আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদ্রিতার পৃথিবী



ঘাসফুলের গল্প, প্রজাপতির গল্প, হুলো বেড়ালের গল্প, নেংটি ইঁদুরের গল্প শুনতেই ভালোবাসে আদ্রিতা। বস্তিতে জন্ম। বছর চারেক আগে জন্মেছে রাজ্যের ক্ষুধা পেটে নিয়ে। আদর-সোহাগ পায় নি তেমনটা। নাম তবুও আদ্রিতা।

মায়ের বুকে শুয়ে আদর খোঁজে রাতের বেলায়। গার্মেন্টসে চাকরি করে ওর মা আফেলা। কাক ডাকা ভোর থেকে একেবারে রাত আটটা পর্যন্ত অবিরাম পরিশ্রম। ঘরে আছে অসুস্থ স্বামী শাবদুল আর বৃদ্ধ শ্বশুর। আফেলার কষ্টার্জিত সামান্য অর্থেই চলে ওদের ছোট্ট সংসার।

আদ্রিতার বৃদ্ধ দাদু দিনে দু'চার বার চক্কর দিয়ে আসে এবাজার থেকে ওবাজার। ফিরে এসে অসুস্থ ছেলের কাছে গল্প করেন- দ্রব্যমূল্যের উর্দ্ধগতির গল্প, রাজনীতির গল্প, গণতন্ত্রহরণের গল্প, হাসিনা-খালেদার গল্প, এরশাদ-বিদিশার গল্প। শাবদুল তার বৃদ্ধ বাবার কাছে জানতে চায়, কারখানায় কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত বাতিল হলো কি না? যখন এসব গল্প চলে ঘরে। ছোট্ট আদৃতা তখন গাল ফুলিয়ে ছিঁড়তে থাকে গার্মেন্টসের ছাঁট কাপড়ের তৈরি বেঢপ পুতুলের হাত, পা, মাথা। ও শুনতে চায় না এসব গল্প।

দাদু যখন ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলে, আদ্রি কি হয়েছে রে তোর? আগের মতোই গাল ফুলিয়ে চুপ করে থাকে সে। দুদু আবার যখন বলে, জানিস, আমি যখন একটা চায়ের দোকানে বসে গল্প করছিলাম। একটা ইঁদুর আর একটা হুলো বেড়াল...। থাক, তুই যখন শুনতে চাস না আর বলবো না। নিমিষেই আদ্রিতার গোমরা মুখে ফিরে আসে এক ঝাঁক চাঞ্চল্যতা।

ঝরণার মতো ঝিরিঝিরি হাসি দিয়ে দাদুর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ওদাদু বলো না, বিড়াল আর ইঁদুর চায়ের দোকানে কি করছিলো? দাদু ওর গালে চুমু দিয়ে বলে, কি আর করবে। সারাদিন ছুটোছুটি করে ওদের গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো। তাই দোকানে চা খেতে এসেছিলো। - ধুর দাদু, ওরা আবার চা খায় নাকি? - খায় রে সোনা খায়। - তা ওরা কয় কাপ চা খেলো? - দুজনে মিলে চারকাপ চা খেলো আরকি ? আমিই খাওয়ালাম।

তোর কথা বললাম। - সত্যি বলছো দাদু? - তোর কাছে মিথ্যে বলতে যাবো কোন্ দুঃখে। ওরা একদিন তোর সাথে দেখা করতে আসবে। - যেদিন আসবে আমাকে আগে থেকে বলো কিন্তু। আম্মুকে দুধ আর চা আনতে বলবো সেদিন।

আর লাল চুরি পরবো। আর তোমাকে পরিয়ে দেবো ট্র্যাংকে রাখা ইস্ত্রি করা সাদা পাঞ্জাবিটা। আব্বুকে যে কি পরিয়ে দিই ভাবতে হবে। গালে হাত দিয়ে ভার-ভারস্ত মানুষের মতো ভাবতে থাকে আদ্রিতা। দাদু অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে।

এতো অভাব-অনটন, এতো কষ্ট, এতো বিরম্বনা; তারপরও ঘরে এসে এই ছ্ট্টো শিশুটার দিকে তাকালে, ওর সাথে দু’দন্ড গল্প করলে যেনো আত্মা শান্তি পায়। এই কুড়ে ঘরে যেনো একটি ছোট্ট সুখপাখি আদ্রিতা। দাদুর চিন্তা-মগ্নতা ভাগিয়ে দেয় আদ্রিতা। ও বলে, ও দাদু, আব্বুর তো অসুখ করেছে- বিছানা থেকে উঠতে পারবে না। যেদিন ইঁদুর আর বিড়াল আসবে সেদিন নকশা আঁকানো কাঁথা জড়িয়ে দেবো আব্বুর গায়ে।

