আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভারতীয় সঙ্গীত জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং স্বনামধন্য কন্ঠ শিল্পী ভূপেন হাজারিকার জন্মদিনে শুভেচ্ছা

আমি সত্য জানতে চাই
ভারতীয় সঙ্গীত জগতের পুরোধা ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বশিল্পী কিংবদন্তিতুল্য গায়ক ও সঙ্গীতনির্মাতা ভূপেন হাজারিকা। অত্যন্ত দরাজ গলার অধিকারী এই কণ্ঠশিল্পীর জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। শিশু কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অসমিয়া চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে গানের জগতে প্রবেশ করেন তিনি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর সঙ্গীতপ্রতিভা। ১৯৩৯ সালে তিনি অসমীয়া ভাষায় নির্মিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র জ্যোতিপ্রসাদ আগরওয়ালা পরিচালিত ইন্দুমালতী ছবিতে "বিশ্ববিজয় নওজোয়ান" শিরোনামে নিজেই একটি গান লিখে সুরারোপ করেছিলেন।

পরবর্তীকালে আবির্ভূত হন অসমীয়া চলচ্চিত্রে এবং নিজেই অসমীয়া চলচ্চিত্রের একজন গুণী পরিচালক হয়ে ওঠেন। আসাম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে তাঁর চলচ্চিত্র। তবে মানুষকে তিনি সর্বাধিক আলোড়িত করেছেন তাঁর সঙ্গীত দিয়ে। অসমীয়া ভাষা ছাড়াও বাংলা ও হিন্দি ভাষাতেও তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন এবং অনেক গান গেয়েছেন। অবশ্য এসব গানের অনেকগুলোই মূল অসমীয়া থেকে বাংলায় অনূদিত।

তাঁর গানে প্রশ্ন-উত্তর-দ্বিধা-যুক্তির ছন্দে ছন্দে মানুষের কথাই ধ্বনিত হয়েছে বারবার। কিংবদন্তিতুল্য গায়ক ও সঙ্গীতনির্মাতা ভূপেন হাজারিকার আজ ৮৭তম জন্মদিন। ১৯২৬ সালের আজকের দিনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিনে বিশ্বশিল্পী ভূপেন হাজারিকাকে ফুলেল শুভেচ্ছা খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা ১৯২৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামের সদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা নীলকান্ত হাজারিকা এবং মা শান্তিপ্রিয়া হাজারিকার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন প্রথম।

১৯৪০ সালে তেজপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ১৯৪২ সালে গুয়াহাটির কটন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। এরপর কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৪ সালে বি.এ. এবং ১৯৪৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ. পাশ করেন। ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’তে অল্প কিছুদিন কর্মরত থাকার পর কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি বৃত্তি পান এবং ১৯৪৯ সালে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। নিউইয়র্কে থাকা অবস্থায় ১৯৫০ সালে প্রিয়ম্বদা প্যাটেলকে বিয়ে করেন । ১৯৫২ সালে তিনি পিএইচ. ডি ডিগ্রী অর্জন করেন।

তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল "প্রাপ্তবয়স্কদের শিক্ষায় শ্রবণ-দর্শন পদ্ধতি ব্যবহার করে ভারতের মৌলিক শিক্ষাপদ্ধতি প্রস্তুতি-সংক্রান্ত প্রস্তাব"। ১৯৫৩ সালে স্ত্রী ও একমাত্র পুত্রসন্তানসহ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন ভূপেন হাজারিকা। (স্ত্রী প্রিয়ম্বদা প্যাটেলের সঙ্গে ভূপেন হাজারিকা) ড. ভূপেন হাজারিকা তাঁর ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর ও কোমল ভঙ্গির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর রচিত গানগুলি ছিল কাব্যময়। গানের উপমাগুলো তিনি প্রণয়-সংক্রান্ত, সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় থেকে তুলে আনতেন।

তিনি আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে লোকসঙ্গীত গাইতেন। অন্যান্য পরিচয়কে অতিক্রম করে একজন সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে তিনি নিজের সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন মানুষের মনে। বাংলাদেশ, আসাম ও তার প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল ব্যাপক ও বিশাল। বাংলা ও হিন্দি ভাষায় গান গেয়ে ভারত এবং বাংলাদেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। অসমীয়া লোকসঙ্গীতে আধুনিক তুলির আঁচড় দিয়েছেন ভূপেন হাজারিকা।

