁথে যাওয়া এই দুটি রোলের বাইরে নারীর নিজস্ব রুপে তাকে দেখতে ব্যর্থ হই আমরা , যা সত্যিকার অর্থে নারী-পুরুষের কানেকশন এ বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর যৌনতা আর ভালোবাসা কে আলাদা করে ফেলার অবচেতন চাহিদাও তৈরি হয় এখান থেকেই ।

ম্যাডোনা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে পবিত্র নারীর ক্ষেত্রে আর হোর নিয়ে বলার কিছু নেই । পুরুষদের অবচেতনে নারীর এ-দুটো রোল এত গভীর ভাবে গেঁথে যায় যে তার জীবনে সৃষ্টি হয় একটি প্যারাডক্স এর । একদিকে সামাজিক যুক্তি অনুযায়ী একটি ভালো চরিত্রের নারীকে স্ত্রী হিসাবে পাবার আকাঙ্ক্ষা আর অন্যদিকে যৌনতাকে স্বাধীনভাবে উপভোগ করা মেয়েদের প্রতি তার মনের গভীরে তৈরি চাহিদা পুরুষ মানুষের জীবনে তৈরি করতে পারে সব ধরণের ঝামেলা । এই ইন্টারনেটের যুগে পর্ণের প্রতি ছেলেদের ( ভাল + খারাপ) আসক্তি ওপেন সিক্রেট থেকেও ওপেন । দূর থেকে তাই এই খারাপ নারীর প্রতি বিশেষ করে ভাল ছেলেদের মনে তৈরি হয় যৌনতা নিয়ে এক ফ্যান্টাসি আর অপরদিকে তার মা এর শুন্যস্থান পূরণ করবার জন্য সে বেছে নেয় সামাজিক ভাবে ভাল চরিত্রের নারীকে আর এর ফলাফল হিসাবে তার জীবনে নেমে আসতে পারে বিশাল বিপর্যয় ।

সিগমান্ড ফ্রয়েড এর সাইকোএনালাইসিস অনুযায়ী এই জটিলতার প্রধান কারণ ছোটবেলায় মা এর সাথে ছেলের তৈরি হওয়া খুব জটিল বন্ধন । আর যেসব ফ্যামিলিতে ছেলের সাথে পিতার সম্পর্ক খুব শক্তিশালী নয় সেসব পরিবারের ছেলেদের বেলায় এ জটিলতা আরো বেশি। আবার ফ্রয়েড পরবর্তী যুগের ডেফিনিশন অনুযায়ী এ কমপ্লেক্স সেইসব ছেলেদের মাঝেও তৈরি হতে পারে যারা ছোটবেলায় মা এর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত এবং ফলাফল হিসাবে সেই শুন্যস্থান টুকু পুরণ করবার জন্য তৈরি হয় তার এই কমপ্লেক্স । সার্বিক ফলাফল হিসাবে তার মনে তৈরি হয় সেক্স এবং ভালোবাসাকে ভিন্নভাবে দেখার । আর দেহ এবং মনের চাহিদাগত এই পার্থক্য ভালো ছেলেদের জীবনের এক বিরাট ট্র্যাজেডি বলেই আমার বিশ্বাস ।

বিয়ের পর পরকীয়া প্রেমের একটা বড় কারণও এই ম্যাডোনা/হোর কমপ্লেক্স । যেখানে স্ত্রী একটা পুরুষের জীবনে ম্যাডোনা স্থান এবং প্রেমিকা পুরণ করে তার খারাপ নারীদের প্রতি ফ্যান্টাসি । তবে সামাজিক ভাবে কমপ্লেক্সটির উৎপত্তি মূলত হাজার বছরের পুরুষ-শাসিত সমাজের নিয়ম-কানুন থেকে । সমাজের শুরু থেকেই নারীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পুরুষেরা বিভিন্ন নিয়ন-কানুন বানাতে থাকে । আর পরবর্তীতে মুক্ত চিন্তা-ধারার নারীরা এসকল সামাজিক নিয়ম-কানুন কে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্ন করলে তাকে বাহুবলে দাবিয়ে রাখা হয় ।