ওরা গল্প করছিলো বারান্দায় বসে। ঘর থেকে শাবদুল যখন 'আদ্রিতা' বলে ডাক দিলো, দাদুর কোল থেকে লাফিয়ে নামলো সে। দাদুকে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, ও দাদু আব্বুকে বুঝি ওষুধ খাওয়াতে হবে। ছোট ছোট পায়ে দৌড়ে যায় সে তার বাবার কাছে। শহরের একপ্রান্তে বস্তি ওদের।

একেবারে বুড়িগঙ্গার কোল ঘেঁষে। মরা-পঁচা বুড়িগঙ্গা। বস্তি থেকে কিছু দূরের মাঠে তবু দেখা যায় সবুজ ফসলের তে। আদ্রিতা মাঝে মাঝে দাদুর কাঁধে চড়ে কাকতাড়ুয়া দেখতে যায় সেখানে। দেখতে যায় সবুজ ঘাস আর ঘাস ফড়িঙের নাচ।

প্রজাপতিও চোখে পড়ে কোনো কোনো দিন। ফসলের মাঠে একদিন বিষাক্ত সাপ দেখে রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়েছিলো ওর দাদু। আদ্রিতার তো এখনো ঘাবড়ে যাওয়ার বয়স হয় নি- ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলো বিষাক্ত সেই সাপের ফোঁস-ফোঁসানির আওয়াজে। সাপটাকে ধরে বাসায় নিয়ে যাওয়ারও আবদার করেছিলো সে। ওটাকে নিয়ে নাকি খেলবে সে।

মাতৃস্নেহ পাবার যে অধিকার রাখে একটি শিশু সেটা পায় নি আদ্রিতা। সংসার চালাতে গিয়ে আফেলার দুচোখ কোঠরাগত। শরীর শুকিয়ে কাঠি হয়ে গেছে। দু'বেলা দু'মুঠো ভাত স্বামী, শ্বশুর আর আদ্রিতার মুখে তুলে দেয়ার মাঝেই শান্তি খোঁজে আফেলা। অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে ওর।

এতো পরিশ্রমের শরীর কাঠামো নয়। কিš‘ সংসার নামের ব¯‘টাকে টিকিয়ে রাখতে হলে শরীরের দিকে বার বার তাকালে তো চলবে না। রাতে হাতে একটা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বাসায় ফিরলো আফেলা। অসু¯’্য স্বামী তার ঘুমে বিভোর তখন। শ্বশুর তখনো ফিরেন নি এবাজার ওবাজারের খবর নিয়ে।

একটা টিমটিমে আলোর হারিকেনের আলোয় রঙ্গীন ছবিওয়ালা বইয়ের পাতায় রাজহাস, শেয়াল আর পাখীর ছবি দেখছিলো সে। আফেলাকে দেখামাত্র তার চোখে আনন্দ-রেখা ফুটে উঠলো। কান্ত মায়ের মুখে নরম হাতের পরশ বুলিয়ে সে বলে, আম্মু, আম্মু সেই শালিকা পাখিটার খবর কি? ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়েছে? আফেলার গার্মেন্টসের ছয়তলার কার্ণিশে বাসা বেঁধেছে এক জোড়া শালিক। এসব বিল্ডিঙে সাধারণত শালিকরা থাকে না। সেদিন আফেলা কাজের ফাঁকে দেখেছিলো শালিকের বাসা।

বাসায় কয়েকটি সাদা ডিমও দেখেছিলো সে। আদ্রিতার কাছে এ গল্প করার পর প্রতিদিন রাতেই সে তার মায়ের কাছে জানতে চায়- শালিক পাখীর বাচ্চা জন্মালো কি না? আফেলা কোনো কথা বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে তার নাড়ী-ছেঁড়া ছোট্ট মেয়েটার দিকে। কিছুণ পরে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ফিরে ওর বৃদ্ধ শ্বশুর। আদ্রিতার বাবা শাবদুলকে যে কারখানা থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে সেখানে শ্রমিক কিক্ষোভ হবে আগামীকাল।

