আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সচলায়তন ও সামহয়ারইন নিয়ে প্রথম আলোতে একটি লেখা

ফালতু ব্লগার

ম ত প্র কা শ সচল থাকুক সচলায়তন সুমন রহমান বাংলাদেশ থেকে ‘সচলায়তন’ নামক ব্লগটি দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ছাড়া বিশ্বের সর্বত্র যে ব্লগটি ইন্টারনেটে দেখা ও পড়া যাচ্ছে, সেটির দেখা বাংলাদেশ থেকে না পাওয়ার ঘটনাটি রহস্যজনক। কারিগরি ত্রুটির কারণে এমনটা ঘটেনি বলে মন্তব্য করেছেন এ ব্লগটির মালয়েশিয়া-প্রবাসী কর্ণধার। এর অর্থ দাঁড়ায়, ব্লগটি হয়তো বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ রকম ঘটে থাকলে সেটি বাংলাদেশে এ ধরনের প্রথম ঘটনা এবং সংগত কারণেই এ সংবাদটি প্রথম আলোসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে।

ইন্টারনেটে ব্লগ লেখালেখির ঘটনা পশ্চিমে প্রায় দশক-পুরোনো হলেও বাংলা ভাষায় মাত্র বছর কয়েকের। অন্যান্য দেশে বাঘা বাঘা পন্ডিত থেকে খ্যতনামাদের অনেকেই ব্লগে লেখেন, কিন্তু বাংলাদেশে ব্লগ নামক প্লাটফর্মটি গুটিকয় শিক্ষানবিশের জন্য লেখকের আত্মাভিমান তৈরির জায়গা হিসেবেই যেন এখনো রয়ে গেছে। অবশ্য কে প্রতিষ্ঠিত লেখক আর কে শিক্ষানবিশ, সেটি ব্লগের মাথাব্যথার কারণ নয়। ব্লগ মুক্তচিন্তা ও চিন্তার সরাসরি আদানপ্রদানের জায়গা। সেখানে লেখক-পাঠক, খ্যাতিমান-শিক্ষানবিশ মিলেই একটা চিন্তাকে টগবগ করে ফুটতে সাহায্য করেন।

ফলে লেখকের সঙ্গে পাঠকের, বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ীর, ঘটনার সঙ্গে ঘটকের ভেদ ঘুচে যাওয়ার কথা ব্লগের পরিমন্ডলে। ব্লগের মতো একটি উত্তর-আধুনিক মাধ্যমের এটিই বড় বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আদৌ কি হয়েছে সেটি বাংলাদেশে? বাংলাদেশে প্রথম যে ব্লগটি বড় স্কেলে দৃশ্যমান হয় সেটির নাম ‘সামহোয়ারইনব্লগ’। এটি আকারে বেশ বড়, প্রায় পনের হাজার সদস্য সেখানে নিবন্ধন করেছেন বলে জানা যায়। সামহোয়ারইনব্লগ আকারে বড় এবং উন্নুক্ত।

যে কেউ এর সদস্য হয়ে লেখা শুরু করে দিতে পারেন। অপরদিকে সচলায়তন মূলত সামহোয়ারইনব্লগ ভাঙা একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী, আকারে অনেক ছোট এবং এখানে লেখক হিসেবে ঠাঁই পেতে হলে রীতিমতো বর্ষব্যাপী সাধনা করতে হয়। সদস্যদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সামহোয়ারইনব্লগ বেশ ঢিলেঢালা রীতি অনুসরণ করলেও সচলায়তন রীতিমতো কঠোর। এর পরিণামও হয়েছে দুই রকম: ঢিলেঢালা সামহোয়ারইন যেখানে ভার্চুয়াল ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ও ভার্চুয়াল ‘রাজাকার’দের পারস্পরিক বিষোদগারের কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, সেখানে কর্ণধারশাসিত সচলায়তন হয়ে উঠেছে সুশীল ‘মুক্তচিন্তা’র প্লাটফর্ম। সামহোয়ারইনব্লগ যখন চরম নৈরাজ্য, সচলায়তনে তখন পরম নিয়ন্ত্রণ।

চরম আর পরমের এ দুই রকম নমুনা দেখে বুঝতে বাকি থাকে না যে ব্লগের মতো উত্তর-আধুনিক মাধ্যমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো প্রস্তুতি আমাদের এখনো নেই। মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রসঙ্গটি সংগত কারণেই সামনে এসে যায়: সম্প্রতি ঢাকায় স্বাধীনতাবিরোধীদের হাতে একজন মুক্তিযোদ্ধার লাঞ্ছনার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সচলায়তন - এ যে সহিংস বিক্ষোভ লতিয়ে উঠেছে, তাকে নীরবে ছাড় দেওয়ার মতো অবকাশ কি একটি আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আছে? নিশ্চিতভাবেই নেই, আর নেই বলেই হয়তো বাংলাদেশের আন্তর্জালে সচলায়তন অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিন্তু আরও কথা থেকে যায়। একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রকাশ্য লাঞ্ছনার ঘটনায় অদ্যাবধি রাষ্ট্রের যে নীরবতা, তা কি রাষ্ট্রের পক্ষে আত্মঅবমাননার শামিল নয়? দেশপ্রেমিক মানুষের অহংকার তবে কোন অরণ্যে গিয়ে শান্তি খুঁজবে? অদ্ভুত এই দশা! উত্তর-আধুনিক ব্লগমাধ্যমে সচলায়তনকে দেখা গেছে কঠোর পরিচালনা, নিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকার, নিষিদ্ধকরণ, ভাবাদর্শের প্রচারনা, নিজেদের চারপাশে সুস্পষ্ট সীমানা ইত্যাদি মেনে পরিচালিত হতে, যেগুলো আদতে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রব্যবস্থায় দেখা যায়। আবার, তার স্বাধীনতার সৈনিকদের প্রকাশ্য লাঞ্ছনার ঘটনায় পদক্ষেপশুন্য থাকা খোদ বাংলাদেশের জন্য যেন এক উত্তর-আধুনিক ঔদাস্য, ষড়যন্ত্র যদি নাও হয়! অদ্ভুত এই নাট্যমঞ্চ! যার যে ভুমিকায় অভিনয় করার কথা নয়, সে সেই ভুমিকায় অভিনয় করে চলছে! লোহার বাসর বানালে ছিদ্র সেখানে থাকেই, সচলায়তন - এর সহিংস বিক্ষোভ হয়তো সেই ছিদ্রপথ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে।

