আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায়'



একজন কবি বা শিল্পীর জন্য সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনাটির নাম কি? এ প্রশ্নের উত্তর অন্য কোনো দেশে যা-ই হোক না কেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উত্তরটি হবে-- 'ইমেজ। ' অর্থাৎ একজন কবি/লেখক/শিল্পীর যদি একবার কোনোরকমে একটা ইমেজ দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে সেখান থেকে তিনি আর বেরুতেই পারেন না! (অবশ্য 'দুর্বলদের ইমেজপ্রীতিও আছে। একটা ইমেজ দাঁড় করাতে পারলে যে জীবন পার করে দেয়া যায়-- থাকবে না কেন, বলুন!) বাংলাদেশে (শুধু বাংলাদেশেই নয়, পশ্চিম বাংলায়ও বটে), তাই একেকজনের নামের সঙ্গে একেকটি বিশেষণ ঝুলতে দেখা যায়। উদাহরণ হিসেবে কাজী নজরুল ইসলামের কথা বলা যেতে পারে। 'বিদ্রোহী' ইমেজের আড়ালে তাঁর অন্যান্য কাজ তো প্রায় ঢাকাই পড়ে গেছে।

অথচ তাঁর বহুমাত্রিকতা, বিশেষ করে গানে, তো রীতিমতো ঈর্ষণীয়। এমনকি তাঁর তুমুল রোমান্টিকতাও যেন তাঁর 'বিদ্রোহী' ইমেজকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। এমন উদাহরণ আরো বহু দেয়া যাবে। তবে, আজকে আমি এখানে শুধু সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথা বলবো। সুকান্তর ইমেজও বিদ্রোহী-বিপ্লবী ধরনের।

তাঁর বহু কবিতার পঙক্তি আন্দোলন-সংগ্রামে, বিদ্রোহ-বিপ্লবে শ্লোগান হয়ে মুখে মুখে ফেরে। মাত্র ২১ বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া এই কবির কি আর কোনো পরিচয় নেই? আছে, বলাইবাহুল্য। তবে সেই পরিচয় তাঁর কবিতার খুব একটা পাওয়া যায় না। পাওয়া যায়, প্রধানত তাঁর বন্ধু (কবি অরুণাচল বসু) ও বৌদির কাছে লেখা চিঠিপত্রতে। এইসব চিঠিতে তিনি একাধারে কৌতুকপ্রিয়, রোমান্টিক, বেদনাক্লিষ্ট ও মৃত্যুচিন্তায় কাতর।

অরুণাচলকে লেখা চিঠিপত্রের সম্বোধন থেকেই সুকান্তর কৌতুকপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। দু-একটি উদাহরণ দেয়া যাক। অনেকদিন সুকান্তর চিঠি না পেয়ে অরুণাচল ক্ষুব্ধ হয়ে একটি চিঠি লিখলে তার উত্তরে সুকান্তর সম্বোধন ছিলো-- 'শ্রীরুদ্রশরনম-পরমহাস্যাস্পদ অরুণ!' আবার দীর্ঘদিন চিঠির উত্তর না পেয়ে তিনি লেখেন-'সবুরে মেওয়াফল-দাতাসু অরুণ'। কিংবা অনেকদিন পর একটি আনন্দময় চিঠি পেয়ে সম্বোধন করেন 'প্রভূত আনন্দদায়কেসু অরুণ' বা 'আশানুরুপেসু অরুণ' ইত্যাদি নামে! অরুণের সন্যাসগ্রহণের সংবাদ পেয়ে সুকান্ত একটি মজার চিঠি লিখেছিলেন-- 'সৎসঙ্গসরনম শ্রী শ্রী ১০৮ অর্ণব স্বামী গুরুজী মহারাজ সমীপেষু, শত শত সেলামপূবক নিবেদন পরমরাধ্য বাবাজী, আপনার আকস্মি অধঃপতনে আমি বড়ইা মর্মাহত হইলাম। ইতি দাসানুদাস সেবক- শ্রীসুকান্ত।