বাবার মুখে এমন কথা শুনে বিছানা থেকে লাফিয়ে ওঠে শাবদুল। অসুস্থ শরীরে যেনো আগুন লেগে যায় নিমিষেই। মালিকের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেই যেনো রাগে কেঁপে ওঠে ওর মরচে ধরা দেহ। যে আদ্রিতার মুখে সব সময় কথার খৈ ফোটে বাবার অগ্নিমুর্তি দেখে সে 'থ' মেরে যায়। তার বাবার এমন চেহারা কখনো দেখে নি সে।

সেই রাতে আর সে শালিক পাখীর কথা জানতে চায় নি তার মায়ের কাছে। সকালে বৃদ্ধ দাদুর কোলে বসে গল্প করে আদ্রিতা। ইঁদুর আর বেড়াল তো চায়ের দাওয়াত খেতে আজো এলো না। কেনো এলো না এই প্রশ্নটাই বার বার করছে দাদুর কাছে। দাদু কোনো উত্তর না দিয়ে শুধুমাত্র হুঁ-হ্যাঁ করে যাচ্ছে।

কপালে তার গভীর উদ্বেগের রেখা। সকালে ছেলে শাবদুল গেছে কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিতে আর আফেলা গেছে গার্মেন্টসের কাজে। আন্দোলনে উত্তাল হয় কারখানা এলাকা। পুলিশের এলোপাথারি গুলি চলে মিছিলে। মারা যায় বেশকিছু শ্রমিক।

বস্তির পাশের চায়ের দোকানের রেডিওতে শাবদুলের বাবা জানতে পারেন মিছিলে গুলি বর্ষণের খবর। তার বৃদ্ধ বুকে জেগে ওঠে কি যেনো অচেনা, অজানা অনাকাক্সিত ব্যথা। ঘরে বসে একা একা পুতুলের বিয়ে দিচ্ছে আদ্রিতা। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে। ঘরে আসতেই আদ্রিতা ওর দাদুকে জিজ্ঞেস করে কেনো তার বাবা এখনো ফিরছে না।

দাদু কিছু বলে না। বলবেই বা কি। জানেই তো কারখানায় কে মরলো আর কে বাঁচলো। কিছুণ পর বিষণ্ন মনে ঘরে ফিরে শাবদুল। গায়ে রক্তের দাগ।

আদ্রিতার বৃদ্ধ দাদু যেনো তার ছেলের ফিরে আসাটাকে বিশ্বাসই করতে পারছে না। বুকে জড়িয়ে ধরে ভিজিয়ে দেয় অসুস্থ ছেলের বুক। ছেলেকে পেয়ে চাকরি থাকলো কি থাকলো না, এসব কিছুই জিজ্ঞেস করে নি বৃদ্ধ বাবা। আদ্রিতা তার বাবার শার্টে হাত দিয়ে বলে, আব্বু তুমি এই লাল রঙ কোথায় পেলে। আমাকে একটু দাওনা।

আমার পুতুলকে সাজিয়ে দেবো। আজ যে পুতুলের বিয়ে আব্বু। শাবদুল মেয়েকে কোলে নিয়ে বলে, এগুলো রঙ নয় মা- রক্ত। মানুষের রক্ত। এরইমাঝে উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে আফেলা।

গায়ে তার আগুন-পোড়া গন্ধ। গার্মেন্টসে অগ্নিকান্ডে সব পুড়ে ছাই। কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে এসেছে আফেলা। কারখানায় গোলাগুলি কিংবা মানুষ মরার খবর তখনো জানে না সে। স্বামীর গায়ের রক্ত দাগ দেখেও তার কিছু মনে হয় নি।

নতুন কর্মসংস্থান কোথায় হবে? কিভাবে শ্বশুর-স্বামী আর আদরের আদ্রিতার মুখে খাবার তুলে দিতে পারবে; এই চিন্তাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর এই অশিক্ষিত নারীর মনে। গার্মেন্টসে আগুন লাগার কথা শুনে ছোট্ট আদ্রিতা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। আফেলার কাছে জানতে চায় গার্মেন্টসের ছয়তলার কার্ণিশে বাসা বাঁধা শালিকের খবর। জানতে চায় শালিকের বাসা, ডিমগুলোও পুড়ে গেছে না কি? শালিক জোড়া উড়ে যেতে পেরেছে নাকি মরে গেছে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।