আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শামসুর রাহমান : আমাদের অস্তিত্বের অহংকার



হ্যাঁ, কবিতার সঙ্গে গেরস্থালিই ছিল তাঁর| বলেছিলেন, যতোদিন বেঁচে থাকবো লিখবো| লিখেছেনও| শেষ সময় পর্যন্ত| এই দেশ, এই সময় তার মনদর্পনে বন্দী ছিল ভালোবাসায়| তিনি কাল, মহাকালকে দেখেছেন খুব কাছে থেকে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত| তিনি স্বাধীনতার কবি, বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান| তাঁর শেষ দিকের একটি কবিতা আমার মনে পড়ছে এ মুহুর্তে| কবিতাটি ২৮ এপ্রিল ’০৬ ছাপা হয়েছিল দৈনিক যুগান্তর সাময়িকীতে| কবিতাটির শেষ পঙ্ক্তিগূলো তুলে দিচ্ছি পাঠকের জন্য| ‘আখেরে পাড়ায় নেমে আসে অপরূপ মধুময় চন্দিন্সমার| এই অপরূপ চন্দিন্সমাকে মুছে ফেলার কালিমা জাগবে না কোনোখানে| কেবল চন্দ্রিমা জাগবে হৃদয়ে— যার আভা চিরকাল রয়ে যাবে| হে চন্দ্রিমা, রেখো মনে, এই যে লিখছি আমি, তার সত্তা তার রইবে না, কিন্তু তুমি আসমানে জ্বলজ্বল করবে সর্বদা!’ (জ্বলজ্বল করবে সর্বদা/ শামসুর রাহমান) ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ দিয়ে যার যাত্রা শূরু হয়েছিল, সেই কবি সহসন্স মৃত্যুকে ভেদ করে গেছেন| কলাম, প্রবন্ধ, সমালোচনা, নিবন্ধ, অনুবাদ কি করেননি তিনি| কিন্তু প্রধান পরিচয় কবি হিসেবেই সর্বদা জðলজðল করবেন শামসুর রাহমান| বাংলার প্রয়োজনে| বাংলা ভাষার প্রয়োজনে| বাংলা কবিতার প্রয়োজনে| মৃদুভাষী শামসুর রাহমানের চাওয়ার কিছুই ছিল না| চাহিদার কোনো দীর্ঘ তালিকা ছিল না তাঁর| কবিতার নেশা ছিল| ছিল পঙ্ক্তির সাথে খেলা করার স্বপ্ন| মনে পড়ছে, তিনি তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রধান সম্পাদক| তাঁর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম ডিআইটি এভিন্যুতে| সহাস্যে আমাকে তার অফিসে স্বাগত জানিয়ে তিনি সদ্য বের হওয়া বিচিত্রা আমার হাতে তুলে দিলেন| তিনি আমাকে আপনি সম্বোধন করে বলতে থাকলে আমি ভীষণ লজ্জিত হয়ে বললাম ‘দয়া করে “তুমি” বলবেন আমাকে|’ না, তাতে কোনো কাজ হলো না| মৃদু হেসে বললেন, ‘আপনি সময় পেলে আসবেন|’ আট/দশ মিনিটের এই যে প্রথম দেখা, তা অনেকটা স্বর্ণোজ্জ্বল স্মৃতির চাদরেই মোড়া হয়ে গেল আমার জীবনে| এরপর সময় পেলেই ঢু মেরেছি ডিআইটি এভিন্যুতে| প্রিয় কবিকে দেখে এসেছি এক নজর| বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, সামরিক দু:শাসনের যাঁতাকল, অন্যায়-অবিচার আর রাজনৈতিক নিপীড়ন আমার মতো হাজার হাজার তরুণকে দেশ ত্যাগে অনেকটা বাধ্য করে| বিদেশেও বিচিত্র হয়ে ওঠে আমার নিত্য সঙ্গী সাপ্তাহিকী| এক সময় আমি বিচিত্রা’র প্রবাস থেকে কলামে নিয়মিত লেখা শূরু করি| দুই. বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার আমন্ত্রণে কবি শামসুর রাহমান প্রধান অতিথি হয়ে একটি অনুষ্ঠানে আসেন ১৯৯০ সালে| তখন বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার সভাপতি ছিলেন সাঈদ-উর-রব| যিনি এখন নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ঠিকানার প্রেসিডেন্ট সিওও| আমি লীগ সভাপতি সাঈদ-উর-রব এর আমন্ত্রণেই সে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সুযোগ পাই| কবি’র সাথে সে অনুষ্ঠানেই আবার দেখা হয় দীর্ঘদিন পর| দীর্ঘক্ষণ আড্ডা, সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা হয় মধ্যরাত পর্যন্ত| মনে পড়ছে এরপর কবির সাথে সাহিত্য আড্ডায় অংশ নেবার সুযোগ হয় নিউইয়র্কের ইয়র্ক এভিন্যু’র, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের বাসভবনে| সে আড্ডার মুল আয়োজক ছিলেন গল্পকার পুরবী বসু| তার আমন্ত্রণেই নিউইয়র্ক-নিউজার্সিতে বসবাসরত বাঙালি লেখক-কবিরা সমবেত হয়েছিলেন আড্ডায়| শামসুর রাহমান ছিলেন সে আড্ডার মধ্যমনি| সে আড্ডায় অত্যন্ত প্রাণন্ত অংশ নিয়েছিলেন লেখক হাসান ফেরদৌস, ড. জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পুরবী বসু, প্রয়াত কবি আল-মুকতাদির, ড. সলিমুল­াহ খান , ড মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ| সলিমুল­াহ খান, শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ দুটি কবিতা, ‘স্বাধীনতা তুমি’ এবং ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’— এগুলোর তুলনামুলক আলোচনা করেছিলেন অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে| বিভিন্ন প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করছিলেন কবি