' যাহোক, এই অরুনের কাছে লেখা একাধিক চিঠিতে তিনি তাঁর প্রেমের কথা লিখেছিলেন। অন্তত দুটো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলেন তিনি, সেকথা ওইসব চিঠি থেকেই জানা যায়। যে কোনো তরুণের মতোই এই চিঠিগুলোতে প্রেমের যন্ত্রণায় কাতর সুকান্তকে দেখে বিশ্বাসই হতে চায় না, এই 'বিপ্লবী'র মধ্যে এত তুমুল রোমান্টিকতা থাকতে পারে। ওই যে, ইমেজের আড়ালে প্রকৃত মানুষটির ঢাকা পড়ে যাওয়ার বাস্তবতা! লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ওই একইসময়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুচিন্তাও তাঁকে গ্রাস করে। একাধিক চিঠিতে তিনি প্রায় ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো নিজের মৃত্যু-সম্ভাবনার বিবরণ দেন।

তবে, তাঁর কবিতায় এসব চিন্তার চিহ্ন খুব কমই পাওয়া যায়! মৃত্যু নিয়ে অবশ্য তাঁর একটি অসাধারণ কবিতা আছে-- 'দ্বারে মৃত্যু, বনে বনে লেগেছে জোয়ার, পিছনে কি পথ নেই আর? আমাদের এই পলায়ন জেনেছে মরণ, অনুগামী ধূর্ত পিছে পিছে, প্রস্থানের চেষ্টা হলো মিছে। ' (দুরাশার মৃত্যু/ সুকান্ত ভট্টাচার্য। ) দ্বারে যখন মৃত্যু উপস্থিত, তখন পালাতে চাইলেও কি পারা যায়? যায় না। মৃত্যুও ধূর্তর মতো অনুগামী হয় পিছে পিছে। যাহোক, এত কথা বললাম সুকান্তর তুলনামূলকভাবে কম পঠিত ও কম আলোচিত একটি কবিতা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য।

এই কবিতায় আমাদের পরিচিত সুকান্তর দেখা মেলে না। বরং খানিকটা বিষণ্ন, রহস্যময়, রোমান্টিক এক কবির সঙ্গে পরিচিত হই আমরা। আসুন, কবিতাটি পড়া যাক-- 'আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায় তবুও পড়িবে মনে চঞ্চল হাওয়া যদি ফেরে কভু হৃদয়ের আঙিনায় রজনীগন্ধা বনে, হয়তো পড়িবে মনে। বলাকার পাখা আজও যদি ওড়ে সুদূর দিগঞ্চলে বন্যার মহাবেগে, তবুও আমার স্তব্ধ বুকের ক্রন্দন যাবে মেলে মুক্তির ঢেউ লেগে বন্যার মহাবেগে। বাসরঘরের প্রভাতের মতো স্বপ্ন মিলায় যদি বিনিদ্র কলরবে তবুও পথের শেষ সীমাটুকু চিরকাল নিরবধি পার হয়ে যেতে হবে বিনিদ্র কলরবে।

মদিরাপাত্র শুষ্ক যখন উৎসবহীন রাতে বিষণ্ন অবসাদে বুঝি বা তখন সুপ্তির তৃষা ক্ষুব্ধ নয়নপাতে অস্থির হয়ে কাঁদে বিষণ্ন অবসাদে। নির্জন পথে হঠাৎ হাওয়ার আসক্তিহীন মায়া ধূলিরে উড়ায় দূরে আমার বিবাগী মনের কোণেতে কিসের গোপন ছায়া নিঃশ্বাস ফেলে সুরে; ধূলিরে উড়ায় দূরে। কাহার চকিত-চাহনি-অধীর পিছনের পানে চেয়ে কাঁদিয়া কাটায় রাতি, আলেয়ার বুকে জোৎস্নার ছবি সহসা দেখিতে পেয়ে জ্বালে নাই তার বাতি কাঁদিয়া কাটায় রাতি। বিরহিনী তারা আঁধারের বুকে সূর্যেরে কভু হায় দেখেনিকো কোনো ক্ষণে। আজ রাতে যদি শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ ফিরিয়া যায় হয়তো পড়িবে মনে রজনীগন্ধা বনে।

' (স্মারক/ সুকান্ত ভট্টাচার্য। ) যদিও বা এই রাত উৎসবহীন, যদিও বা মদিরাপাত্র শূন্য-শুষ্ক, যদিও বা 'বাসরঘরের প্রভাতের মতো স্বপ্ন মিলিয়ে যায়' যদিও বা 'আজ রাতে শ্রাবণের মেঘ হঠাৎ' ফিরে যায়-- তবু আশা ওটুকুই-- 'হয়তো' মনে পড়বে! আমাকে তার, অথবা তাকে আমার!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।