পরবর্তী সময়ে অন্যান্য ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে এসব গান। নিউইয়র্কে থাকা অবস্থায় তাঁকে প্রভাবিত করেন বন্ধুস্থানীয় পল রুবিসন; পরবর্তীকালে তিনি জন্ম দেন আশ্চর্য সুন্দর সেই গান ‘বিস্তীর্ণ দুপারে, অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও/নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছো কেন’। হিন্দী এবং বাংলায় এমন অনেক অনূদিত ও মৌলিক গানের সুর ও বাণীস্রষ্টা তিনি নিজেই। ‘তুমি-আমি’র একচ্ছত্র সত্যকে অতিক্রম করে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন বহুমানুষের সত্যকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গান গেয়ে আমাদের সাথে জড়িয়ে আছেন ড. ভূপেন হাজারিকা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি মুক্তিবাহিনীর মনে সাহস ও শক্তি এনে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। একথা অনস্বীকার্য যে ভূপেন হাজারিকার ‘হে দোলা হে দোলা’ ‘গঙ্গা আমার মা’, ‘বিম্তীর্ণ দু’পারে’– এই তিনটি গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশেষ ভাবে সাহায্য করেছিলো এবং হৃদয়ে শক্তিশালী অস্ত্রের মতো উন্মাদনা এনে দিয়েছিল। এছাড়াও তাঁর গাওয়া ‘আমি এক যাযাবর’ ‘বিমূর্ত এই রাত্রি আমার’, ‘সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ চেতনায় নজরুল’, ‘সহস্র জনে মোরে প্রশ্ন করে মোর প্রেয়সীর নাম’, ‘মাইয়া ভুল বুঝিস নাই’, ‘আজ জীবন খুঁজে পাবি’–গানগুলি অসম্ভব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বাংলাভাষা ও বাংলাদেশের প্রতি তাঁর যে টান এ টান নাড়ীর না হলেও প্রাণের। দীর্ঘদিন বাংলায় বসবাস করার ফলে বাংলার প্রতি তাঁর মমত্ববোধ স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছিলো।

কিন্তু অসমের প্রতি বিশেষতঃ সেখানকার মানুষদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ কোনোদিন তো কমেনি, বরং উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। তবে ভূপেনের কোনো সীমারেখা নেই। সে আজ শুধু বাংলা বা শুধু অসমের, এমনকি সারা ভারতবর্ষেরও না, তিনি সারা পৃথিবীর। ভূপেন হাজারিকার গানগুলোতে মানবপ্রেম, প্রকৃতি, ভারতীয় সমাজবাদের, জীবন-ধর্মীয় বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এছাড়াও, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী সুরও উচ্চারিত হয়েছে বহুবার যেমনঃ ১।

আজ জীবন খুঁজে পাবি, ২। আমায় একজন সাদা মানুষ দাও, ৩। আমি এক যাযাবর, ৪। আমি ভালোবাসি মানুষকে, ৫। আমরা করবো জয়, ৬।

এ কেমন রঙ্গ, ৭। এ শহর প্রান্তর, ৮। এক বাঁও মেলে না, ৯। একখানা মেঘ ভেষে এলো আকাশে, ১০। একটি কুঁড়ি দুটি পাতা, ১১।

গঙ্গা আমার মা, ১২। গেইলে কি আসিবেন আমার মাহুত বন্ধু, ১৩। চোখ ছল ছল করে ওগো মা, ১৪। ডুগ ডুগ, ১৫। প্রতিধ্বনী শুনি, ১৬।

প্রভাতী পাখিরা, ১৭। বিস্তির্ন দুপারে অসংখ্য মানুষের, ১৮। মানুষ মানুষের জন্য, ১৯। মেঘ থমথম করে, ২০। শরৎবাবু খোলা চিঠি দিলাম তোমায়, ২১।

সাগর সঙ্গমে, ২২। সময়ের অগ্রগতি, ২৩। সহস্র জনে মোরে, ২৪। হে দোলা হে দোলা। উপরোক্ত গানগুলি Youtube channel শুনতে এখানে ক্লিক করুনঃ ভূপেন হাজারিকার বাংলা গান অসাম্প্রদায়িকতা আর সাম্য ভূপেন হাজারিকার সঙ্গীতের মূলমন্ত্র।