অন্য একটি ব্লগে এ নিয়ে আলাপ হচ্ছিল। ব্লগের কৌশল আসলে কী হবে? নিয়ন্ত্রণ, না নৈরাজ্য? একজন বললেন, নিয়ন্ত্রিত নৈরাজ্য। সুন্দর নির্দেশনা! কিন্তু কথা আসে, কতটুকু নিয়ন্ত্রণ আর কতটুকু নৈরাজ্য? নিয়ন্ত্রণের ভার কে নেবে, ব্লগাধিপতি, নাকি রাষ্ট্র? সেসব নিয়ে আরও বহু বহু ভাবনার জায়গা আছে। ব্লগারকে ভাবতে হবে, আবার রাষ্ট্রকেও। স্বীকার করতেই হবে যে সামহোয়ারইনব্লগ ও সচলায়তন বাংলা ভাষায় ব্লগ লেখালেখির দ্বার খুলে দিয়েছে, নানা বিষয়ে চমৎকার সব লেখা হাজির করেছে, নবীন লেখকদের জন্য রীতিমতো প্রজননক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

অনেক প্রতিষ্ঠিত লেখকও সেসব জায়গায় এসে ভিড় করছেন দেখতে পাই। আবার, ব্লগ শুধু যে লেখালেখি ও চিন্তার আদানপ্রদানেই সীমিত আছে তা নয়, বরং নিজেদের একটা কমিউনিটিও বানিয়ে নিচ্ছে এবং একটা সংঘবদ্ধতার শক্তির জানানও দিচ্ছে। সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশিদের এহেন সংঘবদ্ধতা যেকোনো বিচারেই স্বাস্থ্যকর, জাতিরাষ্ট্রীয় বিবেচনায় তো বটেই। তাকে পিঠ দেখানো মোটেই সুলক্ষণ নয়। ব্লগ একটি নতুন গণমাধ্যম এবং এটি পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীন এমনটাও বলা যাচ্ছে না।

এ কারণে সচলায়তন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হলেও বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে, এমনকি বাংলাদেশ থেকেও প্রক্সি সার্ভার দিয়ে এই ব্লগসাইট দেখা যাচ্ছে। ফলে নিয়ন্ত্রণের পুরোনো কৌশল এখানে খুব যে কার্যকর এমনও না। আবার, রাষ্ট্রীয় পরিমন্ডলে মত প্রকাশের স্বাধীনতা বলতে যা বুঝায়, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলেও সেই একই জিনিস বুঝাবে? যিনি স্বাধীন মত প্রকাশ করছেন, তিনি অন্যের স্বাধীন মত প্রকাশে কতটুকু বিঘ্ন সৃষ্টি করছেন? অধিকার ও দায়িত্বের সীমা কোথায়? ব্লগ প্রশ্নে এসব বিষয়ের মীমাংসা খোদ পশ্চিমা বিশ্বেই ঠিকমতো হয়নি। অনেক রাষ্ট্রকে দেখা যায় ব্লগের এই দামাল চরিত্রটি কিছুমাত্রায় মেনে নিয়েছে, আবার লেখায় ‘আপত্তিকর’ বিষয় পেলে এর লেখক হিসেবে ব্লগারের শাস্তি হচ্ছে, এমনটাও দেখা যায় অনেক দেশে। সচলায়তনকে কোনো বিপ্লবী গোষ্ঠী বা কঠোর গ্রুপ বলে মনে হয়নি কখনোই।

রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধের প্রতি সার্বিকভাবে এরা শ্রদ্ধাশীল, এমনটাই লেগেছে। গোষ্ঠীগত অহম বা আভিজাত্যবোধ আছে ওদের, সে অন্য প্রসঙ্গ। ব্লগের পরিবেশ এর লেখকদের যে অবারিত স্বাধীনতা দিয়েছে, তাকে তারা আরও দায়িত্বশীল উপায়ে কাজে লাগাবেন, এমন প্রত্যাশা হয়তো ছিল অনেকের। কিন্তু আমি মনে করি, তাদের যে ভুল তা স্রেফ শিক্ষানবিশির ভুল, এর ফলে তাদের যদি সত্যি সত্যিই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকে, তবে তা লঘুপাপে গুরুদন্ড হয়ে গেছে। অন্য কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যেত।

আমরা বরং সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশি তরুণদের পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার, একে অপরের মাঝে দেশকে খুঁজে ফেরার এই প্রয়াসটিকে চলতে দিলেই সুবুদ্ধির পরিচয় দেব। সচল থাকুক সচলায়তন। সুমন রহমান: কবি, কথাসাহিত্যিক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.