১৪০০ সাল থেকে ১৭৫০ সাল পর্যন্ত নারীদের ডাকিনীবিদ্যা অনুশীলনের দায়ে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় আর যাতে লাখ লাখ মুক্ত চিন্তা-ধারার নারীদের শেষ করে দেয়া হয় একমাত্র তৎকালীন সামাজিক নিয়মনীতিকে তারা প্রশ্ন করেছিলো বলে , আর এটা আসলে ঐ সময়কার পুরুষ শাসকদের ইন্সিকিউরিটি ছাড়া আর কিছু ছিলো না । যাই হোক, একটু মুক্ত ভাবে চিন্তা করতে শেখা নারীদের সমাজ সবসময় ভয় পেয়েছে আর সহজাত ভাবেই চাপিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছে আর সেই চেষ্টা থেকেই উৎপত্তি হয় ম্যাডোনা-হোর কমপ্লেক্সের । আর এটা যে একটি মেয়েকে সম্পুর্ণভাবে ভালোবাসার ক্ষেত্রে একজন পুরুষ মানুষের জীবনে কত বড় প্রভাব ফেলে আমার ধারণা হলো তা ভয়াবহ এবং কঠিন । বিশেষ করে পুরুষের জ্ঞান এসব ব্যপারে এতই কম আর উদাসীন যে বেশিরভাগ নারী তার জীবনের বড় একটা সময় নিজের খুব বড় একটা অংশ প্রকাশ করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় । আমাদের আগের জেনারেশনের কথা কেউ যদি কখনো সত্যিকার অর্থে চিন্তা করে থাকেন তবে তারই এটা বুঝতে পারবার কথা ।

কিন্তু তা না করে বরং বেশিরভাগ মানুষ সেটাকেই বিচারের মাপকাঠি ধরে নিয়ে চিন্তা করেন । আর নারীকেই ভালোবাসার জন্য সব বিসর্জন দিতে হবে – এমন মনোভাব অবচেতনেই ধারণ করতে থাকে পুরুষেরা, এমনকি নারীরাও । মুলত এ ধরণের চিন্তাধারা সমাজের এত বড় একটা অংশ হয়ে যায় যে তা হয়ে যায় অলিখিত সামাজিক নিয়ম আর এ ধরণের চিন্তাধারাকে প্রশ্ন করবার মত পরিস্থিতিও হয়তোবা অনেকের সারা জীবনেই আসেনা । প্রভাবঃ একটু মনোযোগ দিয়ে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে মাথা ঘামালেই বুঝতে পারা সম্ভব যে এর প্রভাব আমাদের জন্য কতটা খারাপ। মুক্ত চিন্তাধারার নারীর প্রতি পুরুষ মানুষের অবচেতনের ভয় তাকে ভালোবাসতে পারার ক্ষেত্রে এক বিরাট বাধা হয়ে আসছে এতে কোন সন্দেহ নেই ।

আর ভয় আর ইন্সিকিউরিটি থেকে জন্ম নেয়া সন্দেহ সম্পর্কগুলোকে কিভাবে ধংস করে দেয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । বিশেষ করে নারীর ইন্টুইশন খুব প্রখর হবার কারণে তারা পুরুষদের এই কমপ্লেক্সগুলো অথবা ইনসিকিউরিটি কোন না কোন ভাবে ঠিকই বুঝে ফেলে , তাছাড়াও এই কমপ্লেক্স যাদের মাঝে খুব প্রবল তাদের মাঝে ভালোবাসা এবং যৌনতাকে সম্পূর্ণ আলাদা করে দেখবার অবচেতন চাহিদা সম্পর্কগুলর মাঝে দুরত্ব তৈরি করে অথবা সম্পূর্ণতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় । আমরা এমন একটা সমাজে বসবাস করি যেখানে এই বিজ্ঞানের যুগেও যৌনতা নিয়ে সরাসরি বা বুদ্দিদীপ্ত আলোচনা করতে বেশিরভাগ মানুষই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে না । অথচ একে অস্বীকার করবার কোন উপায়ই নেই । বরং ভালোবাসা এবং যৌনতাকে ভিন্ন ভাবে দেখবার ফলাফল হিসাবে একদিকে জন্ম নেয় ভালোবাসা নিয়ে প্লেটোনিক চাহিদা আর যৌনতার ব্যপারে লজ্জাজনক ফ্যান্টাসি ।