কেবল সংকট উপস্থাপন করে ক্ষান্ত হন নি; নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানোর সত্যিকার আকাক্সক্ষা অনুভব করেছেন তিনি। ভূগোল-ইতিহাস-পুরাণকে সামনে রেখে তিনি মানবিকতার জয়গান গেয়েছেন। যেমনঃ‘সংখ্যালঘু কোনো সম্প্রদায়ের ভয়ার্ত মানুষের না ফোটা আর্তনাদ, যখন গুমরে কাঁদে/আমি যেন তার নিরাপত্তা হই’ অথবা ‘মানুষ মানুষের জন্য একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…’। ‘মানুষ মানুষের জন্য/জীবন জীবনের জন্য’ গেয়ে ওঠার তাড়না ভূপেন হাজারিকা পেয়েছেন নিজেরই অন্তর্লীন প্রশ্নমালা থেকে, যখন জীবন সম্পর্কে তাঁর মনে বেজে ওঠে ‘এক বাঁও মেলে না/দো বাঁও মেলে না/ জীবন জাহাজ আওয়াজ তোলে শোন শোন/প্রাণসায়রে তোলে কত আলোড়ন’’। হৃদয়ের প্রখর তীব্রতা ছাড়া এমন তেজোদ্দীপ্ত বাণী উচ্চারণ সম্ভব নয়।

এই অস্থিরতাই সত্যিকারের শিল্পীর সঞ্জীবনী শক্তি; এই তরঙ্গ তাঁর সৃজনগতির সঞ্চালক। বহু পুরস্কার ও সম্মাননাপ্রাপ্ত এই মহান শিল্পী রেখে গিয়েছেন মানুষকে উজ্জীবিত করার মতো অজস্র সৃষ্টিকর্ম। ভূপেন হাজারিকা ১৯৭৫ সালে ২৩তম ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক চলচ্চিত্র 'চামেলী মেমসাহেব' ছবির সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৭৭ সালে পদ্মশ্ৰী পুরস্কার। ১৯৭৯ সালে 'শ্রেষ্ঠ লোকসঙ্গীত শিল্পী' হিসেবে 'অল ইন্ডিয়া ক্রিটিক অ্যাসোসিয়েশন পুরস্কার', ১৯৮৭ সালে অসম সরকারের শঙ্করদেব পুরস্কার, ১৯৯২ সালে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার, ১৯৯৩ সালে জাপানে এশিয়া প্যাসিফিক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে রুদালী ছবির শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালকের পুরস্কার অর্জন। তিনিই প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই পুরস্কার পান।

এছাড়াও ২০০১ সালে পদ্মভূষণ, ২০০৯ সালে অসম রত্ন এবং একই সালে সঙ্গীত নাটক অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১১ সালের ৫ নভেম্বর মুম্বই কোকিলাবেন ধীরুভাই আম্বানি হাসপাতালে ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় চারমাস রোগে (কিডনী বৈকল্য ও বার্ধক্যজনিত সমস্যা) ভোগার পর মারা যান অসমিয়া, হিন্দি ও বাংলা ভাষার গানের পাখি ড. ভূপেন হাজারিকা। মৃত্যুকালে এই গুণী শিল্পীর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তাঁর শরীরী অস্তিত্বটা আজ আর নেই; দেহত্যাগ করেন তিনি। কিন্তু তাঁর সঙ্গীতের প্রতিটি শব্দ, তাঁর বক্তব্যের প্রতিটি উচ্চারণ মানুষকে বারবার দাঁড় করায় মানবিক বোধের সামনে।

ব্যক্তি ও সমষ্টির সেই সমস্ত সুকুমার বোধ যুগ যুগ ধরে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি রেখে যাবে। তাঁর মৃত্যুর পর আমরা এটা বলতে পারি অসম, বাংলা এবং ভারতে তাঁর সৃষ্টি তাঁকে অমর করে রাখবে কিংবদন্তিতুল্য গায়ক ও সঙ্গীতনির্মাতা ভূপেন হাজারিকার আজ ৮৭তম জন্মদিন। উপমহাদেশের খ্যাতনামা সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকার জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছা
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.