শামসুর রাহমানকে| লক্ষ্য করেছিলাম, কবি খুব মৃদুভাষায় সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছিলেন| মৃদু হেসে তিনি বলছিলেন, আমি শুনবো, আপনারা বলুন| তাঁর অন্যতম প্রিয় কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ তিনি পড়েও শূনিয়েছিলেন সেদিন| এর ক’বছর পর কবি যখন গ­্লুকোমা রোগে আক্রান্ত হন, তখন আবারো উদগ্রিব হয়ে পড়েন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তাঁর অনুরাগীরা| কবিকে যুক্তরাষ্টেন্স নিয়ে এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়| নিউইয়র্কের বিশিষ্ট চিকিৎসকবৃন্দ, বাংলা সাপ্তাহিকীগূলোর সম্পাদকবৃন্দ, সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবি, পেশাজীবিসহ সর্বস্তরের প্রবাসীরা তাঁর চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেন| কবি দেশে থেকেও যাতে তাঁর চোখের ওষুধগূলো নিয়মিত পেতে পারেন, সে ব্যবস্থায়ও এগিয়ে আসেন বেশ ক’জন সুহৃদ প্রবাসী বাঙালি| এসময় কবির সম্মানে একটি সংবর্ধনার আয়োজনও করা হয়| খুব সংক্ষিপ্ত এবং আবেগ আপ্লুত বক্তব্যে কবি শূধুই ভালোবাসা এবং কৃতজ্ঞতা জানান প্রবাসী সমাজকে| তিন. কবি যখন হরকাতুল জিহাদের জঙ্গিদের দ্বারা আক্রান্ত হন, তখনো যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালীদের প্রতিবাদ ছিল তীব্র| নিউইয়র্কের এস্টোরিয়ায় একটি মিলনায়তনে নাগরিক প্রতিবাদসভার আয়োজন করে হামলাকারীদের বিচার দাবী করা হয়| মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন লেখক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠনের কাছে কবির নিরাপত্তাদানে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করতে স্মারকলিপিও দেন প্রবাসীরা| কবি অত্যন্ত আবেগ নিয়ে প্রায়ই বলতেন, প্রবাসী বাঙালিদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ| কিন্তু বাংলা সাহিত্য, বাংলা ভাষা, বাঙালির চেতনা, সভ্যতার আলো প্রতিষ্ঠার জন্য কবি শামসুর রাহমান যে কর্ম রেখে গেছেন, তার জন্য গোটা বাঙালি জাতিই তো তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ| কি করেননি তিনি? লেখালেখি থেকে শূরু করে মিছিল, সমাবেশ, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ— কি করেননি তিনি| বাংলাদেশের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মিছিলে, ঘাতক দালাল নির্মুলের আন্দোলনে এই অগ্রজ বয়সেও রাজপথের মিছিলে আমরা দেখেছি শূভ্রকেশধারী এই মহান কবিপুরুষকে| তাঁর সমসাময়িক হবার বাসনায় মগ্ন ছিলেন শামসুর রাহমান তখনই গণঅধিকার আদায়ের মিছিলে রাজপথে লড়েছেন| হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন জাতির প্রতি| অনেকগূলো কবিতার জন্যই অমর হয়ে থাকবেন শামসুর রাহমান| তাঁর ‘আসাদের শার্ট’, ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘সফেদ পাঞ্জাবী’, ‘বর্ণমালা, আমার দুখিনী বর্ণমালা’, ‘গেরিলা’, ‘এক ধরনের অহংকার’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, প্রভৃতি থেকে যাবে অনন্তকাল| পাঠক-পাঠিকা জীবনের স্পর্শ খুঁজে পাবেন তাঁর পঙ্ক্তিতে| শামসুর রাহমানের মৃত্যু , আমাদের একটি পাঁজর ভাঙার শব্দের মতোই। ১৯৯৯ সালে কবি নিজে অটোগ্রাফ দিয়ে তাঁর কিছু বই আমার দু’ মেয়ে নাহিয়ান ও নাশরাত এবং আমার সহধর্মীনি কবি ফারহানা ইলিয়াস তুলি ও আমাকে দিয়েছিলেন| আমার কবিবন্ধু, আবু হাসান শাহরিয়ার অত্যন্ত যত্নের সাথে আমাদের কাছে সেগূলো নিউইয়র্কে পাঠিয়ে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছিলেন| আজ আমি কবির নিজ হাতের স্বাক্ষরে হাত বুলিয়ে তাঁর অস্তিত্ব খুঁজি বারবার| তিনি লিখেছিলেন ‘আমার পুরনো, সামান্য বই দিলাম ভালোবেসে|’ বই কি কখনো পুরনো হয়? কিংবা ভালোবাসা! হে প্রিয় কবি! কবি চলে গেছেন| যেখান থেকে কেউ ফেরে না আর| তিনি তার যাত্রার প্রস্তুতি এভাবেই সেরেছেন ক্রমশ ‘যাত্রার আগে’— এই কবিতাটি ৯ এপ্রিল ১৯৯৯ তারিখে লেখা| স্থান পেয়েছে ‘নক্ষত্র বাজাতে বাজাতে’ গ্রন্থে। ‘আমি তো শিগগিরই চলে যাব, বড় একা যাব চুপচাপ, তোমাদের কাউকেই সহযাত্রী করব না নিরুদ্দেশ যাত্রায় আমার| জেদ করে লাভ নেই, আমাকে যেতেই হবে তোমাদের ফেলে|’ কবি, আপনার কবিতা ততোদিনই থাকবে, যতোদিন থাকবে বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতি| আপনি আমাদের অস্তিত্বের অহংকার। ==========================================

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।