আধুনিক সাইকোলজিতে মন এবং শরীর কে এক ধরেই কাজ করা হয় এমনকি এ ধরণের কমপ্লেক্স এর ফলে মন এবং শরীরের মাঝের কম্বিনেশন সিস্টেমও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে বলেই বিজ্ঞানীদের ধারণা । এমনকি এই কমপ্লেক্স পুরুষদের কোর্টশিপ ডিসর্ডারের Click This Link অন্যতম কারণ বলেও মনে করি আমি । এ ব্যপারে আরো আলোচনা করতে চাইলে যদিও পাতার পর পাতা আলোচনা করা যায় তবুও আমি আর বেশি আগাবো না, আর কি চিন্তা করতে হবে সেটা কখনো একটি ভালো লেখার বিষয়বস্তু হতে পারে না বরং কিভাবে চিন্তা করতে হয় সেটা যদি পাঠকেরা বুঝে থাকেন তবেই এ লেখা সফল বলে ধরে নেব । আপনার মাঝে এ কমপ্লেক্সঃ আপনি যদি মনে করে থাকেন যে ভালো মেয়ে আর খারাপ মেয়ের মাঝে ভালোবাসার চাহিদা সম্পূর্ণ আলাদা তবে আপনার মধ্যে এই কমপ্লেক্সটি বিদ্যমান । ভালোবাসা আর যৌনতাকে সম্পূর্ণ এক করে দেখতে ব্যর্থ হলেও ধরে নেয়া যায় আপনি ম্যাডোনা/হোর কমপ্লেক্স এ আক্রান্ত ।

মনে রাখতে হবে যে এই কমপ্লেক্সটি থেকে পুরোপুরি মুক্তি পেতে চাইলে নারীর ব্যপারে আপনার নিজস্ব চিন্তাভাবনাগুলোকে মৌলিক ভাবে পরিবর্তন করা লাগবে । এতে আপনি সহ আপনার জীবনে আসা নারীও সমান ভাবে উপকৃত হবে বলেই আমার বিশ্বাস । করনীয়ঃ "Unconditional love" is when you love a woman for who and what she is and not for who you think she should be." নারীকে আপনি যেভাবে দেখতে চান সেভাবে না বরং তার মত করেই তাকে ভালোবাসতে হবে প্রতিটা পুরুষের । আধুনিক সমাজব্যবস্থার সাথে সাথে নারীর ক্ষমতায়নে যে পুরুষেরা এখন কতটা দুর্বল আর অরক্ষিত বোধ করে তা একজন পুরুষ মানুষ হিসাবে আমি খুব ভালোভাবে বুঝতে পারি । নারী-আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায় পার হবার সাথে সাথে পুরুষেরা এখন স্মরণকালের অন্য যে কোন সময় থেকে আরো অনেক বেশি বিভ্রান্ত ।

অথচ এ ব্যপারে পড়াশোনা করতে গিয়েই আমি আবিস্কার করতে থাকি যে এটা আসলে বিপর্যয়ের ছদ্ধবেশে পুরুষ জাতির জন্য এক বিরাট সুযোগ । সূযোগ আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যক্তিত্বের পুরনো বেড়াজাল ছিড়ে আরেকটু বিবর্ধিত হওয়া, সূযোগ শক্ত মানসিকতার নারীও যেন সম্মান করতে পারে সেরকম ব্যক্তিত্বের অধিকারী হয়ে ওঠবার, সুযোগ নিজস্ব ইনসিকিউরিটি আর দুর্বলতাগুলোকে জেনে আরো সুযোগ্য এবং শক্ত মানসিকতার পুরুষ হয়ে ওঠবার । আর নিজস্ব কাপুরুষতার দেয়াল ভেদ করে বের হয়ে আসা সাহসী পুরুষ মানুষকে নারী চিরকাল ভালোবেসেছে, সামনেও এর ব্যতিক্রম ঘটবে না, অন্তত আমার তাই ধারণা । https://www.facebook.com/DoctorXBD ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৩ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।